কিছুদিন আগেই আমার বন্ধু চিত্রসাংবাদিক পার্থ পাল করোনা পজেটিভ হয়েছিলো। বর্তমানে সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। আজ সেই পার্থ প্লাজমা দিলো। এটা আমার কাছে একটা অসাধারণ অনুভূতি আমার বন্ধুর জন্য।

মনে-প্রাণে পার্থ সবসময়ই এক উৎফুল্ল মানুষ এবং পরোপকারী। তাই ওর কোভিড হবার প্রথম থেকেই আমি এবং আমার চিত্রসাংবাদিক বন্ধুরা পার্থর পাশেই ছিলাম। খুব চিন্তার মধ্যেও ছিলাম। কারণ সত্যি কথা বলতে, কোভিডের শুরুতেই আমরা বিশিষ্ট চিত্র সাংবাদিক রনি রায়কে হারিয়েছিলাম বলে চিন্তাটা বেড়েছিল। এমনকি গতকাল বন্ধু সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহকেও হারিয়েছি। তাই অস্বীকার করার কিছু নেই যে পার্থ পজিটিভ হওয়ার পর আর দিনদিন কলকাতার করোনার ছবি দ্রুত পাল্টে যাওয়া ও মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন দেখে মনে একটা ভয় কাজ করছিলো ভালোই।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে যে আতংকে মানুষ বিভ্রান্ত সেখানে পার্থকে যা দেখেছি তাতে আমি অবাক। ও এতটাই প্রাণবন্ত ছেলে যে কোভিডের চিকিৎসা চলাকালীনও ওর কাজে কিন্তু কোনো বিরাম ছিলোনা। আমফানের ছবি পর্যন্ত নার্সিংহোমের ভিতর থেকে তুলে নিজের কাগজকে পাঠিয়েছিল। পার্থ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকল চিত্র সাংবাদিকদের কাছেই এটা এক প্রেরণা।

সেই পার্থ আজ সকালে চুপিচুপি গিয়ে মেডিকেল কলেজে প্লাজমা দিয়ে এসেছে। আমরা অভিভূত। আমরা সকলেই জানি, কোভিডের সুস্থ হওয়ার পর প্লাজমা অন্য কোভিড রোগীদের বেঁচে থাকায় সাহায্য করে। তাই করোনা যুদ্ধ জয় করে অনেক ছেলেমেয়ে সুস্থ হওয়ার পর প্লাজমা দিতে এগিয়ে আসছে। সরকার প্লাজমা ব্যাংক তৈরি করেছে।

পার্থও যখন থেকে এটা শুনেছে ওকেও খুব আগ্রহী দেখেছি। তাই ওকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। কিন্তু প্লাজমা দিয়ে আমাদের কাছে ও এক দৃষ্টান্ত রেখে দিল। আমাদের দেখিয়ে দিল “শুধু নিজে বেঁচে থাকাই নয়, অপরকে বাঁচানোও আমাদের একান্ত কর্তব্য”। আধুনিক সভ্যতা যতই আমাদের পরস্পরের সাথে মেলামেশা কম করে দিয়েছে তবুও আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে এভাবেই আমরা একে অপরকে আঁকড়ে আমরা বেঁচে থাকি। পার্থ সেই আঁকড়ে থাকাটাকে আরও মজবুত করলো।

বলতে বাধা নেই চিত্র সাংবাদিকরা এই ভাবেই কাজ করে। জীবনের ঝুঁকি তাদের পেশার বন্ধু। তাই পার্থর কোভিড পার্থকে একটুও দমাতে পারেনি। ও আমায় জানিয়েছিল প্লাজমা দিতে যাবে। আমি বলেছিলাম, কয়েক দিন পর যাস। কিন্তু ওর তর সয়নি। আজ সকালে মেসেজে জানালো, ‘অশোকদা আমি যাচ্ছি’। পরে পার্থকে ফোনে না পেয়ে মাসিমাকে ফোন করেছিলাম। পার্থ করোনায় ভর্তি হওয়ার পর এই চারমাস মাসিমার সাথে আমার খুব ভাব হয়েছে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম,’পার্থর ফোন পাচ্ছিনা। ও কি বাড়িতে’?
মাসিমা বলল,’না’।
বললাম,’কোথায় গেছে?’
মাসিমা বলল,’রক্ত দিতে।’
আমি বললাম,’সেকি! এখন, এই সময়ে রক্ত দেওয়া! তুমি যেতে দিলে?’
মাসিমা বললে,’কেন? ওতো সুস্থ। রক্ত দিয়ে আরো দু’জনের যদি প্রাণ বাঁচে, তাহলে অসুবিধা কোথায়?’
আমি বললাম, ‘তোমায় জানিয়েছে ও ? ‘
মাসিমা বলল,’ রাতে আমায় বলল, মা আমি প্লাজমা দিতে যাব।’ তখনই আমি ওকে বলেছিলাম, ‘এত ভালো কাজ, আমাকে বলার কি আছে? তোর রক্তে যদি কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচে, সে তো ভালো কথা।’
পার্থ বলল,’ মা হাফ হাতা শার্ট পরে যেতে হবে। তুমি সকালে মনে করিয়ে দিও। ওরাই গাড়ি পাঠাবে।’

মাসিমা একটা সাদা হাফ হাতা শার্ট বের করে রেখেছিলেন। পার্থ সেটা পরেই একাই গিয়ে প্লাজমা দিয়ে এসেছে। ও ফিরলে আমি ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আসলে ওর সাথে দেখা না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। ও এতবড়ো কাজ করে ফিরেছে আমারই যেন আনন্দে আত্মহারা লাগছিলো। কিন্তু গিয়ে আমি বরং একটু হতাশই হলাম। আমি যতই ওকে বলতে চাই, ও যা করেছে তা অভাবনীয়, ওর জন্য খুব আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু ও এটাকে কোনো পাত্তাই না দিয়ে অন্য কথায় চলে যাচ্ছে। স্বাভাবিক সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলে প্লাজমা দেবার অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েও দেখলাম ও সেই উদাসীন। যেন এটা আবার কি এমন ব্যাপার। উল্টে আমাকে বকাঝকা করতে লাগলো শরীরের যত্ন নাও, এতো সিগারেট খেয়োনা।

পার্থ এমনিই চিরকাল। একদম সাদাসিধা। সাধারণ। আমার ওর প্রতি গর্ব থাকবে এই ঘটনার জন্য। আর আমি চাই সারাজীবন সাদা শার্টের মতো পার্থর মনটাও যেন এমন সাদা থাকে। পার্থ একা এই কাজ করে আমাদের পথ দেখালো যে জীবন মানে আর কিছু না শুধু “নিজে বাঁচো” ও “অপরকে বাঁচাও”। এভাবে থাকলেই আমরা সবাই এই যুদ্ধ একদিন ঠিক জয় করবোই করবো।

পার্থ যুগ যুগ জিও অশোক মজুমদার।। ১০.০৭.২০২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here