দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ঈশ্বরের পুজোর জন্য ফুল-পাতা আর জলের কথা বলা রয়েছে গীতায়। সেখানে প্রদীপ জ্বালানোর কথা বলা হয়নি। এখন সকাল ন’টা ও রাত ন’টা থেকে রামানন্দ সাগরের যে রামায়ণ নতুন করে সম্প্রচারিত হচ্ছে দূরদর্শনে সেখানেও দেখানো হচ্ছে মুনি-ঋষিরা যজ্ঞ করছেন। কেউ প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন না। তাই এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে যে কী ভাবে হিন্দু ধর্মে পুজোর অঙ্গ হয়ে উঠল প্রদীপ বা দীপ।

পুজোর সময় দেখা যায় যে আচমন, আসনশুদ্ধি, অঙ্গশুদ্ধি প্রভৃতির পরে ঈশ্বরকে আবাহন করে পাদ্য ও অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। তারপরে শুরু হয় পুজো। তাঁকে ভোগ দেওয়া হয়, তাঁর স্তব ও স্তুতি পাঠ করা হয় এবং শেষে বিসর্জন দেওয়া হয়। এর মাঝে আরতির সময় দীপ জ্বালানো হয়। কখনও পঞ্চপ্রদীপ, কখনও ১০৮ প্রদীপ আর কখনও কর্পূরদানিতে একটি মাত্র আগুনের শিখা। আবার পুজোর মাঝে আলাদা করে ধূপের পাশাপাশি দীপ দেখানো হয়।

বৈদিক যুগে হোমানলে ঘৃতাহুতি দিতেন মুনি-ঋষিরা। তার সঙ্গে চলত বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ। তখনও ঈশ্বর ছিলেন নিরাকার। দু’হাজার বছরেরও আগে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হতে থাকে ঈশ্বরের রূপ। যদিও আরও আগে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার মাটির ট্যাবলেটে এমন মূর্তি পাওয়া গেছে যা শিবের বলে মনে করা হয়।

নিরাকার ঈশ্বরের পুজোর পরে ধীরে ধীরে পাহাড়, নদী, গাছ প্রভৃতিকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করা শুরু হয়। মনে করা হয় সেই সময় অনেকেই বাড়ির বাইরে আলো জ্বালিয়ে রাখতেন যাতে রাতের বেলায় পথিক এসে আশ্রয় নিতে পারেন। পাহাড়ের পাদদেশে, নদীর কিনারে এমনকি গাছের গোড়াতেও পুজোর পরে প্রদীপ জ্বালানো শুরু হয়। সেই প্রথা দেখা যায় শহর ছেড়ে বেরোলেই। এখনও তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়ার চল রয়েছে হিন্দুদের মধ্যে।

যাঁরা শ্মশানে তপস্যা করেন তাঁরা শুরু করলেন ধুনি জ্বালিয়ে রাখতে। গৃহস্থরা আগুন রাখতে শুরু করলেন ঘরের কুলুঙ্গিতে। তবে প্রথম দিকে কুলুঙ্গিতে আগুন রাখা হত নিতান্তই প্রয়োজনের তাগিদে। সেই আগুন থেকে আগুন নিয়ে গিয়ে রান্নার কাজও হত। তখনও দেশলাই আবিষ্কার হয়নি।

রামায়ণ অনুযায়ী শ্রীরামচন্দ্র যখন রাবণকে বধ করে অযোধ্যায় ফেরেন তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় প্রদীপ। পুরো অযোধ্যা সেজে ওঠে আলোকমালায়। সেই ঐতিহ্য আজও বজায় রয়েছে অযোধ্যা নগরীতে। মনে করা হয় দীপাবলি বা দীপের উৎসব শুরু হয় তখন থেকেই। এখন তো দীপাবলিতে ঘরে ঘরে দীপ জ্বালানো হয়।

মৌর্য যুগে দীপ জ্বালানোর উদাহরণ পাওয়া যায়। দেখা গেছে তখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দীপ জ্বালাচ্ছেন সন্ধ্যাবেলায়। সেই দীপ তাঁরা জ্বালাচ্ছেন গৌতম বুদ্ধের উদ্দেশে।

প্রশ্ন উঠতে পারে খ্রিস্টানরা কেন মোমের বাতি জ্বালান, বৌদ্ধরা জ্বালান ঘিয়ের প্রদীপ আর হিন্দুরা তেলের। আবার হিন্দুরা আজও কেন হোমের সময় ঘি আহুতি দেন? হিন্দু ধর্মে যখন প্রদীপ জ্বালানো শুরু হল তখন যাঁর ঘরে যে জ্বালানি পাওয়া যেত তিনি তাই দিয়েই দীপ জ্বালাতেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে ব্রাহ্মণ ও গোয়ালারা জ্বালাতেন ঘিয়ের প্রদীপ, কলুরা জ্বালাতেন তেলের প্রদীপ। এছাড়া অন্যরা সামর্থ্যমতো তেল কিনে দীপ জ্বালাতেন। সেযুগে খনিজ তেল পাওয়া যেত না বলেই কেরোসিনে প্রদীপ জ্বালানো হত না। এখনও হয় না স্রেফ সংস্কারের বশেই। একই কারণে কেউ জ্বালান মোমের বাতি। ধীরে ধীরে যখন পুজোর অঙ্গ হয়ে উঠল প্রদীপ তখন তাতে দেওয়া শুরু হয় সবচেয়ে শস্তায় পাওয়া জ্বালানি তেল। সরষের তেল ও রেড়ির তেল। এখন রূপচর্চার সুবাদে রেড়ি দামি হয়ে যাওয়ায় আর রেড়ির তেলে প্রদীপ জ্বালাতে দেখা যায় না।

খ্রিস্টানরা বড়দিনে বাতি জ্বালান আবার সবেবরাতে মুসলমানরা আলোয় সাজান বাড়ি। ইহুদিদের মধ্যেও বাতি জ্বালানোর চল রয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে আগুনের সম্পর্ক সব ধর্মেই কম-বেশি রয়েছে।

আজ রবিবার রাত ন’টায় বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দীপ জ্বালাতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করছেন তাঁদের মনোবল বাড়াতে দেশের মানুষকে তিনি আহ্বান করেছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজোড়া লকডাউনের মধ্যে অকাল দীপাবলি হবে কিনা এখনই বলা যাবে না তবে একথা বলাই যায় যে কয়েক হাজার বছর ধরে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে দীপ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here