দেশের সময়: সালটা ১৯৫৩। কাটোয়া শহরের বাসিন্দা গঙ্গাধর যশ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তারপর মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ৭০ বছর। আর কোনও কৃতী ছাত্র কিংবা ছাত্রী কাটোয়া শহর থেকে মাধ্যমিকে সেরা হতে পারেনি। এনিয়ে আক্ষেপ ছিল শহরবাসীর। অবশেষে সেই খরা কাটিয়ে দিল দেবদত্তা মাঝি।

একইসঙ্গে কৃতী এই ছাত্রীর হাত ধরে গর্বের মুকুট ফিরল প্রাচীন এই শহরে। কাটোয়ার মেয়ে দেবদত্তা যে শুধু মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম হয়েছে, সেটাই নয়, এই শহরের দু’টি স্কুলের পাঁচ পড়ুয়া জায়গা করে নিয়েছে মেধা তালিকায়। যা নিয়ে উচ্ছ্বসিত শহরবাসী।

দেবদত্তা যেমন কাটোয়ায় ৭০ বছরের খরা কাটিয়েছে, তেমনই চার বছর পর মাধ্যমিকের শীর্ষস্থান পেল কোনও ছাত্রী। এর আগে ২০১৮ সালে কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির ছাত্রী সঞ্জীবনী দেবনাথ মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছিলেন। দেবদত্তা এবার শুধু যে প্রথম হয়েছে, তা নয়। তার সঙ্গে দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর নম্বরের পার্থক্য ৬।

আইআইটি থেকে পড়ে ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় কাটোয়ার ঘুটকিপাড়ার আবাসনের বাসিন্দা দেবদত্তা। মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার পর থেকে ওই আবাসনে উপচে পড়ছে ভিড়। ঢল নেমেছে বিশিষ্টজনদের। ফোন করে দেবদত্তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাটোয়ার দুর্গাদাসী উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী দেবদত্তা ৭০০-র মধ্যে পেয়েছে ৬৯৭। বাংলায় তার প্রাপ্ত নম্বর ৯৮, ইংরেজিতে ১০০, অঙ্কে ১০০, ভৌত বিজ্ঞানে ১০০, জীবন বিজ্ঞানে ১০০, ইতিহাসে ৯৯ ও ভূগোলে ১০০। বাবা জয়ন্তকুমার মাঝি আসানসোল বিবি কলেজের অধ্যাপক। মা শেলি দাঁ দেবদত্তার স্কুলেরই পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষিকা।

কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল দেবদত্তা। তার কথায়, দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পড়তাম। মাধ্যমিকে প্রথম হওয়ার কথা ভেবেছিলে? লাজুক ছাত্রীর উত্তর, ভাল ফল হবে ভেবেছিলাম। তা বলে প্রথম হব, এতটা ভাবিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি বেহালা বাজাতে পছন্দ করে দেবদত্তা। নেশা গোয়েন্দা গল্পের বই পড়া। সাতজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁদের পাশাপাশি বাবা-মাও মেয়েকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করতেন।

জয়ন্তবাবু পুরুলিয়ার আদি বাসিন্দা। বছর পনেরো আগে চাকরি সূত্রে তিনি স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কাটোয়ায় আসেন। তারপর এখানেই ফ্ল্যাট কিনে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। শুক্রবার টিভির পর্দায় দেবদত্তার নাম ঘোষণা হতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে গোটা কাটোয়া শহর। তার বাড়িতে চলে আসেন স্থানীয় বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। কাটোয়া থানার আইসি তীর্থেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় দেবদত্তার বাড়িতে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসেন। কাটোয়া দুর্গাদাসী চৌধুরানী উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কবিতা সরকার বলেন, আমি দারুণ খুশি। দেবদত্তার সাফল্যে গর্ব অনুভব করছি। ও আমাদের স্কুলের নাম উজ্জ্বল করল।
রেজাল্ট আনতে দেবদত্তা স্কুলে আসতেই তাকে ঘিরে ধরে সহপাঠী থেকে শিক্ষিকারা। ফুল, মিষ্টি, আদরে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।

শুধু কাটোয়া নয়, গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলাই এবার মাধ্যমিকের ফলে চমক দিয়েছে। এই জেলা থেকে মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ১৭ জন। প্রথমের পাশাপাশি দ্বিতীয় স্থানাধিকারীও রয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। দ্বিতীয় হয়েছে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ছাত্র শুভম পাল। ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হতে চায়। শুভমের কথায়, টেক্সট বই খুঁটিয়ে পড়তে হবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করলেই ভাল ফল করা সম্ভব। বর্ধমানের অর্কদীপ গোস্বামীও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বর্ধমান শহরের গোলাহাটের বাসিন্দা অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় চতুর্থ হয়েছে। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৯। পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে চায় সে। পড়াশোনার পাশাপাশি ভালবাসে ফুটবল খেলতে। পঞ্চম স্থান অধিকারী শেখ সৈয়দ ওয়াসিফও বর্ধমান শহরের গোলাপবাগের বাসিন্দা। বর্ধমানের সুভাষপল্লির বাসিন্দা রূপায়ণ পালও রয়েছে পঞ্চম স্থানে। বর্ধমানের মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ছাত্র প্রণীল যশ ষষ্ঠ। কাটোয়ার কাশীরামদাস ইন্সটিটিউশনে ঋদ্ধিত পাল সপ্তম। কাটোয়ার দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য অষ্টম।

আউশগ্রামের আমড়াগড় হাইস্কুলের ঈশিতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবম। রায়নার শ্যামসুন্দরের বাসিন্দা দেবরাজ হাজরা দশম। বর্ধমানের পুলিশ লাইনের বাসিন্দা ঈশানচন্দ্র বর্মন দশম। বর্ধমান শহরের একটি স্কুল থেকেই মেধা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সাতজন।

কাটোয়ার কাশীরাম দাস বিদ্যায়তন থেকে ৬৮৬ নম্বর পেয়ে রাজ্যে সপ্তম ঋদ্ধিত পাল। ওই স্কুলেরই অঙ্কের শিক্ষক চন্দ্রশেখর পাল ও মণিকা সাধুর ছেলে ঋদ্ধিত। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায়। পড়াশোনার পাশাপাশি সে তবলা বাজাতে ভালবাসে। ক্রিকেট খেলা, ছবি আঁকা নেশা। সারাদিনে ঋদ্ধিত পড়েছে ১২-১৩ ঘণ্টা। কাশীরাম দাস বিদ্যায়তনের আরএক ছাত্র শুভদীপ চাপাদার ৬৮৪ নম্বর পেয়ে নবম স্থানে।

কাটোয়ার পাঁচঘড়ার বাসিন্দা বনকাপাশি স্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষক ধীরাজ চাপাদারের ছেলে শুভদীপ। ভবিষ্যতে বাবার মতো সেও শিক্ষক হতে চায়। কাটোয়ার কাশীরাম দাস বিদ্যায়তনের শিক্ষক মুন্সি আবুল বরকতের মেয়ে শামরিন আখতার ৬৮৬ নম্বর পেয়ে রাজ্যে সপ্তম স্থানে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায় সে। পড়াশোনার পাশাপাশি শামরিনের নেতা সত্যজিৎ রায়ের লেখা পড়া এবং ছবি আঁকা।

আউশগ্রাম অমরাগড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় দু’জন। ঈশিতা ভট্টাচার্য ৬৮৪ নম্বর পেয়ে নবম হয়েছে। ওই স্কুলেরই ছাত্র অঙ্কুর ঘোষ ৬৮৩ পেয়ে দশম স্থান অধিকার করেছে। ঈশিতার বাড়ি অমরাগড়ে। বাবা সুব্রত ভট্টাচার্য কৃষক। মা সবিতাদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। অঙ্কুরও অমরাগড়ের বাসিন্দা। বাবা মানসবাবু জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ইঞ্জিনিয়ার। মা বৈশাখী ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গ্রাম পঞ্চায়েতে অস্থায়ী পদে চাকরি করেন। অঙ্কুরও ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here