পার্থ সারথি নন্দী, শান্তিনিকেতন: কয়েক মাস আগে কেউ কি ভাবতে পেরেছিল পৃথিবী এমন থমকে যাবে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে! হাজারও পর্যটকে মুখরিত দর্শনীয় স্থানগুলো মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে৷ চারদিক কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে মানুষের অভাবে। যদিও এই শূন্যতায় প্রকৃতির মোটেও ক্ষতি হয়নি, বরং আচমকা বিরতিতে আরও যেন ঢেলে সেজেছে স্বমহিমায়। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে আসায় পৃথিবীর অনেক দেশ ধিরে ধিরে শিথিল করছে মানুষের চলাচল। আবার হয়তো শিগগিরই মুখর হবে জনসমাগমে। এই ঘরবন্দি জীবনে অনেকেই পরিকল্পনা করছেন করোনার প্রকোপ কমলেই নতুন-নতুন গন্তব্যে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ার জন্য৷ ট্রাভেলগের ডায়েরি থেকে রইল করোনাকালের আগে ঘুরে আসা রবীন্দ্রচর্চার তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনের গল্প।

সাতসকালেই বনগাঁ থেকে রওয়ানা হলাম হাওড়া স্টেশনে। এখান থেকে যে ট্রেনটি সরাসরি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বোলপুর যায়। ট্রেনেই শান্তিনিকেতনের পথে যাত্রা শুরু করলাম।

একাকী এই যাত্রা আমার কাছে সব সময়ই ভিন্ন আমেজের। ট্রেনের মধ্যে আশপাশের মানুষ দেখতে-দেখতে চলে যাওয়া যায়। মুখোমুখি ৬ জন বসা এই সিট অ্যারেঞ্জমেন্টে আমার পাশেই বসেছে এক সাঁওতাল পরিবারের ৫ জন সদস্য। দারিদ্র্য তাদের জীর্ণ শরীরে, পোশাকে লেগে থাকলেও চোখেমুখে আনন্দের ছটা। বাড়ি থেকে দলবেঁধে সবাই এসেছিল গঙ্গাস্নানের উদ্দেশে। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে ভাষার ভিন্নতার পাশাপাশি জীবনযাপনে সরলতার ছাপ স্পষ্ট। আসলে পৃথিবীর সব দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের মুখ আমার কাছে একই রকম লাগে, মনে হয় যেন একটু বেশিই আপন।

বোলপুরের দিকে ট্রেন ছুটতে লাগল, ট্রেনের জানালা দিয়ে বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম দূরের পথঘাট আর মানুষ।

ট্রেনের মধ্যে এক তরুণীর সঙ্গে বেশ আলাপ হলো। একা-একাই ঘুরছি শুনে বেশ আশ্চর্য হলেন। শান্তিনিকেতনের কথা শুনে জানালেন তিনি সেখানে ভর্তি হয়েছে এ বছর। আরও কিছুক্ষণ টুকটাক গল্প শেষে ইস্তফা দিয়ে আমি জানালা ধরে মানুষ-প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলাম। এই বীরভূমের কথা কত পড়েছি, শুনেছি নানান বইপত্রে-আলোচনায়। নিজের চোখে দেখে আরও মুগ্ধ হলাম।

ট্রেন ছুটতে লাগল। অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান শেষে ভরদুপুরে এসে পৌঁছালাম বোলপুর, কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে৷ অটো নিয়ে পৌঁছালাম আরাধ্য শান্তিনিকেতনে।

https://www.facebook.com/100015944293748/posts/582255845649220/

যেহেতু কলকাতা আজই ফেরার পরিকল্পনা তাই আর দেরি না করে ঘুরেফিরে দেখছিলাম। এত শান্ত-স্নিগ্ধ এলাকা যে হাঁটলেই মন ভালো হয়ে যায়। রবীন্দ্রচর্চার তীর্থস্থান হলেও এখানে পথেঘাটেই যে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাওয়া যাবে বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। কিছু দূর হেঁটেই টের পেলাম এত বিশাল এলাকা পায়ে হেঁটে দেখে পোষানো যাবে না। গেটের কাছ থেকেই ১৫০ টাকা ভাড়ায় একটা টোটো বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করলাম। মজার ব্যাপার হলো সব টোটোচালকই এখানে গাইডের কাজ করে এবং প্রত্যেকটা স্থাপনার মুখস্থ বর্ণনা বলে যায় অবলীলায়। মুর্শিদাবাদেও এই জিনিসটা দেখেছি এবং অবশ্যই তা এই পেশাজীবীদের একটা দক্ষতা বটে।

শান্তিনিকেতনের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা হলেও রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে এখানে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। যা ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ দিকের একটা দীর্ঘ সময় এখানে কাটিয়েছেন, তাই শান্তিনিকেতনকে মনে করা হয় রবীন্দ্রচর্চার তীর্থভূমি।

শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাস অত্যন্ত শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। অনেকটা আমাদের বনগাঁর ইছামতীর মতো স্নিগ্ধ। গৌড়প্রাঙ্গণের মাঠের পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় চমৎকার বিকেল। পাশেই ঐতিহাসিক ছাতিমতলা, দৃষ্টিনন্দন উপাসনা ভবন আর অন্য সব একাডেমিক বিল্ডিং ঘুরে দেখলাম।

আরও কিছুদূর এগোতেই রাস্তার পাশেই চোখে পড়ল কিছু শিক্ষক -শিক্ষিকাদের বাড়ি। দেখা হলো নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়িও। প্রত্যেক বাড়িতে অসাধারণ নান্দনিকতার ছাপ স্পষ্ট। পথে যেতে-যেতে নানান শিল্পকর্ম চোখে পড়ে। বনগাঁ থেকে এসেছি শুনেই টোটো চালক নিয়ে গেলেন নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবন দেখাতে। খুব সম্প্রতিই মনে হয় ভবনটি চালু হয়েছে। টোটো চালক বললেন বনগাঁর খুব কাছেই বাংলাদেশ ,ওখানে পেট্রাপোল বর্ডার পেরলেই বেনাপোল,এক সময় বাবা, কাকারা ওখানেই থাকতেন ,দেশ ভাগের পর আর কেউ ফিরে যায়নি ও দেশে।

আমাকে এক রকম জোর করেই টোটো চালক নিয়ে গেলেন নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবন দেখাতে। খুব সম্প্রতিই ভবনটি চালু হয়েছে।এক বার ভবনটির দিকে তাকালাম আর একবার ওই টোটো চালকের চোখে চোখ রেখে বুঝলাম ওপার বাংলার টানটা এখনও বেশ ধরে রেখেছে তাঁর বাবা,কাকার মুখে বাংলাদেশের গল্প শুনেই৷

ঘড়ি দেখে টের পেলাম ফেরার ঘণ্টা বেজে এসেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে শান্তিনিকেতন যে আসলেই স্বল্প সময়ে ঘুরে দেখা সম্ভব না। যদিও ফেরার পর কেবল আফসোসই হয়েছে একটা রাত বোলপুরে না থেকে। সময় স্বল্পতায় আসলে কিছু করারও ছিল না। 

তবে সবচেয়ে বেশি আফসোস রয়ে গেছে কোপাই নদী আর আদিবাসী এলাকা দেখতে না পারা। আবার যাব খুব শীঘ্র এবং অবশ্যই লম্বা সময় নিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here