দেশের সময়: পুজো শেষে এ যেন এক নতুন উৎসব। তাই দশমীর বিষাদ কেটে গেল ত্রয়োদশীতে দুর্গা কার্নিভালে। পুজোর রেশ জিইয়ে রেখে এই উৎসবে গা ভাসালেন মহানগরের বাসিন্দারা। যোগ দিলেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনও। আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠল কলকাতার রাজপথ। চেনা রেড রোড যেন অচেনা। বিদেশিদের ভিড়। মুগ্ধ হয়ে এই উৎসব উপভোগ করলেন ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা। দরাজ মনে তাঁরা তারিফ করলেন বাংলার।

স্বীকৃতি পেল বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি। রাজবাড়ির আদলে তৈরি হয়েছিল মূল মঞ্চ। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতা এবং সল্টলেক মিলিয়ে মোট ৯৫টি পুজো কমিটি অংশগ্রহণ করে কার্নিভালে। থিমের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রতিটি পুজো কমিটিরই ছিল ট্যাবলো। চোখ ধাঁধানো উপস্থাপনা। শিল্পশৈলী। যা মন কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের। গর্বের হাসি লক্ষ্য করা গিয়েছে গোটা অনুষ্ঠানের মধ্যমণি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও।

সময় যত এগোতে থাকে, ততই রঙিন হয়ে ওঠে কার্নিভালের ক্যানভাস। ঢাকের বাদ্যি, গরবা নাচ, ধামসা-মাদল সবমিলিয়ে যেন আক্ষরিক অর্থে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে কলকাতার দুর্গা কার্নিভাল। কিন্তু এত আয়োজনের মাঝেও যেন কোথাও একটা মন কেমন করা ছিল। উত্তরবঙ্গের মালবাজারে হড়পা বানে ভেসে গিয়ে আটজনের মৃত্যুর ঘটনা মনের কোণে প্রশ্ন তুলেছে, এরপরও কি এত আয়োজনের প্রয়োজন ছিল? কার্নিভাল নিয়ে কটাক্ষ করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করে তাঁর তোপ, বাবুঘাটে এমন একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে রেড রোডে এই কার্নিভাল কি হত? যেহেতু ঘটনাটা উত্তরবঙ্গে, তাই কিছু এসে যায় না। একারণেই আলাদা রাজ্যের দাবি ওঠে উত্তরবঙ্গে। শুভেন্দুর কটাক্ষ, কার্নিভালে মা দুর্গাকে দেখা না গেলেও তাঁর কাটআউটের খামতি ছিল না।

এদিকে, সেভাবে লক্ষ্মীলাভ না হওয়ায় তাল কাটল জেলার কার্নিভালে। কোথাও বাড়তি খরচের টাকা জোগাড় করতে না পারায় কোনও পুজো কমিটি কার্নিভালে অংশ নিল না। কোথাও আবার কার্নিভালই হল না। জলপাইগুড়ির ছবিটা অবশ্য আলাদা। মালবাজারের দুর্ঘটনার জেরে সেখানে কার্নিভাল বাতিল করার আর্জি জানায় পুজো কমিটিগুলি।

শুক্রবার জেলায় জেলায় যখন কার্নিভাল হয়েছে, তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে, নিঃশব্দে প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছে জলপাইগুড়ির বহু পুজো কমিটি। মালবাজারের দুর্ঘটনায় মৃতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শোক পালন করেছে তারা। এদিকে, মালবাজারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ভাসান ঘিরে নদীঘাটগুলিতে ছিল বাড়তি সতর্কতা। প্রতিটি ঘাটেই মাইকিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তাতে লাগাতার মানুষজনকে সতর্ক করা হয়েছে। ছিল বাড়তি আলোর ব্যবস্থা। মোতায়েন রাখা হয়েছিল বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। প্রচুর পুলিশ কর্মী।

সীমান্ত শহর বনগাঁর মানুষের এবার মন খারাপ। কারণ, এখানে এবছর কার্নিভাল হয়নি। প্রশাসনের যুক্তি, উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতে কার্নিভাল হয়েছে। তাই আর আলাদা করে বনগাঁতে হয়নি। কিন্তু গতবারও বনগাঁয় কার্নিভাল হয়েছে। আর বারাসতের সঙ্গে সম্পর্ক কী। বনগাঁ মহকুমাকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তো আলাদা জেলা ঘোষণা করেই দিয়েছেন। তা হলে বনগাঁয় কার্নিভাল হবে না কেন, প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

বনগাঁর পুরপ্রধান গোপাল শেঠ অবশ্য বলেছেন, করোনার ধাক্কায় দু’বছর ব্যবসাপত্র কিছুই হয়নি। সেই ধাক্কা সামলে এবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাঁরা তেমন চাঁদা দিতে পারেননি। ফলে পুজোর খরচ করে কার্নিভাল করার মতো তহবিল ছিল না বেশিরভাগ কমিটির কাছে। সেকারণে এবার কার্নিভালে যোগ দেওয়ার জন্য পুরসভায় কোনও আবেদনও জমা পড়েনি।

কলকাতায় কয়েক বছর আগে দুর্গা কার্নিভাল শুরু হলেও সেই অর্থে জেলায় কার্নিভাল এবারই প্রথম। ফলে শিলিগুড়ি থেকে বর্ধমান, দুর্গাপুর থেকে বালুরঘাট, কোথাও আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শোভাযাত্রা হয় শিলিগুড়িতে। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে কার্নিভালের শোভাযাত্রা শুরু হয় সেখানকার শিলিগুড়ি মোড় থেকে। প্রতিটি পুজো কমিটি তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে সুপার মার্কেট এলাকায়।
অন্যদিকে, টাকিতে ইছামতীতে বিসর্জনকে কেন্দ্র করে মেতে উঠল দুই দেশ। করোনার কারণে দু’বছর এখানে বিসর্জন ঘিরে উৎসব বন্ধ ছিল। ফলে এবার ছিল বাড়তি উন্মাদনা। কিন্তু নিরাপত্তার বেষ্টনীতে তাতে ছেদ পড়ে।

দশমীর দিন দুপুর একটা থেকেই ইছামতীর ঘাটে শুরু হয়ে যায় প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রক্রিয়া। চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। প্রথা অনুযায়ী, প্রথমে টাকি পূর্বের জমিদারবাড়ির প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর একে একে ভাসান দেওয়া হয় বাকি প্রতিমা। টাকিতে ইছামতীর একপাড়ে ভারত, অন্যপাড়ে বাংলাদেশ। দশমীতে এই নদী হয়ে ওঠে দু’দেশের মিলনক্ষেত্র। এপারের প্রতিমা যেমন বিসর্জনের আগে নৌকায় তুলে ঘোরানো হয়। ওপারের প্রতিমাও আসে। পাশাপাশি দু’দেশের দুর্গা প্রতিমা দেখতে ভিড় জমান বহু মানুষ।

এবারও তার অন্যথা না হলেও জৌলুস যেন অনেকটাই কম ছিল। কোনওভাবেই যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নদীর মাঝ বরাবর বোটে পেট্রলিং করেছে। নদীর মাঝে চিহ্নিত করে দেওয়া হয় দু’দেশের সীমারেখা। আবেগের মেলবন্ধন ঘটলেও কেউ যাতে সীমারেখা অতিক্রম না করে, সে ব্যাপারে কড়া নজর ছিল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর।
কলকাতার দুর্গা কার্নিভালে কিছুটা হলেও যেন ছন্দপতন। দেখা গেল না উত্তরের নলিন সরকার স্ট্রিট সর্বজনীনের প্রতিমা। তারা নাকি আমন্ত্রণই পায়নি।

পুজোয় বহু পুরষ্কার এসেছে এই পুজো কমিটির ঝুলিতে। কিন্তু জোটেনি বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান। আর যেহেতু যারা বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান পেয়েছে, তাদের মধ্যে থেকেই কার্নিভালে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ এসেছে, ফলে বাদ পড়ে গিয়েছে নলিন সরকার স্ট্রিট। এদিকে, নলিন সরকার স্ট্রিট সর্বজনীনের প্রতিমাকে কার্নিভালে দেখতে না পাওয়ায় মন খারাপ অনেকেরই। তাঁদের বক্তব্য, শিল্পী সুব্রত মৃধা অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতার আদলে এখানকার প্রতিমা গড়েছিলেন।

যা সত্যিই তারিফ করার মতো। সেই প্রতিমা কার্নিভালে স্থান পাওয়া উচিত ছিল। এদিকে, কার্নিভালে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ না আসায় নলিন সরকার স্টিটের পুজো উদ্যোক্তারা শুক্রবারই তাঁদের প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছেন। কার্নিভালে দেখা গেল না বাগবাজার সর্বজনীনের প্রতিমাও। তারা অবশ্য কার্নিভালে যোগ দেওয়ার ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু রীতি ভাঙতে পারবেন না। তাই দশমীতেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছেন প্রতিমা। কার্নিভালের আগে প্রতিমা ভাসান দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালিও।

কলকাতার কার্নিভালে এবার উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি একডালিয়া এভারগ্রিন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পরের বছর কলকাতার রেড রোডে কার্নিভালের শোভাযাত্রায় যোগ দিতে মন চায়নি পুজো উদ্যোক্তাদের। এদিকে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো বলে পরিচিত নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘও এবার কার্নিভালে নেই। প্রতিমার উচ্চতা বেশি বলে কার্নিভালে যেতে পারেনি রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘ। টালা প্রত্যয়ের প্রতিমার উচ্চতা ছিল ৪৩ ফুট। মণ্ডপ প্রাঙ্গণেই তারা সেই প্রতিমা গলিয়ে ফেলেছে। পরিবর্তে ছোট ফাইবারের প্রতিমা নিয়ে কার্নিভালে অংশ নেয় তারা।

করোনা মহামারীর কারণে গত দু’বছর কলকাতায় রেড রোডে দুর্গা কার্নিভালের আয়োজন করা যায়নি। তার উপর এবার বাংলার দুর্গাপুজোকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ফলে কার্নিভাল ঘিরে যেন বাড়তি উন্মাদনা ছিল। শনিবার সকাল থেকেই ট্যাবলো নিয়ে বিভিন্ন পুজো কমিটি রেড রোডের দিকে রওনা দেয়। প্রতিটি পুজো কমিটির জন্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল নিয়ম। বলা হয়, একটি কমিটি সর্বাধিক তিনটি ট্যাবলো প্রদর্শন করতে পারবে। প্রতিটি পুজো কমিটি তাদের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার জন্য সময় পাবে সর্বাধিক তিন মিনিট।

সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার সময় ঢাকি সহ সর্বাধিক ৫০ জন উপস্থিত থাকতে পারবেন একটি পুজো কমিটির তরফে। বলা হয়েছিল, বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে রেড রোডে ট্যাবলো নিয়ে রিপোর্ট করতে হবে পুজো কমিটিগুলিকে। কার্নিভালে যারা অংশ নেবে, তাদের প্রতিমার উচ্চতা ১৫ ফুটের বেশি হওয়া চলবে না। বিপুল জনসমাগম সামাল দিতে রেড রোড সংলগ্ন এলাকায় আঁটোসাঁটো করা হয় নিরাপত্তা। মোতায়েন ছিলেন প্রায় দু’হাজার পুলিশ কর্মী। মোটা ময়দান অঞ্চলকে ভাগ করা হয়েছিল ১২টি জোনে। প্রতিটি জোনের দায়িত্বে ছিলেন একজন করে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার অফিসার।

কার্নিভালের স্পটে অর্থাৎ রেড রোডে ছিলেন ডিসি সেন্ট্রাল ও ডিসি সাইবার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেড রোড সংলগ্ন বিভিন্ন রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ করা হয় যান চলাচল। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি করা হয়েছিল ৮টি ওয়াচ টাওয়ার, ১০টি পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র। রাখা হয়েছিল ৫টি কুইক রেসপন্স টিম।


ফোর্ট উইলিয়াম থেকে শুরু হয় কার্নিভাল। রেড রোড কার্যত উৎসব সরণীতে পরিণত হয়।

এদিন কার্নিভালে যাওয়ার পথে বেপরোয়া ট্যাক্সির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় কলকাতার রামমোহন সম্মিলনীর ট্যাবলো। ওভারটেক করতে গিয়ে ট্যাক্সিটি ট্যাবলোয় ধাক্কা দেয়। গাড়ির চালককে আটক করা হয়েছে। মালবাজারের ঘটনার পরও শিক্ষা হল না। রায়গঞ্জে কার্নিভালের শোভাযাত্রার মাঝে ঢুকে পড়ল ষাঁড়। ফলে চরম হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে গিয়েছে শুক্রবার রাতে। হুড়োহুড়িতে মৃত্যু হয়েছে একজনের। জখম বেশ কয়েকজন।

কার্নিভাল নিয়ে অবশ্য রাজনৈতিক সংঘাত থেমে নেই। মালবাজারে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর কার্নিভালের কী প্রয়োজন? এ জন্যই উত্তরবঙ্গে আলাদা রাজ্যের দাবি ওঠে, মন্তব্য রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর। যদিও তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের দাবি, শোকের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। মমতার গানে কার্নিভালর বোধন হয়। ওই গানে নৃত্য পরিচালনা করেন সৌরভ গাঙ্গুলীর স্ত্রী ডোনা গাঙ্গুলী।

বাইকে ব্যালেন্সের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় দেবী দুর্গাকে। বাইকে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজান কলকাতা পুলিশের এক কর্তা। কার্নিভালে সবার প্রথমে আসে আলিপুর বডিগার্ডস লাইন। তারা পরিবেশন করে খুকরি নৃত্য। দ্বিতীয় আসে বিশ্ব বাংলা সেরার সেরা পুরস্কার প্রাপ্ত দক্ষিণ কলকাতা সর্বজনীন পুজো কমিটি। এই পুজোটি হয় ভবানীপুরে। তিন নম্বরে আসে কলেজ স্কোয়ার সর্বজনীন। এরাও বিশ্ব বাংলা সেরার সেরা পুরস্কার পেয়েছে।

শোভাযাত্রায় মমতার ছবি দেওয়া প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। দমদম তরুণ সঙ্ঘের থিম ছিল ‘চলমান’। ১৮ তম বর্ষে দক্ষিণপাড়া দুর্গোৎসব কমিটি। তাদের থিম ছিল, তামাক বর্জন, আয়ু অর্জন। হালতু নন্দিবাগান দুর্গোৎসব কমিটি কার্নিভালে থিম করেছিল, উৎসব। ৩০ বছর হল এদের পুজো। ৪১ পল্লীর থিম গোলকধাঁধা। ১৯৫৫ সালে শুরু হয় এদের পুজো। ১৯৫১ সাল থেকে পুজো করছে বালিগঞ্জ কালচারাল এসোসিয়েশন। এবার তাদের পুজো ছিল ৭২ বছর। তাদের থিম নজর কাড়ে।

বেলঘড়িয়া বাণী মন্দির অংশ নেয় কার্নিভালে। শহরতলীর পুজোর মধ্যে এদের পুজো যথেষ্ট ভিড় টানে। দমদম তরুণ দলের ভাবনায় ছিল সিটি অব জয়। এবার তাদের পুজোর ৪৫ বছর ছিল। কার্নিভালে গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নোয়াপাড়া দাদাভাই সঙ্ঘ। বিভিন্ন আকারের মা লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসে তারা। উল্টোডাঙ্গার বিধান সঙ্ঘ ভাবনার জন্য এবার পুজোয় বিশ্ব বাংলা পুরস্কার পেয়েছে। এরাও নৃত্য পরিবেশন করে।

আহিরীটোলা সর্বজনীনের তিন আকাশবাণী। শ্রীভূমি এবার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছে। তাদের থিম ছিল ভ্যাটিকান সিটি। মহালয়া থেকেই এই পুজো দেখতে ভিড় আছড়ে পড়ে। কার্নিভালে এদের হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন ঐন্দ্রিলা সেন ও অঙ্কুশ হাজরা। অদিতি চক্রবর্তীর ভাবনায় পুজো হয়েছে কাশী বোস লেনে।

এদের শোভাযাত্রায় এক খুদে সাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে গোলাপ ফুল দেয়। নারায়ণ দেবনাথের কালজয়ী সৃষ্টি নিয়ে থিম করেছিল সিংহি পার্ক। অবসর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির থিম ছিল এবার পুরোটাই গল্প। ভবানীপুর ৭৫ পল্লীর থিম, বেঁচে থাকুক। কার্নিভালে তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গান জাগো তুমি জাগো বাজায়। বেহালা নতুন দলের থিম ছিল আশ্রয়ের আশ্বাস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও সুরে আদিবাসী নৃত্য পরিবেশন করে তারা কার্নিভালে।

মুখ্যমন্ত্রীকে একাধিকবার মঞ্চ থেকে নেমে আসতে দেখা যায়। উদ্যোক্তারাও মূল মঞ্চের কাছে চলে আসেন। অরিন্দম শীল মঞ্চে এসে মমতাকে কাঁসর তুলে দেন। মুখ্যমন্ত্রী সেটি বাজান। রামমোহন সম্মিলনীর থিম ছিল জঙ্গলকন্যা। শোভাযাত্রায় পা মেলান ঝাড়গ্রামের আদিবাসী শিল্পীরা। রঙিন কার্নিভালে মমতা মঞ্চ থেকে নেমে এসে পা মেলান নৃত্যে। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন সিনেমা ও সিরিয়ালের অভিনেত্রীরা। ঐন্দ্রিলাকে বুকে টেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। হলুদ শাড়িতে মোহময়ী লাগছিল মিঠাইকে।

তারকার ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে কার্নিভাল। কার্নিভাল শুরুর কয়েক ঘন্টা পরও রেড রোড এতটুকু ঝিমিয়ে পড়েনি। বরং একইরকম উৎসাহে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করেছে কার্নিভালর রংয়ে নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে। হিন্দুস্তান ক্লাব সর্বজনীনের শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। নাচে শামিল হন তিনি। প্রথমদিকে পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা মূল মঞ্চের কাছে চলে আসছিলেন। তাঁদের দেখে মুখ্যমন্ত্রীও নেমে যাচ্ছিলেন। অবশ্য রাত আটটা নাগাদ কঠোর হন মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীরা। মূল মঞ্চের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন তাঁরা।

কার্নিভালে যোগ দেয় ফতেহপুর দুর্গোৎসব কমিটি, আহিরীটোলা যুবকবৃন্দ, নিউটাউন সর্বজনীন দুর্গোৎসব, ১৪ পল্লি উদয়ন সঙ্ঘ, ২৫ পল্লি, উল্টোডাঙ্গা বিধান সঙ্ঘ, ভবানীপুর ৭০ পল্লি, প্রতাপাদিত্য ত্রিকোণ পার্ক, ফরওয়ার্ড ক্লাব, উত্তর হালদার পাড়া ক্লাব, চালতাবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব, ঠাকুরপুকুর এস বি পার্ক, বেলঘরিয়া মানসবাগ দুর্গোৎসব, দমদম পার্ক ভারত চক্র, বড়িশা প্লেয়ার্স কর্নার, গড়িয়াহাট হিন্দুস্থান ক্লাব, বাটাম ক্লাব, শান্তিপল্লি পুজো সমিতি, কালীঘাট মিলন সঙ্ঘ, গান্ধী কলোনি এন এস সি বোস ক্লাব, বকুলবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব, কাঁসারিপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, কোলাহল সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, কামডহরি সুভাষপল্লি সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, বরিশা ক্লাব, হরিদেবপুর নিউ স্পোর্টিং ক্লাব, বালিগঞ্জ ২১ পল্লি, বেলগাছিয়া সাধারণ দুর্গোৎসব (টালাপার্ক), উল্টোডাঙ্গা শুঁড়িরবাগান দুর্গোৎসব, হাতিবাগান সর্বজনীন।

যোগ দিয়েছিল ভবানীপুর মুক্তদল, চোরবাগান সর্বজনীন, ভবানীপুর স্বাধীন সঙ্ঘ, পদ্মপুকুর বারোয়ারি সমিতি, তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব, কালীঘাট কিশোর সঙ্ঘ, পূর্ব পুঁটিয়ারি প্রগতি সংঘ, এফ ডি ব্লক সর্বজনীন পুজো কমিটি, মুখার্জি ঘাট সর্বজনীন প্রসারিত সমিতি, এ কে ব্লক অ্যাসোসিয়েশন, ফাল্গুনি সঙ্ঘ ৩২) নবপল্লি সঙ্ঘ ও শিবমন্দির।শিকদার বাগানের পুজোর ১১০ বছর ছিল এবার। কার্নিভালে নজর কাড়ে তারা। চেতলা অগ্রণী, সুরুচি সঙ্ঘ এরা তো কলকাতার পুজোর মধ্যমণি।কুণাল ঘোষের পাড়ার পুজো রামমোহন সম্মিলনীর সঙ্গে নাচ করেন মুখ্যমন্ত্রী।

সাঁওতাল নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে নাচেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন টলিউডের শিল্পীরা। মূল মঞ্চ থেকে অনেকক্ষণ পর নেমে কাঁসরের পর নাগাড়া বাজান মুখ্যমন্ত্রী। চেটেপুটে কার্নিভাল উপভোগ করেন তিনি। রাত ন’টা নাগাদ মঞ্চ থেকে নেমে এসে ডান্ডিয়া খেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘মিঠাই’ সৌমিতৃষা, জুন মালিয়া, শুভ্রা চক্রবর্তীদের সঙ্গে ডান্ডিয়া খেলেন মুখ্যমন্ত্রী।

তবে রাজনীতিতে দূরে সরিয়ে রেখেই শনিবার কলকাতার রেড রোড এক অন্য চেহারা নেয়। বিকেল সাড়ে চারটেয় শুরু হওয়া কার্নিভাল যখন শেষ হল তখন ঘড়ির কাঁটায় প্রায় রাত সোয়া ন’টা।

এই পাঁচঘণ্টা ধরে এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্ত দেখায়নি রেড রোডকে। বরং উৎসবের রঙের ছ’টায় প্রতিক্ষণে উদ্ভাসিত হয়েছে এই পথ। উৎসবরে মহানগর এদিন আরও একবার রেকর্ড গড়ল। প্রমাণ করল নিজেকে। বিশ্ববাসীকে আপন করে নিয়ে যেন বার্তা দিল, অতিথি দেবঃ ভবঃ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here