দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ করোনার অত্যাচার এখনও শেষ হয়ে যায়নি বিশ্ব থেকে। আবার এক নতুন স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে ভারতে।আট দফা নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের, চিঠি রাজ্যগুলিকে  

করোনা মহামারী শুরুর ২ বছর পর চলতি বছরের ৩১ মার্চ থেকে কোভিড প্রোটোকলের যাবতীয় বিধিনিষেধ সরকারিভাবে তুলে নিয়েছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে এ ব্যাপারে প্রতিটি রাজ্যকে নির্দেশও পাঠানো হয়েছিল।

সাড়ে আটমাসের মাথায় ১৮ ডিসেম্বর ফের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে চিঠি পাঠিয়ে রাজ্যগুলিকে জানানো হল, কোভিড নিয়ম মেনে চলতে হবে। আট দফা নির্দেশিকা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পাঠানো চিঠিতে।

যার জেরে জোর চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে জনমানসে। আবার কী সেই মাস্ক, স্যানিটাইজারের দিন ফিরতে চলেছে? রাজ্যগুলিকে পাঠানো কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের চিঠি অন্তত তেমনই আভাস দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব সুধাংশ পন্থের সাক্ষর সম্বলিত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কোভিড সতর্কতায় প্রতিটি রাজ্যকে জেলাগুলিকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
ইতিমধ্যে কেরল এবং উত্তরপ্রদেশে কোভিডের নয়া সংক্রমণের হদিশ মিলেছে।

কেরলে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের এবং উত্তরপ্রদেশে একজনের। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, মৃতদের শরীরে কোভিডের সাব-ভেরিয়েন্ট জেএন.১ এর সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে ৩৩৫ জন রোগী কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৭০১।


সামনেই রয়েছে বড়দিনের উৎসব। তারপর নিউ ইয়ার। এ ব্যাপারে সতর্ক করে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন উৎসবে ভিড়ের দিকে বাড়তি নজরদারি রাখতে হবে। জনস্বাস্থ্যর দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে যাতে নতুন করে সংক্রমণ না ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমিত এলাকায় কোভিড নিয়ম ফের নিশ্চিত করতে হবে।

নিয়মিত জেলাভিত্তিক আক্রান্তদের রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। কোভিড পরীক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নির্দেশিকায়। বিশেষত, আক্রান্তের শরীরে কোভিডের নতুন কোনও সংক্রমণের নমুনা রয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


শুধু ভারত নয়, বিশ্বজুড়েই নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে করোনার নয়া ভেরিয়েন্ট। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। হাসপাতালগুলিতে বেড নেই। তথৈবচ হাল আইসিসিইউতেও। সংক্রমণ ঠেকাতে তাই ফের মাস্ক বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রক।

বিমানবন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে সকলের মাস্ক পরা এবং কোভিডের দুটি টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রক। সিঙ্গাপুরের দেখানো পথে হেঁটে মাস্ক বাধ্যতামূলক করেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া বিমানবন্দরেও।

একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় আগের মতো দূরত্ববিধি মেনে চলা, বারবার হাত স্যানিটাইজ করার আবেদন জানানো হয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকারের তরফে। নতুন করে কারও করোনা উপসর্গ দেখা দিলে ঘর থেকে না বেরোনোর পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। 

কোভিডের ভয়াবহ সময় অতিক্রম করে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে বিশ্ব। ফের নতুন করে করোনা ভাইরাস চোখ রাঙাতে শুরু করায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সর্বত্র। সংক্রমণ ঘিরে বাড়ছে আশঙ্কা। তাই সময় থাকতে নজরদারির ওপর জোর দিতেই রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র সতর্ক করল বলে মনে করা হচ্ছে।

জেএন.১। এটি হল ওমিক্রন সাব ভ্যারিয়েন্ট বিএ.২.৮৬-এর একটি মিউটেশন। সম্প্রতি কেরলে ৭৯ বছর বয়সি এক বৃদ্ধার শরীরে এই স্ট্রেনের হদিশ মিলেছে। শুধু এই নতুন ভ্য়ারিয়েন্টের খোঁজই নয়, সঙ্গে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলছে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য বলছে, দৈনিক সংক্রমণ আবার দু’হাজারের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। রবিবার পাঁচজনের মৃত্যুও হয়েছে। চারজন কেরলের। একজন উত্তর প্রদেশের।

সতর্ক রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি একটি অ্যাডভাইজ়রিও জারি করেছে। সেখানে সতর্ক করা হয়েছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস বিবর্তিত হচ্ছে এবং সব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিনিয়র এপিডেমিওলজিস্ট ডঃ মারিয়া ভ্যান কেরখোভ জানিয়েছেন, “জেএন.১-এর কারণে সবরকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে। উপসর্গহীন সংক্রমণ থেকে শুরু করে মারাত্মক অসুস্থতা এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। ঠিক যেমন ওমিক্রনের অন্যান্য সাবলাইনেজগুলির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে।”

গোটা বিশ্বেই করোনা পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ বাড়াতে শুরু করেছে। তালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মতো দেশগুলিও। সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি আবার মাস্ক ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া শুরু হয়েছে। পর্যটকদেরও কোভিড নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে সেখানে। এদিকে ভারতেও বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কর্নাটকে বয়স্ক মানুষদের ও কোমর্বিডিটি রয়েছে, এমন মানুষজনকে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কেরল সংলগ্ন রাজ্যগুলিকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকও। ইতিমধ্যে বেশ কিছু হাসপাতালে মক ড্রিলও হয়ে গিয়েছে।
জেএন.১ কতটা উদ্বেগের কারণ?


এক ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিবেক নাঙ্গিয়া জানিয়েছেন, “জেএন.১ হল একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট। ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চে যে ওমিক্রনের ঢেউ দেখা গিয়েছিল, এটি তারই একটি সাব ভ্যারিয়েন্ট। যখনই কোনও নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসে, সেটার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের মধ্যে থাকে না। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এটি হালকা উপসর্গ দেখাচ্ছে। কিন্তু যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা সবথেকে বেশি। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি, কিংবা যাঁদের ডায়াবেটিসের সমস্যা, হার্টের সমস্যা বা ক্যানসার রয়েছে। সামান্য অসুস্থতাও এক্ষেত্রে জীবন নিয়ে টানাটানি ফেলে দিতে পারে।”

বিশেষজ্ঞ পালমনোলজিস্ট চিকিৎসক বিবেক নাঙ্গিয়া আরও জানিয়েছেন, “আমাদের চারিদিকে এখনও কোভিড ১৯ রয়েছে এবং একটি বার বার ফিরে আসবে। এমন একটি ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে আমরা লড়াই করছি, যেটা সঙ্গে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম আগে কখনও মুখোমুখি হয়নি। তাই আমাদের অবশ্যই ভীষণ সতর্ক থাকা দরকার।”

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ল্যানসেট কমিশনের সদস্য চিকিৎসক সুনীল গর্গ বলছেন, “এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে একটি বিশাল জনসংখ্যার উপর প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রয়েছে এই ভ্যারিয়েন্টের।”

বড়দিনের উৎসবে মাতুন, কিন্তু সাবধানে
সামনেই বড়দিন। তারপর বর্ষবরণ। সঙ্গে এখন তো আবার বিয়ের মরশুমও চলছে। কিন্তু মাথায় রাখবেন, আকাশে-বাতাসে শুধু উৎসবের মেজাজই নয়, করোনার ভাইরাসও ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়দিনের উৎসবে হোক, কিংবা বিয়েবাড়িতে… ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন প্য়ানডেমিকের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা। তাই সবরকমভাবে সাবধান থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।

চিকিৎসক নাঙ্গিয়া বলছেন, “আবার সেই কোভিড-বিধি মেনে চলার সময় এসে গিয়েছে। সেই দিনগুলির কথা ভুলে গেলে চলবে না। কীভাবে গোটা দেশ ভাইরাসের কবলে পড়েছিল। এটি যাতে আবার সেই পর্যায়ে পৌঁছে না যায়, তার জন্য আগেভাগে এটাকে থামাতে হবে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখুন। মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ভিড় জায়গা এড়িয়ে চলুন। বিশেষ করে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁরা বেশি সতর্ক থাকুন।” একইসঙ্গে টিকাকরণের উপরেও জোর দিয়েছেন তিনি। চিকিৎসক নাঙ্গিয়ার মতে, “বছরের এই সময়টায় ইনফ্লুয়েঞ্জা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সেক্ষেত্রে বাড়তি সতর্ক থাকায় কোনও ক্ষতি নেই।”

জোর দিতে হবে নজরদারিতে
চিকিৎসক সুনীল গর্গের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি উভয়কেই আরও বেশি নজর দিতে হবে। তাঁর মতে, “কোভিড থাকবেই। ভাইরাসের বিবর্তনও হবে। অন্যান্য বিবর্তনগুলির তুলনায় এটিকে আরও বেশি করে নজরে রাখতে হবে। কারণ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেদ করার জন্য এর যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে।”

ওমিক্রনের এই নয়া ভ্যারিয়েন্টকে রুখতে বর্তমানে নজরদারিই সবথেকে আগে প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। বিশেষ করে, হাসপাতালগুলি যে কোনও পরিস্থিতির জন্য পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রেখেছে কি না, তার জন্য মক ড্রিল ভীষণভাবে প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।

করোনার নতুন কোনও ঢেউ আটকানোর জন্য শুরুতেই প্রত্যেককে ব্যক্তিগত স্তরে দায়িত্বশীল হওয়া দরকার বলে মনে করছেন চিকিৎসক নাঙ্গিয়া। তাঁর পরামর্শ, যদি কারও সর্দি-কাশি হয়, তাহলে নিজেদেরই উচিত পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে নিজেকে দূরে রাখা। এই সামাজিক দায়িত্ব প্রত্যেককে পালন করতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here