নাতির সঙ্গে দুর্গাদর্শন- অশোক মজুমদার


“আমাকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবি।”….হটাৎ মায়ের আবদার। আমি তো চমকে উঠে বললাম, তুমি যেতে পারবে ? মা কেমন একটা কাতর হয়ে বললো,” একবার নিয়ে চল।” 


চিন্তায় পরলাম। ৮৯ বছরের আমার মায়ের প্রায় ষোলো বছর পর ঠাকুর দেখতে যাবার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু শরীরের এই অবস্থায় কিকরে নিয়ে যাবো ? মা তো ঠিক করে পা ফেলতেই পারে না। বাড়ির মধ্যেই তো সবসময় ধরে ধরে হাঁটাচলা করাতে হয়।
মায়ের ঠাকুর দেখতে যাওয়া নিয়ে নিবেদিতা রাগ করেছিল। খুব স্বাভাবিক। বাড়ির কাছেই ঠাকুর হলেও গাড়ির ভিতর থেকে ঠাকুর তো দেখা যাবে না। নেমে একটু হেঁটে গেলে তবেই প্যান্ডেল। কিন্তু ঋক বললো, আমি নিয়ে যাবো ঠাকুমাকে। এখানে বলি, আমার বড়ছেলে ঋক জন্মানোর সময় থেকেই দাদু ঠাকুমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই মা আর ঋকের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ ভালো। 


ঋকই গেলো মাকে ঠাকুর দেখাতে। একটু পর চলেও এলো। মা খুব খুশি। আমার স্বস্তি। কিছুক্ষণ পর দেখি হোয়াটসআপে সুখেনের অনেকগুলো মেসেজ। খুলে দেখি, ও বাবা এতো মা আর ঋকের ছবি। সুখেন নিজের মোবাইলে তুলেছে। মনে মনে সুখেনের বুদ্ধির তারিফ করলাম। যদিও সুখেনের এসব বোধবুদ্ধি ভালোই তা আমি গতবার লকডাউনেই বুঝেছিলাম। মা তখন ভাইয়ের কাছে ছিলো। আমি প্রয়োজনীয় জিনিস বাড়ির গেটে দিয়ে দূর থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলতাম। মা গেট ধরে দাঁড়িয়ে আমাকে শুধু ভিতরে যাবার কথা বলতো। সুখেন এগুলো লক্ষ্য করে নিজের মোবাইলে তুলে রাখতো। পরে আমাকে পাঠিয়ে দিতো। আমি সেইদিনের অভিজ্ঞতা লিখে পোস্টও করেছি। 


যাইহোক, ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। মা বারবার মাথায় হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করছে। মুখে হাসি আনন্দের। আমার ছবিগুলো দেখে খুব ভালো লাগতে লাগলো। ঈশ্বর কি তবে অনুভূতি হয়ে সবার ভিতরেই থাকে ? কি জানি!!
আমার মা কোনোদিনই পূজো নিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত নয়। ঠাকুর দেখতে যাবারও তেমন আগ্রহ ছিলো না। কলকাতায় এসে তো মোটেও দেখিনি। পূজোর সময় পাড়ায় বা এমনি কোথাও গেলে যা দর্শন হলো, ঐটুকুই। বিগত পনেরো ষোলো বছর তো সেটাও নয়। সেই মা জীবনের প্রায় অন্তিম অধ্যায়ে এসে ঠাকুর দেখার কথা বললো, এটা আমার কাছে সত্যিই খুব অবাক হওয়ার বিষয়। 


আমিও ঠাকুর, পূজো এসবের ধারকাছ দিয়েও কখনো যাইনি। নাস্তিক আস্তিক বুঝি না। আমার ভক্তি শ্রদ্ধা সব মানুষ কে নিয়ে। মা বাবা আমায় কোনোদিন এর জন্য কিছুই বলেনি।


কিন্তু এই মা দুর্গার আগমনে মানুষের ভিতরের আনন্দ দেখে আমার খুব ভালো লাগে। সেই জায়গায় আমার মাও তো কত আনন্দ পেলো। ছেলে হয়ে চোখের সামনে এটা দেখা আমার কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার। 
আরও ভালো লাগছে এই ভেবে যে, চারদিকে সম্পর্কের ক্রমাগত ভাঙ্গনে আজকালকার ছেলেমেয়েরা দাদু ঠাকুমা তো দূর মা বাবার সঙ্গেই সদ্ভাব রাখতে পারে না। আসলে চায়না। সেই জায়গায় আমার দুই ছেলেই ঠাকুমা বাড়িতে আসাতে খুব খুশি। বাবা হয়ে এটা দেখাটা আমার কাছে খুবই আনন্দের। কেমন একটা শান্তি হয় মনে মাকে যখন ঋক পিকুর সঙ্গে গল্প করতে দেখি। 


আসলে আমি মায়ের সঙ্গে খুব বেশি থাকিনি তো, তাই মায়ের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে তেমন পরিচিত নই। যখন বয়স দশ, মায়ের সঙ্গে হয় ছাড়াছাড়ি। বর্ধমানের সবুজ ধানক্ষেত, পুকুর, ডোবার জল জঙ্গলের স্নেহ আঁচল ছেড়ে চলে যাই রুক্ষ শুষ্ক পাথুরে বীরভূমে। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল জীবন। একাদশ দ্বাদশ হাওড়ায়। সেই থেকেই বোধয় সব মায়েদের সঙ্গেই আমার একটু আরোআরো ছাড়োছাড়ো ভাব। সেই ছন্নছাড়া আমি ঠোকরাতে ঠোকরাতে কিকরে কল্লোলিনী কলকাতার বাসিন্দা হলাম সে এক ইতিহাস বটে। 


ফলে আমার জীবন জার্নির সঙ্গে মায়ের সংযোগ কম থাকলেও মায়েরও শেষপর্যন্ত কলকাতাতেই বসত হয়ে গেলো। একই শহরে দুজনে থাকলেও আমার সঙ্গে মায়ের দেখাসাক্ষাৎ হতো অনেকটা আত্মীয়দের মত। দুই একঘন্টা বা কখনো একটা রাত। বরং আমার স্ত্রী নিবেদিতার সঙ্গে মা বেশি সময় কাটিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে বাবার মৃত্যুর পর থেকেই ছোটভায়ের কাছেই রয়েছে। আসলে ছিলো। মাস তিনেক হলো মা আমার কাছে আছে। এবং বড়ো কোনো অঘটন না ঘটলে ৮৯ বছর বয়সী আমার মায়ের জীবনের শেষ কটা দিন কাটবে আমার কাছেই।


আজ মায়ের ওই হাসিভরা মুখের ছবিগুলো দেখতে দেখতে তাই মনে হচ্ছিলো, আমার মা যেন আরেক মায়ের কাছে বহুদিন বাদে ফেরার কারণে যেমন খুশি, ঠিক তেমনই আমি খুশি, আমার মায়ের কাছে ফিরতে পেরে। ছোটবেলার আমি মাকে ছেড়ে আজ বেলাশেষে মা আমার কাছে আছে। এটাই আমার মাতৃদর্শন। 
কিন্তু আজকাল কেমন একটা লাগে, যখন দেখি দিনে দিনে আমার সেই দাপুটে সংসারী মা শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাকে দুমদাম পিটুনি দেওয়া হাতগুলো জীর্ণ শীর্ন হয়ে গেছে। একদিন এভাবেই চলে যাবে কোথায়….দৃষ্টির বাইরে। এই ছোটো ছোটো ঘটনাগুলোকেই আঁকড়ে মা থাকবে শুধু স্মৃতি হয়ে। ভাবতে যন্ত্রনা হয়। কিন্তু আমার তো কোনো জাদুদন্ড নেই মাকে আটকে রাখার। 
তবুও এটাই জীবন। যাওয়া আসা স্রোতে ভাসার মত এই বাস্তবকে মেনে নিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত বাঁচি। তাই মায়ের এই দুর্গাদর্শনের ছবিটিও আমার ভবিষ্যতের দিনগুলোর সময়ের দলিল হয়ে থাকবে। 


সাধারণত দেখেছি, মা বাবার মৃত্যুর পরই তাদের নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়। বলা হয়। আমার বন্ধুবান্ধবদেরও অনেককে তাই দেখেছি। এটা খারাপ নয়, এমনিই লেখা হয়না আরকি। কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে খুব ইচ্ছে হলো। তাই কাল রাতভর ভেবে আজ সপ্তমীর সকালে এটা পোস্ট করলাম। 
সবার পূজো ভালো কাটুক মায়ের সাথে। মাতৃদর্শনে আগামী হোক সুন্দর। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here