দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ করোনা-সংকটের মধ্যেই নবান্ন ও রাজভবন সংঘাত যে চরমে পৌঁছতে চলেছে তার সিঁদুরে মেঘ গত কয়েক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত হলও তাই। শুক্রবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দ্বিতীয় কিস্তিতে যে জবাব দিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, তাতে সমালোচনা, শব্দচয়ণ ও বিশেষণ এক কথায় বেনজির। রাজ্যপালের স্পষ্ট অভিযোগ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে তাঁর সরকারের ব্যর্থতা থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।

রাজ্যপালের কথায়, আপনার তোষণনীতি এতটাই বেআব্রু ও দৃষ্টিকটু যে নিজামুদ্দিন মার্কাজ নিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করায় আপনি বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করবেন না।’

এমনকি চিঠিতে রাজ্যপাল এও লিখেছেন, “যাঁদের একটু সাহস রয়েছে, তাঁদের বলুন আপনাকে আয়না দেখাতে। এই সংকটের পরিস্থিতিতে মাইক, ঝাঁটা হাতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘুরে বেড়ানো কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে। এই মুহূর্তে আসল কাজ ও সুশাসন দরকার, নাটক বা রাজনীতি নয়।”

রাজভবন নবান্ন শঠে শাঠ্যং কমবেশি চলছিলই। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার তা নতুন মাত্রা পায়।

রাজ্যপালকে চিঠি লিখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আমি এক জন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। আর আপনি একজন মনোনীত রাজ্যপাল। এর আগে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে যে সব চিঠি ও টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, তার ভাষা নিয়েও ধনকড়ের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো একটি এসএমএসে রাজ্যপাল লিখেছিলেন, ‘এটা কারও জমিদারি নয় যে তাঁর খেয়ালখুশি মতো চলবে’। যা দেখে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই ভাষাকে অসংসদীয় বললেও কম বলা হয়। কোনও রাজ্যপালের থেকে এই ভাষা কখনওই প্রত্যাশিত নয়।

তার পর বৃহস্পতিবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে প্রাথমিক জবাব দেন ধনকড়। শুক্রবার সকালে ফের দ্বিতীয় কিস্তির জবাব দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। জবাবে গতকাল পাঁচ পাতার চিঠি পাঠিয়েছিলে রাজ্যপাল। শুক্রবারের চিঠি আবার সাত পৃষ্ঠা লম্বা।

মুখ্যমন্ত্রী লেখা চিঠিতে এদিন থমাস ফুলারের এক উক্তি স্মরণ করাতে চেয়েছেন একদা দুঁদে আইনজীবী জগদীপ ধনকড়। তিনশো বছর আগে ফুলার লিখেছিলেন, “তুমি যতই সুউচ্চ হও, আইন তোমারও উপরে।” ধনকড়ের কথায়, আশা করি এই শাশ্বত কথাটিকে আপনি গুরুত্ব দেবেন। রাজ্যপাল বলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাজ হল সংবিধান সম্মত পথে চলা, আর আমার কাজ হল সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখা। সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপালের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে তার অবমাননা করেছেন আপনি। নাগরিকত্ব আইনে প্রতিবাদের সময় মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রসঙ্গে তত্ত্বাবধানে যে ভোটাভুটির দাবি করেছিলেন সেই প্রসঙ্গও এখানে তুলে এনেছেন ধনকড়।

রাজ্যপালের কথায়, এ রাজ্যের মানুষ যাঁকে সম্মানের সঙ্গে ‘দিদি’ বলে ডাকেন, তাঁর কাছ থেকে এই সংকটের সময় তাঁদের এটাই প্রাপ্য। চিকিৎসকদের আটটি সংগঠন পরামর্শ দিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সে কথা শোনা হচ্ছে না। ‘আপনি যে ভাবে সব ঢাকা চাপা দিতে চাইছেন, তার পরিণতি খুবই যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।’ এমনকি আইসোলেশন ওয়ার্ডে মোবাইল ফোন বন্ধ করা হয়েছে। অথচ করোনা সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে যত ছবি উঠে আসবে ততই ভাল। তাই রাজ্যের মানুষের কথা ভেবে আপনার রাজনৈতিক অ্যান্টেনা নামিয়ে রাখুন, সংঘাতের পথ ছেড়ে কাজ করুন।

স্মরণকালের মধ্যে রাজভবন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের উদ্দেশে এত কড়া চিঠি পাঠানো হয়েছে কিনা হয়তো অনেকেই মনে করে বলতে পারবেন না।

এখন প্রশ্ন হল, এর পরিণতি কী হতে পারে। তা কোন দিকে এগোচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব দেখে বোঝা যাবে। নবান্ন যদি আগের মতো রাজ্যপালের এই চিঠিকে উপেক্ষা করে, তা হলে একতরফা রাজ্যপালের পক্ষে তা জিইয়ে রাখা মুশকিল। কিন্তু নবান্ন পাল্টা কড়া জবাব দিলে সংঘাতের তীব্র অনিবার্য ভাবেই বাড়বে। তাই এখন দেখার নবান্ন কী অবস্থান নেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here