রতন সিনহা, দেশের সময়ঃ

কংক্রিট, টাইলসে ঝাঁ-চকচকে সৈকত। বসার জায়গা, রাস্তা। পাথর বাঁধানো সমুদ্রের পাড়। পর্যটক টানতে উন্নয়নের নানা প্রকল্প। তার মধ্যে ঠান্ডা পানীয় সহ বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক এর সামগ্রী ছুঁড়ে ফেলছেন সমুদ্রের জলে, যার জেরে পাল্টে যাচ্ছে দিঘা-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলই।

দিঘা মানেই পর্যটকের ভিড়। মরসুম তো বটেই, কয়েক দিন পরপর ছুটি থাকলেই পর্যটকের ভিড়ে গিজগিজ করে দিঘা। এতে সমুদ্র উপকূল লাগোয়া পর্যটন কেন্দ্রটি ক্রমশ দূষণে জর্জড়িত হচ্ছে। সবুজ হারাচ্ছে সৈকত। সেই ঘাটতি পূরণে দিঘার কাছেই ওডিশা সীমানা লাগোয়া উদয়পুর সৈকতের আকষর্ণ বাড়ানোর পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে ধীরে ধীরে। এ যেন দিঘার ভিতরেই আর এক দিঘা। দিঘা বলতে এতদিন লোকে ওল্ড ও নিউ দিঘা বুঝতেন। বিস্তৃত ঝাউবন ও চওড়া সৈকত নিয়ে উদয়পুরের পর্যটন সম্ভাবনাও যে কিছু কম নয়, তা বোঝার চেষ্টা করেনি প্রশাসন। এ বার দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ উদয়পুরকে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। সমুদ্র বরাবর হাঁটার জন্য পাথর দিয়ে পাড় বাঁধানোর কাজ চলছে জোর কদমে। সেখানেই তৈরি করা হচ্ছে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা।

এক নজরেঃ

  • কংক্রিট, টাইলসে ঝাঁ-চকচকে সৈকত। বসার জায়গা, রাস্তা। পাথর বাঁধানো সমুদ্রের পাড়।
  • পর্যটক টানতে উন্নয়নের নানা প্রকল্প। যার জেরে পাল্টে যাচ্ছে দিঘা-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলই।
  • পরিবেশবিদ, সমুদ্রবিজ্ঞানীরা কিন্তু শঙ্কিত। তাঁদের উদ্বেগ, পরিবেশটাই না পাল্টে যায়। তাতে হারিয়ে যেতে পারে সৈকতের স্বাভাবিক উদ্ভিদ, ঝোপঝাড়, কীটপতঙ্গ।
  • ঠান্ডা পানীয় সহ বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক এর সামগ্রী ছুঁড়ে ফেলছেন সমুদ্রের জলে

পরিবেশবিদ, সমুদ্রবিজ্ঞানীরা কিন্তু শঙ্কিত। তাঁদের উদ্বেগ, পরিবেশটাই না পাল্টে যায়। তাতে হারিয়ে যেতে পারে সৈকতের স্বাভাবিক উদ্ভিদ, ঝোপঝাড়, কীটপতঙ্গ। সে সবের গুরুত্ব অনেক। ওই গাছপালা বা পতঙ্গকুলের সবগুলিই পরিবেশ রক্ষাকারী। সৈকতের নানা ধরনের স্বাভাবিক উদ্ভিদ ভূমিক্ষয় ঠেকায়। সেই লতা-গুল্ম, আগাছা হারিয়ে গেলে পাড় ভাঙার বিপদ তাই বাড়বে বলে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি সমুদ্রের পাড়ে ও জলে কীটপতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিতে দূষণ বাড়বে বলেও তাঁদের আশঙ্কা। পরিবেশবিদ ও সমুদ্রবিজ্ঞানীরা তাই পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়নের উপর জোর দিচ্ছেন। তা না-হলে উপকূল এলাকা বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে তাঁদের অভিমত। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা অবশ্য তাঁদের সঙ্গে একমত নন।

দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের এক সদস্যের কথায় , ‘পরিবেশ বাঁচিয়েই উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে।’ তাঁর মতে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। প্রবীণ সমুদ্রবিজ্ঞানী তথা দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘নিউ দিঘার দিকে যতটুকু বালিয়াড়ি, ঝাউ ও কেয়ার জঙ্গল অবশিষ্ট ছিল, তাও হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলে আমরা আমাদের চাহিদাকে শুধু গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি, বালিয়াড়ি ও তাকে ঘিরে থাকা স্বাভাবিক উদ্ভিদ হল উপকূল এলাকার হৃৎপিন্ড। তাই বালিয়াড়ি আর স্বাভাবিক উদ্ভিদ কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার অর্থ আমরা উন্নয়নের নামে পুরো পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারব, আমরা আমাদের কতটা ক্ষতি করেছি।’ বিজ্ঞানীদের মতে এতে এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্যের চরম সর্বনাশ হয়ে যাবে।
জীববিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দিঘা উপকূল থেকে সিসিন্ডেলা গোত্রের ২৫টির বেশি প্রজাতির উপকারী কীটপতঙ্গ হারিয়ে যেতে বসেছে বালিয়াড়ি, কেয়া গাছ, ঝোপঝাড় নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে। কাঁথি কলেজের জুওলজির এক শিক্ষক বলেন, ‘সিসিন্ডেলা গোত্রের কীটপতঙ্গ বালিতে গর্ত করে ডিম পাড়ে। ওই গর্ত দিয়ে সৈকতের উপরের দূষিত পদার্থ মাটির নীচে চলে যায়। এতে সৈকতে দূষণের মাত্রা কমে যায়। ওই কীটপতঙ্গ না-থাকলে সেই সুযোগ আর থাকবে না। আবার কার্নিভোরা গোত্রের কীটপতঙ্গ সৈকতে পড়ে থাকা পচা মাছ, দূষিত পদার্থ খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। আবার লাল কাঁকড়া উপকূলের ভূমিক্ষয় রোধে সাহায্য করে।’ গবেষকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, সাইলোমাস, ডিপলোসিলা প্রজাতির কীটপতঙ্গ মাটিতে অক্সিজেন ও উদ্ভিদখাদ্যের স্বাভাবিক জোগান বজায় রাখে। তাই এই সব কীটপতঙ্গ হারিয়ে গেলে স্বাভাবিক ভাবে সৈকতের পর্যটন কেন্দ্রগুলি-সহ উপকূল এলাকায় দূষণের মাত্রা বাড়বে।
উপকূল এলাকায় বর্তমানে নতুন নতুন হোটেল রিসর্ট, পার্ক, রাস্তা ইত্যাদি তৈরির জন্যে বালিয়াড়ি কেটে ফেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে আইপোমিয়া, কেয়ার জঙ্গল। সেই কারণে বাসস্থান হারিয়ে বিলুপ্তির পথে উপকারী কীটপতঙ্গ ও লাল কাঁকড়ার দল। তাজপুর, মন্দারমণিতে স্বাভাবিক বালিয়াড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সৈকতে বাইক, গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়ায় লাল কাঁকড়া হারিয়ে যেতে হতে বসেছে। মন্দারমণিতে বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হলেও সৈকতে বাইক, গাড়ির চলাচল একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এখনও। ভূমিক্ষয় রোধে দিঘা থেকে তাজপুর পর্যন্ত সমুদ্রের পাড় পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে আলো লাগানো হয়েছে। সুন্দর সুন্দর পার্ক ও পর্যটকদের বসার জায়গা তৈরি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সারা বছরই পর্যটকের কমবেশি ভিড় লেগে থাকে এই তিন সৈকতে। উৎসবে বা টানা দু-তিনদিনের ছুটিতে সেই ভিড় বাড়ে। অভিযোগ, পর্যটকের ভিড় বাড়লে পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্লাস্টিক-সহ অন্য ধরনের দূষণও। দিঘার পিকনিক স্পট-সহ ঝাউবনে, রাস্তার ধারে, এমনকী সৈকতেও পড়ে থাকতে দেখা যায় থার্মোকলের থালা, প্লাস্টিক ও পলিথিনের পাশপাশি পটাটো চিপসের ঠোঙা, আইসক্রিমের প্লাস্টিকের বাটিও। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, দিঘায় ঢোকার মুখে কড়া নজরদারির পরেও সৈকত শহরে প্লাস্টিকের রমরমা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গিয়েছে:দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ) ও দিঘায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে।
ডিএসডিএ-র বক্তব্য, দিঘায় ঢোকার দু’টি মুখে (একটি ওড়িশার চন্দনেশ্বর ও অন্যটি রামনগরে কাছে) রাস্তায় নজরদারি রাখা হয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থাকে ওই নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দিঘায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের বক্তব্য, তাঁদের জন্য নজরদারি ব্যবস্থা হলেও দিঘায় বিভিন্ন বাজার ও দোকানে সেই নজরদারির লেশমাত্র দেখা যায় না। পুরনো দিঘায় একটি বড় বাজার রয়েছে। তা ছাড়াও রয়েছে প্রচুর দোকান। খাবারের দোকান থেকে হস্তশিল্প সবই রয়েছে। সে সব দোকানে অবাধে প্লাস্টিকে-পলিথিনের প্যাকেটে জিনিস কেনা-বেচা চলে। তা ছাড়া গোটা দিঘায় রাস্তা ঘাটে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে তেমন প্রচার নজরে পড়ে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here