‘মাঘমন্ডল’ পূর্ববঙ্গের এক কুমারী ঐতিহ্য। মাঘ মাসে পালিত হয় এই ব্রত। পাঁচ বৎসরের জন্য কুমারী মেয়েদের সূর্য-উপাসনা। ব্রতের দু’টি মূল কাজ — পঞ্চগুঁড়ির রঙ্গিন আলপনা আঁকা আর ‘বারৈল’ বা ‘লাউল’ নামে মাটির প্রতীক নির্মাণ। এরপর ফুল-দূর্বা দিয়ে প্রতীকটিকে সাজানো হয়; তারপর পুজো করা হয়।

মাঘমন্ডল ব্রতে উঠোনে আঁকা হয় ব্রতমন্ডল; উপরে গোলাকার সূর্য, আর নীচে অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রকলা; মাঝে অয়ন-মন্ডল। অয়ন-চিহ্নের সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায়, কত বছর ধরে কুমারীর ব্রত চলছে। আমার মা’র বাপের বাড়ি গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, “এক বছরে এক গোলের আলপনা, দু’ বছরে দু গোলের। এক গোলের গায়ে আর একটি বৃত্ত দাগা…তিন বছরে তিনটি বৃত্ত, চার বছরে চারটি — আর পাঁচ বছরে পরপর রেখা টানা পাঁচটি বৃত্তের প্রকান্ড একটা আলপনা”।

এই ব্রতে পিটুলি গোলার আলপনা দেওয়া হয় না, দিতে হয় চালের গুঁড়ির সঙ্গে হলুদ, সিঁদুর, ধানের পোড়ানো তুষ, শুকনো বেলপাতার গুঁড়ো মিশিয়ে। সব রঙিন আলপনা। রোজই দেওয়া হয় এই আলপনা। দু’ আঙুলের টিপে গুঁড়ি নিয়ে আঙুল নাড়িয়ে ঝুরঝুর করে ফেলে আঁকা হয় লতাপথ। পৌষের সংক্রান্তির পরদিন থেকে মাঘের সংক্রান্তি পর্যন্ত চলে এই ব্রত।

‘হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান’ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখছেন, “প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করিয়া ব্রতিনীকে দূর্বাগুচ্ছের সাহায্যে চোখে ও মুখে জল ছিটাইতে হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘চউখে মুখে পানি দেওয়া’। সূর্য উঠিলে পাঁচালি গান করিয়া ‘বারৈল’ ভাসান হয়।…বারৈল দুইটিকে ফুল দূর্বা দিয়া সাজাইয়া একখানি ছোটো তক্তার উপর বসাইয়া পুষ্করিণীর জলে ভাসাইতে হয়। ইহার পর মন্ডলের উপর ফুল দিতে হয়। পাঁচালিতে সূর্যের পূর্বরাগ ও বিবাহের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।”

গ্রামের কিশোরীরা কাকভোরে কাঁথা জড়িয়ে ঘন কুয়াশা ঠেলে তাদের মা, দিদা-ঠাকুমার সঙ্গে গাঁয়ের ঝোপ ছাড়িয়ে, শিশিরে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে চলে যায় ঘাটলায়। কে আগে ঘাটে যাবে যেন তার প্রতিযোগিতা। জলের কাছে ঘাটে রাখা হয় ‘বারৈল’ বা ‘লাউল’। তার সর্বাঙ্গ অতসী, টগর, কলকে, গাঁদা বা বুনো ফুলে ঢাকা। লাউলের গা দেখা গেলেই দোষ। আগের রাতে সাজিয়ে রাখা হয় লাউল।

কিশোরীরা একসঙ্গে সুর করে গায় ব্রতের ছড়া; সূর্যকে স্বাগত জানানোর মন্ত্র, “উঠো উঠো সূর্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া,/ না উঠিতে পারি মোরা শিশিরের লেইগা।” সূর্য উঠবেন, তাই তার পথ প্রশস্ত করতে কিশোরীরা সাজির ফুল জলে ছুঁড়ে সুর করে গায়, “খুয়া ভাঙ্গি খুয়া ভাঙ্গি এ্যাচলার আগে,/ সকল খুয়া গেল বড়ই গাছটির আগে।” ধীরে ধীরে বড়ই বা কুল গাছের মাথা পরিষ্কৃত হয়ে কুয়াশা দূরীভূত হয়, সূর্য ওঠে, তার আলোকিত করুণায় পৃথিবী সচল হয়। ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ গ্রন্থে স্বামী নির্মলানন্দ লিখছেন, “তিনি উদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতি, সুরি, তিলি, মালী সকলকে জাগিয়ে তোলেন, সকলের গৃহই তিনি আলোকিত করেন, তখন প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্যে ব্রতী হয় — সমগ্র জগৎ কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ বধূ উপবীত, তন্তুবায় বধূ বস্ত্র, কর্মকার বধূ মাল্যাদি সরবরাহে ব্যস্ত হয়। ব্রতের ছড়ার ভিতরে এ দৃশ্যের এক চমৎকার বর্ণনা পরিস্ফুট। সামাজিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের একটা পরিষ্কার ছবি কুমারীদের অন্তরে স্বতঃ জাগ্রত হয়। ব্রতের ছড়ার মধ্যে এ রকম অনেক শিক্ষাই আছে।”


এই ব্রতের সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয়টি দেখানো হয়েছে চন্দ্রকলার সঙ্গে সূর্যের বিবাহানুষ্ঠানের প্রসঙ্গে। মাধবের কন্যা অপরূপ লাবণ্যবতী তন্বী-বালা চন্দ্রকলা। তাকে দেখে, তার রূপে সূর্য পাগল হয়ে বিয়ে করতে চান। ছড়ায় দেখতে পাই,
“চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া ছিলেন কেশ।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর ফিরেন নানা দেশ।।
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া দিছেন শাড়ি।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর ফিরেন বাড়ি বাড়ি।।
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা গোল খাড়ুয়া পায়।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর বিয়া করতে চায়।।”
সূর্যের মত এক পাত্র পেলে মাধবের আপত্তি থাকার কথা নয়, তাই সুসম্পন্ন হয়ে গেল তাদের শুভবিবাহ। সূর্য পেলেন অজস্র দান সামগ্রী। কী নেই তাতে; আর হবেই বা না কেন? মাধব যে লক্ষ্মীপতি! অতএব বিয়ের পর চন্দ্রকলা চললেন পতিগৃহে; আর এখানেই দেখানো হয়েছে বিচ্ছেদ আর মিলনের বেদনা-সুখের আনন্দঘন মুহূর্ত, পল্লী বাংলার চিরায়ত আবেগসঞ্চার। ব্রতিনীদের জীবনেও আসবে এই দিন; মা-বাবা-ভাই-বোন, প্রিয়জন, ক্রীড়াসহচরীদের ছেড়ে যেতে হবে স্বামীগৃহে। আবার মিলনসুখ অপেক্ষা করছে সেখানে, মিলনানন্দের আবেগ, লোকলাজ — সব মিলিয়ে এ এক দুঃখ-সুখের যুগলবন্দী!

মাঘমন্ডল ব্রতের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন-অঙ্কে বিভক্ত ব্রতের ছড়ার অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন,”এই মাঘমন্ডল-ব্রতের প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে যে সূর্য যা, তাঁকে সেই-রূপেই মানুষে দেখছে এবং বিশ্বাস করছে যে, জলের ছিটায় কুয়াসা ভেঙে দিলে সূর্য-উদয়ের সাহায্য করা হবে। এখানে কামনা হ’ল সূর্যের অভ্যুদয়। ক্রিয়াটিও হ’ল কুয়াসা ভেঙে দেওয়া ও সূর্যকে আহ্বান। দ্বিতীয় অংশে চন্দ্রকলাকে দীর্ঘকেশ গোল-খাড়ুয়া-পায়ে একটি মেয়ে এবং সূর্যকে রাজা বর এবং সেই সঙ্গে সূর্যের মা ও চন্দ্রকলার বাপ কল্পনা করে মানুষের নিজের মনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি যে-সব ছবি আছে, সূর্যের রূপকের ছলে সেইগুলোকে মূর্তি দিয়ে দেখেছে। তৃতীয় অংশে সূর্য-পুত্র বা রায়ের পুত্র রাউল বা লাউল, এক-কথায় বসন্তদেব; টোপরের আকারে এঁর একটি মূর্তি মানুষে গড়েছে, এবং সেটিকে ফুলে সাজিয়ে মাটির পুতুল হালামালার সঙ্গে বিয়ের খেলা খেলেছে। এখানে কল্পনার রাজ্য থেকে একেবারে বাস্তবের রাজ্যে বসন্তকে টেনে এনে, মাটির সঙ্গে এবং ঘরের নিত্যকাজের এবং খুঁটিনাটির মধ্যে ধরে রাখা হলো”।


লাউল বা লালুর বিয়ে করতে যাবার ছড়াটি খুব মনোরম।
“জলের মধ্যে ছিপছিপানী কিসের বাদ্য বাজে,
চান্দের বেটা লাউল্যা আজ বিয়া করতে সাজে।
সাজোরে সাজোরে লাউল্যা সোনার নূপুর দিয়া,
ঘরে আছে সুন্দরী কন্যা তুইল্যা দিমু বিয়া।” লাউল বউ নিয়ে আসে; বিয়ের ভোজে সূর্য গামছা মাথায় দিয়ে অন্দরমহলে তদারকি করছেন। ‘ঝিকুটি’ খেলতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে কিছু টাকা, তা দিয়ে লাউলের বউকে শাঁখা কিনে দেওয়া গেল। রইল কিছু, তা দিয়ে ব্রতিনীর মায়ের শাখাও হল, সব কুমারীরা নিজের মাকে শাঁখা পড়ান –“লাউল্যার বউরে শাঁখা দিয়া বেশি হইল টাকা/
সেই টাকা দিয়া দিলাম মায়েরে শাঁখা।”


মাটির সঙ্গে সূর্যের ছেলে বসন্তদেব বা লাউলের বিয়ে আর মিলনের পালাও শেষ। ঋতুরাজ পৃথিবীকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তাকে যেতেই হবে, একলাই, আবার শীতের মধ্যে বসন্ত হয়ে ফিরবেন, এখন বিদায়। কিন্তু মেয়েরা বৃথাই তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে — “কৈ যাওরে লাউল গামছা মুড়ি দিয়া?
তোমার ঘরে ছেইলা হইছে বাজনা জানও গিয়া।
ধোপা জানাও গিয়া, নাপিত জানাও গিয়া, পরুইত জানাও গিয়া।” লাউলের ছেলের নাম রাখার অনুষ্ঠান — “লাউলের ঘরে ছেইলা হইছে কি কি নাম-থুমু?/আম দিয়া হাতে রাম নাম থুমু।/বরই দিয়া হাতে বলাই নাম থুমু।/কমলা দিয়া কমল নাম থুমু।/জল দিয়া জয় নাম থুমু।/রাজার বেটা রাজার ছেইলা রাজা নাম থুমু।”


কিন্তু লাউলকে যেতেই হবে। মধুমাস শেষ, বৈশাখের মেঘ দেখা দিল, মেঘ গর্জন করে উঠলো, ঝড় বইলো, উৎসবের সাজ-সরঞ্জাম লন্ডভন্ড করে ভেঙ্গে পড়ল ফুলে-ভরা জইতের ডাল। ঋতুরাজকে বিদায় দিতেই হল — “আজ যাও লাউল,/কাল আইসো।/নিত নিত্য দেখা দিও।/বছর বছর দেখা দিও।”

অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে দেখা যায় মৎস্যজীবী মালো মেয়েরা নিষ্ঠা ভরে মাঘমন্ডলের ব্রত করছে। মাঘমাসের প্রতিদিন সকালে কুমারী মেয়েরা স্নান করে ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জলে সিঁড়ি পুজো করে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র আওড়ায়। বিবাহের কামনাতেই এই ব্রত। ব্রতের শেষদিন তৈরি হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি, সেই চৌয়ারি মাথায় করে ভাসানো হয় তিতাসের জলে। অক্ষত চৌয়ারির দখল নিতে কিশোরেরা হুল্লোড় করে ওঠে। উঠোন জোড়া আলপনার মাঝে কিশোরী ছাতা মেলে বসে, তার মা ছাতার উপর ছড়িয়ে দেয় খই-নাড়ু, আর তা কাড়াকাড়ি করে খায় কিশোরেরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here