দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শহিদ মিনারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে ঝাঁঝ দেখিয়েছিলেন অমিত শাহ, মঙ্গলবারের ভার্চুয়াল সভাতেও হুবহু এক। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, রাজনৈতিক হিংসার সঙ্গে আয়ুষ্মান ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী কৃষক কল্যাণ যোজনা নিয়ে দিল্লির বিজেপি সদর দফতর থেকে দিদির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানালেন শাহ। বললেন, গরিব মানুষকে তাঁদের অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত করছেন মমতা দিদি? রাজনীতি করার অনেক জায়গা রয়েছে। আপনি শনিবার কৃষকদের নামের তালিকা দিন, কথা দিচ্ছি সোমবার তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দিয়ে আয়ুষ্মান ভারতের প্রচার হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে উনিশের ভোটের আগেই সেই প্রকল্প থেকে বাংলার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল নবান্ন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “ওরা ৪০ শতাংশ টাকা দিয়ে ছবি লাগিয়ে রাজনীতি করতে এসেছে। আমার দরকার নেই ওই টাকার। বাংলার মানুষ কি ভিখিরি নাকি!” আয়ুষ্মান প্রকল্পের পরিবর্তে বাংলায় স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পই বহাল রয়েছে।

এদিন অমিত শাহ বলেন, “আগে গরিব মানুষের অসুখ হলে ঈশ্বরের নামে ছেড়ে দিতেন। এখন তাঁরা নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পাঁচ লক্ষ টাকার বিমার সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলার মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পাছে নরেন্দ্র মোদী লোকপ্রিয় হয়ে যান তাই মমতা দিদি ওই প্রকল্প বাংলায় বাস্তবায়িত হতে দেননি।” বিজেপি নেতাদের কথায়, তৃণমূল সরকারের স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের সুবিধা কিন্তু রাজ্যের সব গরিব পান না। অথচ আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে সেই সুবিধা রয়েছে।

কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বছরে ছ’হাজার টাকা করে দেওয়ার কেন্দ্রীয় প্রকল্পও বাংলায় বাংলায় বাস্তবায়িত হয়নি। রাজ্য সরকার আলাদা করে কিছু টাকা দেয়, তবে তা কেন্দ্রের যোজনার তুলনায় অনেক কম। বিজেপির অভিযোগ, স্রেফ রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলার কৃষক এবং সাধারণ মানুষকে এই সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। সেই প্রসঙ্গেই অমিত শাহ এদিনের ভার্চুয়াল জনসভায় বলেন, “দিদি, আপনি শনিবার তালিকা দিন, কেন্দ্র সরকার সোমবার কৃষকদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে।”

বাংলার সাড়ে তিন কোটি মানুষ জনধন যোজনার অ্যাকাউন্টের সুবিধে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন শাহ। একই সঙ্গে তিনি বলেন, এ রাজ্যের প্রায় কোটি পরিবারের উজ্জ্বলা যোজনায় বিনামূল্যে গ্যাস পৌঁছে যাচ্ছে। সে জন্য ১১০০ কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্র। তা ছাড়া ৩০ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিকের জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।

প্রসঙ্গত, এই কোভিড-১৯ পর্বে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের ৫০ লক্ষ টাকার জীবন বিমা দিচ্ছে মোদী সরকার। কিন্তু বাংলার চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। রাজ্য সরকার যে ১০ লক্ষ টাকার বিমা দিচ্ছে সেটাই পাচ্ছেন তাঁরা।

এদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “বাংলায় আর ক’মাস পরে বিধানসভা ভোট। বাংলার জনগণ পরিবর্তনের প্রহর গুনছেন। বিজেপি সরকার গড়বেই। আর বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে বাংলায় আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প কার্যকর হবে।”

এদিনের অমিত শাহের বক্তৃতা নিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই হচ্ছে বিজেপি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর ঘূর্ণিঝড়ে যখন রাজ্যের মানুষ বিধ্বস্ত, তখন দিল্লি থেকে ভোটের ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে। বাংলার জনগণ দেখছেন, কারা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে আর কারা মানুষের পাশে থাকে।”

‘মমতা দিদি এবার আটকে দেখান’

হালফিলের বাংলার রাজনীতিতে সে দিনটা ছিল মাইলফলক। ২০১৯-এর ১৪ মে। লোকসভা ভোটের আগে ধর্মতলা থেকে অমিত শাহর মিছিল শুরু হয়েছে। তার পর সেই জনস্রোত কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছতেই ধুন্ধুমার। বিদ্যাসাগর কলেজের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তি ভাঙচুর। বাংলার রাজনীতির রসায়ন বুঝি সেদিনই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন বিজেপির তৎকালীন সভাপতি।

মঙ্গলবার বাংলায় তাঁর প্রথম ভার্চুয়াল বৈঠকে সেই মিছিলের প্রসঙ্গ সরাসরি তুললেন না অমিত শাহ। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বললেন, দিদি এ বার আটকান দেখি! তাঁর কথায়, “মমতা দিদি, আর তো সমাবেশের অনুমতি আটকানো যাবে না। আর তো হেলকপ্টার নামাও রোখা যাবে না। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমেই বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছবে বিজেপি।”.

উনিশের ১৪ মে থেকে বিশ সালের ৯ জুনের মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে বাংলার রাজনীতিতে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা এ রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশে যেমন এরই মধ্যে ঝড় তুলতে চেয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে। তেমনই মাটি কামড়ে সেই ঝড় প্রতিহত করার চেষ্টাতেও রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাহিনী। একুশের সেই মহারণের আগে মঙ্গলবার তাঁদের বিকল্প মডেলটাই দেখানোর চেষ্টা করলেন অধুনা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।

দিন কয়েক আগে থেকেই একটি নতুন ইস্যু তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বলেছিলাম, যদি মনে হয় আমরা (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গ সরকার) কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে পারছি না তাহলে তাহলে আপনারা সামলান!” সেইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, “কিন্তু আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ উনি কিন্তু আমায় বলেছিলেন, না না! নির্বাচিত সরকার কী করে ভেঙে দেব!”

মঙ্গলবার সেই প্রসঙ্গ তুলে আনলেন অমিত শাহ। ভার্চুয়াল সভায় তীর্যক খোঁচা দিয়ে অমিত শাহ বলেন, ‘মমতা দিদি পারছেন না। ছেড়ে দিতে চাইছেন। আমি বলছি ভাল কথা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধ পূর্ণ হবে। একুশের ভোটে বাংলায় সরকার গড়বে বিজেপি। মিলিয়ে নেবেন।”

এখানেই থামেননি অমিত। নতুন দিনের সমাবেশ থেকে তিনি বলেন, “আমরা সেই দল নয়, যারা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও শুধুই অভিযোগ করে। মনে রাখবেন, শুধুই রাজনীতি করার জন্য বিজেপি বাংলায় আসেনি, সোনার বাংলা গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।” তিনি বলেন, “বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে রাজ্যে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প চালু হবে।” এদিন অমিতের অভিযোগ ছিল, রাজ্য সরকারের জন্যই বাংলার কৃষকরা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সাহায্য পাননি। মমতা দিদি, শনিবার তালিকা দিলে সোমবারের মধ্যে টাকা পাঠিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।”

তা ছাড়া অমিত শাহরে বক্তব্যের বড় অংশ জুড়েই ছিল কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান প্রকল্প’-এর কথা। নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই প্রকল্পের মাধ্যমে গোটা দেশে কী ভাবে মানুষ উপকৃত হয়েছেন তার হিসেব দেন তিনি। আর তখনই হাততালি দেন সভায় উপস্থিত বাংলার নেতা, কর্মীরা। তাদের থামিয়ে অমিত শাহ বলেন, এর জন্য বাংলার মানুষের হাততালি দেওয়ার কথা নয়। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির জন্য বাংলার মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, “মমতা দিদি, এই রাজ্যের গরিব মানুষের কি অধিকার নেই বুড়ো বাবা, ছোট বাচ্চার ভাল চিকিৎসা করানোর? রাজনীতির একটা সীমা আছে!”

কেমন হবে রাজ্যের বিজেপি সরকার তাঁর স্বপ্ন দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিন বারবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে আক্রমণ করেন শাহ। তিনি বলেন, ছ’বছরে কেন্দ্রীয় সরকার কী কাজ করেছে তার হিসেব দিচ্ছি আমরা। পারলে মুখ্যমন্ত্রীও হিসেব ‌দিন। শাহর কথায়, “মমতা দিদি, আপনিও কাল সাংবাদিক সম্মেলন করে আপনার সরকারের ১০ বছরের কাজের খতিয়ান দিন। কিন্তু সেখানে আবার রাজ্যে বোমা বিস্ফোরণ আর কলকারখানা বন্ধের হিসেব দেবেন না।

বিজেপি কর্মীদের হত্যার হিসাব দেবেন না।” একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের সুরে অমিত বলেন, “বলিদানই বিজেপির ইতিহাস। তাই হিংসা করে বিজেপিকে আটকে রাখতে পারবেন না। যত সন্ত্রাস করবেন বিজেপির জমি বাংলায় ততই পোক্ত হবে।”

বিজেপি যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’-কেও ইস্যু করবে সেটাও এদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন অমিত শাহ। শুধু রাজ্য রাজনীতিই নয়, গোটা দেশ আন্দোলিত হয়েছিল ওই আইন নিয়ে। এরই মধ্যে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় চাপা পড়ে যায় ওই ইস্যু। এদিন ফের তা সামনে নিয়ে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, “মমতা দিদি, মতুয়া, নমঃশূদ্র ও বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এদেশে শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়াকে কেন বিরোধিতা করছেন?

তোষণের রাজনীতির জন্য সিএএ-এর প্রতিবাদ করা হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের সুবিধা মোদী সরকার দেবেই। ভোটে মমতা সরকারকেই উদ্বাস্তু করে দেবে বাংলার মানুষ।” একই সঙ্গে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে মুখ্যমন্ত্রী ‘করোনা স্পেশাল’ বলে বাংলার শ্রমিকদের অপমান করেছেন বলে মন্তব্য করে অমিত বলেন, “ওই ট্রেনই তৃণমূল কংগ্রেসকে বাংলা থেকে বাইরে বের করে দেবে।”

বাংলার সরকারকে আক্রমণের পাশাপাশি এদিন বাংলার মানুষের কাছেও বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার আবেদন করেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, অনেকে বলছে, এর চেয়ে কমিউনিস্টরা ভাল ছিল। এর পরেই তাঁর আবেদন, “কমিউনিস্ট থেকে তৃণমূল কংগ্রেস সবাইকে সুযোগ দিয়েছেন কিন্তু কেউ কিছু করেনি। এবার বিজেপিকে সুযোগ দিন। আমরা সোনার বাংলা গড়ব।” বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের উদাহরণ দিয়ে শাহ বলেন, এক সময়ে ‘বিমারু’ রাজ্য হিসেবে যাদের পরিচয় ছিল সেখানে এখন বিকাশ ঘটছে।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দল ভোট প্রস্তুতি শুরু করে দিল রাজ্যে। এদিন অমিতের ভার্চুয়াল সভায় দিল্লিতে যেমন এই রাজ্য থেকে জয়ী দুই মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, দেবশ্রী চৌধুরীরা ছিলেন তেমনই কলকাতায় ছিলেন দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়রা। কার্যত সকলকে পাশে নিয়ে বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতির দামামা বাজিয়ে দিলেন অমিত শাহ। বুঝিয়ে দিলেন কোন কোন ইস্যুতে হবে একুশের লড়াই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here