দেশের সময় ওয়েবডেস্ক: সকালে মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বলেছিলেন এই দিনটা ভারতের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে। আর রাতে রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হতেই টুইট করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বললেন, আজ মাইলফলক তৈরি হল ভারতে।

  • নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষে ১২৫টি ভোট পড়েছে।
  • অন্যদিকে, বিপক্ষে ভোট দেন ১০৫ জন সাংসদ।
  • রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে বিলটি আইনে পরিণত হবে।

বুধভার রাত ৯টা নাগাদ ভোটাভুটির মাধ্যমে নাগরিকত্ব বিল পাশ হয় রাজ্যসভায়। বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ১২৫। বিপক্ষে পড়ে ১০৫। বিল পাশের পরেই টুইট করেন মোদী। টুইটে তিনি লেখেন “মাইলফলক তৈরি হল ভারতে।

আমাদের দেশের একতা ও ভ্রাতৃত্বের পরিচয় পাওয়া গেল। রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ায় খুব খুশি। যেসব সাংসদরা এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাঁদের ধন্যবাদ। বহু মানুষ যাঁরা এতদিন ধরে কষ্ট পেয়েছেন তাঁদের কষ্ট লাঘব করতেই এই বিল আনা হয়েছে।”


লোকসভাতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে আসার পর থেকেই বিরোধিতা শুরু হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই বিল পাশ হলে ভারতে মুসলিমদের যন্ত্রণা আরও বাড়বে। লোকসভায় বিল পাশ হতেই গোটা উত্তর-পূর্ব জুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। বিশেষ করে অসমে বিক্ষোভ বড় আকার নিয়েছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে নামানো হয়েছে সেনা। মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ। এমনকি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও টুইট করে মোদীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। এই বিরোধিতা সত্ত্বেও বিল পাশ হওয়ায় স্বভাবতই খুশি হয়ে টুইট করলেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিন সকালেই এই বিল রাজ্যসভায় পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দিনভর এই বিল নিয়ে আলোচনা হয়। লোকসভার মতো রাজ্যসভাতেও কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা এই বিলের বিরোধিতা করেন।

লোকসভায় সমর্থন করলেও রাজ্যসভায় আশ্চর্যজনকভাবে শিবসেনা এই বিলের বিরোধিতা করে। তবে ভোটদানে বিরত থাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত যাবতীয় বিরোধিতার পরেও পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল।
রাজ্যসভায় এই বিল পেশ করানো কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ ছিল বিজেপির কাছে। বর্তমানে রাজ্যসভায় ২৪০ জন সদস্য আছেন। সেখানে ১২১ টি ভোট পেলে কোনও বিল পাশ হতে পারে। বিজেপি ও তার জোট শরিক এডিএমকে, জনতা দল ইউনাইটেড এবং অকালি দলের মোট এমপির সংখ্যা ১১৬।

কিন্তু এনডিএর শরিকদের মধ্যেই এ নিয়ে মতবিরোধ ছিল। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল জনতা দল ইউনাইটেডও। তবে সেসব সত্বেও সংসদের উচ্চকক্ষে ভোটাভুটিতে সংখ্যার হিসবে জয় পেল সরকার।
তর্ক বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত ১২৫ –১০৫ ভোটে পাশ হয়ে গেল বিল। এদিন সকালে বিল পেশ করার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ভারতীয় মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বিরোধী দলের সদস্যরা অপপ্রচার করার জন্য মিথ্যে কথা রটাচ্ছে। কিন্তু এই বিল কথা বলছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে বেআইনি ভাবে আসা মুসলিমদের নিয়ে। ভারতীয় মুসলিমরা ভয় পাবেন না’।

আগেই এই মন্তব্য করেছিলেন অমিত শাহ। আজ তিনি সেই মতের সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় যুক্ত করে জানালেন, ভারতে আসা সব অনুপ্রবেশকারীদেরকে ভারত কেন জায়গা দেবে?‌ এই তিন পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের জন্য আলাদা দেশ রয়েছে। যে দেশের সংবিধানে তাঁদের ধর্মের জন্য জায়গা আছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের মানুষদের জন্য অন্য কোনও দেশ নেই। তাঁরা কোথায় যাবেন?‌

বিরোধী দল বলছে, সবাইকে এই দেশের নাগরিকত্ব দিতে হবে। এভাবে কি আমাদের দেশ দুনিয়ার সমস্ত মুসলিমকে স্থান দেবে?‌ ‌
কেন্দ্রের এই অবস্থা নিয়েই উত্তর পূর্ব ভারতে দেখা দিয়েছে বিক্ষোভ। সুর চড়িয়েছেন বিরোধী দলের সদস্যরাও। তাঁদের মতে, এই বিলের মাধ্যমে দেশে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ শুরু হবে। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী এই দেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।

কিন্তু এই বিল পাশ হলে ভারতের সংবিধানকে খণ্ডন করা হবে। এদিন আলোচনার শুরুতে অমিত শাহের বিল পেশ করার পর বিরোধীদের হয়ে প্রথম মন্তব্য পেশ করেন কংগ্রেসের সাংসদ আনন্দ শর্মা। তিনি বলেন, যে সংবিধানকে স্মরণে রেখে সাংসদরা শপথ নেন, সেই সংবিধানকেই অস্বীকার করছে এই বিল। যা অন্যায়। তিনি ইতিহাস উল্লেখ করে দেখান, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগই দেশভাগের প্রসঙ্গ তুলেছিল। তাঁরাই বলেছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করতে। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে দেশভাগের কোনও সম্পর্ক নেই।

একই কথা বলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। তিনি উল্লেখ করেন লালন, নজরুলের কথা। বাংলায় ভাষণ শুরু করে ডেরেক ও ব্রায়েন বলেন, এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাকে অস্বীকার করছে এই বিল। এর উত্তরে বিজেপির সভাপতি ও রাজ্যসভার সাংসদ জে পি নাড্ডা উল্লেখ করেন নেহেরু লিয়াকত চুক্তির কথা।

যেখানে বলা হয়েছিল, ভারত পাকিস্তান নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকবে। ভারত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান দেয়নি। ডেরেক ও ব্রায়েন এই কথা অস্বীকার করেই বলেন, কেন আমরা নিজের দেশের বিষয় আলোচনা না করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান কী করেছে, সেটা নিয়ে আমাদের সংসদে আলোচনা করব?‌

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষার জন্য এদিন জেডিইউ ও বিজেডির সাংসদদের এই বিলের বিরোধিতা করার জন্য আবেদন জানান ডেরেক।

এদিকে, গতকাল থেকেই উত্তর পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা ও মোবাইল পরিষেবায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এবার সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিল প্রশাসন। এদিন আন্দোলনের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে ডিব্রুগড়ে সেনা নামাতে বাধ্য হয় অসম সরকার।

সেনার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিব্রুগড়ের লাহওয়ালে প্রতিবাদী সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনা কাজে নেমেছে। সেনা খুব তাড়াতাড়ি রাস্তায় ফ্ল্যাগ মার্চ করবে।
গুয়াহাটিতে এদিন প্রতিবাদীদের সামলাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এরপর সিআরপিএফ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ বাঁধে।

ভানগড়ে এদিন আটকে দেওয়া হয় সিআরপিএফকে। ছাত্রদের বিশাল মিছিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় ফের কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে জমাতেয় ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। এছাড়াও ডিব্রুগড়ের চৌলধোয়ায় এদিন অসম মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদে নামেন। পুলিশ লাঠি চার্জ করে প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করতে। ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় গুয়াহাটি ও ডিব্রুগড়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে।

শয়ে শয়ে কলেজ ছাত্র ক্যাব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। খবর পাওয়া যাচ্ছে, আন্দোলনের তীব্রতা এতই বেশি যে অসমের বিভিন্ন অংশে রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ‌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here