দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ২০১১ সালের ২১ জুলাই। কলকাতায় তৃণমূলের শহিদ স্মরণ। ততদিনে পালাবদল হয়ে গিয়েছে। বামফ্রন্টকে সরিয়ে শাসনক্ষমতায় তৃণমূল। 

ওই সভার আয়োজন করেছিল যুব তৃণমূল কংগ্রেস। ওই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। অভিযোগ, তাঁর বদলে সভা পরিচালনার জন্য তাঁর হাত থেকে মাইক নিয়ে নেন কুণাল ঘোষ। এই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তিনি ওই ঘটনায় অপমানিত হয়েছিলেন৷

অধিকারী পরিবারের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তৃণমূল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে এ রাজ্যে দুটি জেলায় জিতেছিল। তার মধ্যে একটি পূর্ব মেদিনীপুর। আর ওই জেলায় অধিকারীদের প্রভাব রয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ও তাঁরা ভোটে জিততেন। অধিকারীর পরিবারের দু’জন সাংসদ। বাবা শিশির এবং ভাই দিব্যন্দু। দিব্যেন্দু কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্য়ানও। ওই জেলার বিধায়কদের বেশির ভাগই শুভেন্দুর সঙ্গে রয়েছেন বলে বলা হয়। শুভেন্দুর এই সিদ্ধান্তে বাবার মত ছিল না বলেই খবর। বলা হয়, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ওই জেলা থেকে যে বাম প্রার্থীরা জিতেছিলেন, তাতে শুভেন্দুর সাহায্যে রয়েছে। তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের নির্বেদ রায়কে হারতে হয়েছিল সেই কারণে।

তাঁকে বলা হয় ‘নন্দীগ্রামের নায়ক’। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ফলে তৃণমূলের উত্থান, তার নেপথ্যে শুভেন্দুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। সে-সব এখন অতীত।

বলা হয়, শুভেন্দু নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার মনে করেন। তিনি মনে করেন, তিনি ওই পদে তিনি যোগ্য। ভোট বিশেষজ্ঞ, তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর তাঁকে বোঝাতে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের নেতৃত্ব পছন্দ নয় তাঁর।

পূর্ব মেদিনীপুরে তাঁর দাপট ছিল এবং আছে, সন্দেহ নেই। এরপর তিনি নজর দেন পশ্চিম মেদিনীপুরে। রাজনৈতিক মহলের মতে, তাঁর দাপটে ‘নিয়ন্ত্রণ’ ধরে রাখতে দল থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া অন্য দল ‘ভাঙানো’র কাজে ৷

কী বললেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ:

বিজেপিতে আসতে চাইলে তাঁকে স্বাগত জানানো হবেন। শুভেন্দুর মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগের একঘণ্টার মধ্যেই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের। সেইসঙ্গে তৃণমূলের উদ্দেশ্যে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, এবারও ওই দলের শেষের শুরু।

কী বললেন মুকুল রায়:

শুভেন্দু অধিকারী যে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে পারেন সে ব্যাপারে সন্দেহ গত প্রায় এক মাস ধরে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। শুক্রবার শুভেন্দু মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়া মাত্রই তাঁকে বিজেপিতে যোগ দিতে আহ্বান জানালেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়।
মুকুলবাবু বলেন, “শুভেন্দু তৃণমূল স্তর থেকে রাজনীতি করছে। গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসে নেতা হয়েছে। ও আমাদের সঙ্গে এলে বাংলায় পরিবর্তনের আন্দোলন আরও জোরদার তথা শক্তিশালী হবে।” তাঁর কথায়, “শুভেন্দুর ব্যাপারে বিজেপির সর্ব ভারতীয় নেতৃত্ব অবগত রয়েছেন। যে হেতু ও গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে তাই ওঁর জনভিত্তি রয়েছে। আমি ওকে বিজেপিতে আহ্বান জানাচ্ছি।”
বস্তুত শুভেন্দুর ইস্তফা পত্রে তৃণমূলের অন্দর যেমন আন্দোলিত হয়ে গিয়েছে, তেমনই বাংলায় তামাম বিরোধী শিবির উচ্ছ্বসিত। তা সে বিজেপিই হোক বা বাম ও কংগ্রেসের নেতারা। কারণ, তাঁরা মনে করছেন, এর ফলে একুশের ভোটে তৃণমূল জবরদস্ত ধাক্কা খেতে পারে।

দিলীপ ঘোষ আরও কী বললেন:

এদিন দিলীপ ঘোষ বলেন,  “দেখুন আগে থেকেই সূচনা আসছিল, শুভেন্দুবাবু পার্টি ছাড়তে পারেন, গুঞ্জন চলছিল। আর এটা হওয়ারই ছিল। কারণ ওই দলে থাকার মতো পরিবেশ নেই। আমি বলেছিলাম মুষলপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের। এটা শেষের শুরু হল তৃণমূলের। দলটাই উঠে যাবে, কারণ যেভাবে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে এই দল চলছে তা পশ্চিমবঙ্গের মতো গণতাণন্ত্রিক প্রিয়া রাজ্যে তা কাম্য নয়। আমাদের লোকেরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। অর্জুন দা বলেছেন , ৫ জন সাংসদ নাকি দলে আসতে চান। নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেছেন। মিহির গোস্বামী শুনলাম দিল্লি গিয়েছেন, সেখানে নাকি আনুষ্ঠানিক ভাবে দলে যোগ দিতে পারেন। যাদের ওখানে দমবন্ধ করার মতো পরিস্থিতি ছিল, তারা আগে থেকেই সূচনা ও সংকেত দিচ্ছিলেন। এখন ছাড়তে শুরু করেছেন। শুভেন্দুবাবু যদি আমাদের দলে যোগ দিতে চান, নিশ্চয়ই তাকে আমরা দলে নেব। আমি নিশ্চয়ই ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু এখনও ওনার সঙ্গে কোনওরকম কথা হয়নি এখনও পর্যন্ত। শুভেন্দুবাবু এবার যদিও ওই দল ছাড়েন, তাহলে ওনার মতো  অনেকে এমন যুব নেতা রয়েছেন, যারা বাংলার জন্য লড়াই করেছেন তারাও ওই দল ছাড়বেন। তৃণমূলের সংগঠন বলে কিছু নেই। এটা একটা মেলা, সার্কাস পার্টি। মালিক আছে, ডিরেক্টর-প্রোডিউসার আছেন। বাকিরা সবাই কর্মচারী। যারা সম্মানের সঙ্গে ওখানে কাজ করতে পাচ্ছেন না, বিজেপিতে যোগ দিন, আমরা তাদের স্বাগত জানাব৷

প্রসঙ্গত, রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরেই দূরত্ব বাড়ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। শুক্রবার তিনি মন্ত্রীপদ থেকেই ইস্তফা দিয়ে দেন। তার পরেই রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল জল্পনা।

আজই বিজেপি’তে যোগ দিচ্ছেন তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী:

জল্পনার অবসান। বিজেপিতেই যোগ দিতে চলেছেন কোচবিহার দক্ষিণের  তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী৷বৃহস্পতিবার তিনি বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের সঙ্গে দিল্লি পৌঁছান। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে শুক্রবারই বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিতে পারেন মিহির গোস্বামী।

দলের উপর অসন্তোষ

কয়েকদিন আগে দলের উপর একাধিক বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগেই তিনি নিশীথ প্রামাণিকের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎও করেছিলেন। তখন থেকে জল্পনা চলছিল বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন এই তৃণমূল বিধায়ক । ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়, তখন থেকে তিনি দলের সদস্য ছিলেন৷

ইন্ডিয়া টুডেকে ফোনে বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক জানান, দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মিহিরবাবুর কথা হয়েছে। আজকেই তাঁকে দলের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই তিনি দলে যোগ দেবেন। জানা গিয়েছে, ৬৭ বছরের বয়স্ক তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী আপাতত সেখানে বিজেপি সাংসদের বাসভবনেই রয়েছেন।

তৃণমূলের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়ে গেল, শুভেন্দু ইস্তফা দিতেই বললেন অধীর:কেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রিসভা থেকে শুভেন্দু অধিকারীর ইস্তফা নিয়ে যখন তোলপাড় তৃণমূল, তখন বাংলার শাসকদল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাইলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী।
এদিন অধীরবাবু বলেন, “তৃণমূলের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হল।” তাঁর কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাপুড়ের মতো বিজেপিকে বাংলায় ডেকে এনেছিলেন। বিজেপি বহিরাগত ওঁর মুখে মানায় না। ঠিক যেমন সাপুড়েকে সাপের ছোবলে মরতে হয়, তেমনই তৃণমূলের ললাটে লেখা রয়েছে।”
বাম-কংগ্রেস নেতারা প্রায়ই বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই বাংলায় গেরুয়া বাহিনী জমি শক্ত করেছে। এদিন সে কথাটাই আরও রূঢ় ভাবে বললেন লোকসভায় কংগ্রেস নেতা। তাঁর কথায়, “বিজেপির সঙ্গে মন্ত্রিসভায় ছিল কেন? গোধরায় দাঙ্গার পরেও কে বিজেপির সঙ্গে থেকে এনডিএ-তে থেকে গিয়েছিল? কে কথায় কথায় লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে, অফিসে ছুটে যেতেন? মানুষ কি ভুলে গেছে মনে করেছেন!”

বহরমপুরের সাংসদ আরও বলেন, “শুভেন্দুকে তৃণমূল কখনও মর্যাদা দেয়নি। স্রেফ কাজ করিয়ে নিয়েছে। আমি নন্দীগ্রামে গিয়ে দেখেছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুভেন্দু আন্দোলন করেছিলেন।”
এ ব্যাপারেও রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের সমালোচকরা বারবার মাওবাদী নেতা কিষেনজির উদাহরণ টানেন। বলেন, যে কোটেশ্বর রাওরা জঙ্গলমহলে তৃণমূলকে বাড়তে সাহায্য করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেই এনকাউন্টার ঘটে যায়। অনেকে বলেন, “এটাই তৃণমূলের স্বভাব। কজের বেলা কাজি, কাজ ফুরোলে কিষেনজি।”

অধীরবাবু এও বলেন, “শুভেন্দু অধিকারী না থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন না।”
রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, অধীরবাবুর এ কথা অমূলক নয়। কারণ দুই মেদিনীপুর সহ পশ্চিমাঞ্চলে সেই সময়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অকুতোভয় নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলে শুভেন্দু।
কিন্তু শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পুরোধা নেতা যে তৃণমূল ছাড়ছেন তা হয়তো অনিবার্য। এরপর? তিনি যদি বিজেপিতে যান তাহলে কংগ্রেসের এত উচ্ছ্বাস কীসের?
এই প্রশ্নের জবাবে অধীর চৌধুরী স্পষ্ট করে বলেন, “শুভেন্দু কোথায় যাবেন সেটা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তৃণমূল যে ধুলিসাৎ হয়ে যাবে সন্দেহ নেই। আর বাম-কংগ্রেসের এই জোট থাকবে। এবং আরও মজবুত ও শক্তিশালী হবে।”

কী বলেছিলেন মিহির গোস্বামী

বৃহস্পতিবারই মিহির গোস্বামী বলেন, তাঁর পক্ষে তৃণমূলে কাজ করা অসম্ভব। কারণ তিনি এতো অবমাননা আর সহ্য করতে পারবেন না। নিজের দলের বিরুদ্ধেই একরাশ ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে জানিয়েছিলেন বর্তমান দলে তিনি অবমাননা ও বঞ্চিতের শিকার। ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ে তিনি দলের সুপ্রিমোর কাছে বিষয়টি পৌঁছেও দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও কিছু বদল হয়নি। সমস্ত সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করে যায়। এই তৃণমূল সেই দল নয়, যে দলে আমি কয়েকবছর আগে যোগ দিয়েছিলাম। 

দিনকয়েক ধরে জল্পনা চলছি প্রবীণ এই তৃণমূল নেতা গেরুয়া শিবিরে যোগ দিতে পারেন। কয়েক সপ্তাহ আগে নিশীথ প্রামাণিকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পরেই সেই জল্পনা আরও প্রবল হয়। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজকেই দলের সদর দফতরে বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নিতে পারেন মিহির গোস্বামী। নিশীথ প্রামাণিকও আগে তৃণমূলে ছিলেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দেন। কোচবিহার থেকে জিতে তিনি সাংসদও হন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here