দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ আগুনে রূপ তার। স্বভাবে বরফের শীতলতা থাকলেও গতিবেগে দুরন্ত। তার আলোর ঝলক কয়েক কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত। দুটো লেজও আছে। সেই গরবেই গরবিনী সে। মহাশূন্যে একা, বিচ্ছিন্ন, সঙ্গীহীন হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের সৌরমণ্ডলে নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে দিনকয়েক আগেই। সূর্যকেই আপন ভেবে এতদিন তার চারপাশেই পাক খাচ্ছিল। এখন নজরে পড়েছে পৃথিবী। তারই মায়ায় একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। যতই কাছে আসছে তার রূপের ছটায় ভরে উঠছে মহাকাশ। সে এক ধূমকেতু। পরিচয় সি/২০২০ এফ৩। নাম ‘নিওওয়াইস’ (NEOWISE) ।

এই ধূমকেতুরা হল সেলিব্রিটি। কালেভদ্রে দেখা দেয়। হুশ করে ভেসে আসে আবার ঠিকানা বদলে চলে যায় কোনও এক অজানার পথে। দূর তারামণ্ডল থেকে পথ হারিয়ে পৃথিবীর সৌরমণ্ডলের ঢুকে পড়ে বহু বছরে হয়ত একবার। যখনই তারা আসে সঙ্গে করে একরাশ বিস্ময় নিয়ে আসে। নাড়িয়ে দিয়ে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীমহলকে। মে মাসেই ‘সোয়ান’ নামে এক ধূমকেতু দেখা দিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর আকাশে। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেছিলেন ‘রাজহাঁস।’ এবার উত্তর গোলার্ধের আকাশজুড়ে রাজকীয় আলো ছড়িয়ে দেবে নিওওয়াইস। পৃথিবী থেকে এখন তার দূরত্ব মাত্র ২০ কোটি কিলোমিটার।

নিওওয়াইসকে উত্তেজনার আরও একটা কারণ হল, ভারতের আকাশজুড়ে জুলাই থেকে অগস্ট অবধি জ্বলজ্বল করবে এই ধূমকেতু। তার দুই লেজ ভাসিয়ে গোটা উত্তর গোলার্ধ দাপিয়ে বেড়াবে। এখনই সন্ধ্যার পরে মাঝেমধ্যে নাকি তার দর্শন পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ১২-১৩ জুলাইয়ের পর থেকে অগস্ট অবধি আকাশে আরও স্পষ্ট দেখা যাবে নিওওয়াইসকে। আগামী ২২-২৩ জুলাই পৃথিবীর মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাবে। তখন সে থাকবে আরও কাছাকাছি, পাশাপাশি। মাত্র ১০ কোটি কিলোমিটার দূরে। আরও বেশি উজ্জ্বল ও স্পষ্ট দেখা যাবে তার রূপ। রাতের আকাশে আলোর মায়া ছড়িয়ে দিয়ে যাবে নিওওয়াইস।

তার ঠিকানা কেউ জানে না। পরিবার পরিজনেরও খোঁজ নেই। আচমকাই পথ ভুলে চলে এসেছে সৌরমণ্ডলের ঠিকানায়। মার্চ মাসেই এই অনাহুত অতিথির খোঁজ পেয়েছিল ‘ওয়াইল্ড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরার’ (WISE) স্পেস টেলিস্কোপ। পৃথিবীর ধারেকাছে হুটহাট চলে আসা গ্রহাণু বা মহাজাগতিক বস্তুকে শনাক্ত করাই এই ওয়াইস স্পেস টেলিস্কোপের কাজ। তার এই নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট মিশনেই ধরা দেয় নিওওয়াইস। ধূমকেতু তখন সূর্যের খুব কাছে। প্রায় সাড়ে চার কোটি কিলোমিটারের দূরত্বে।

বুধের কক্ষপথ থেকেও সূর্যের কাছাকাছি। এত তেজের কারণেই কি না জানা নেই, এখন নিওওয়াইস তার প্রায় উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে সরতে সরতে পৃথিবীর দিকেই এগিয়ে আসছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সন্ধের পরে আকাশে দিব্যি দেখা যাবে নিওওয়াইসকে। পৃথিবীর কাছাকাছি থাকার জন্য বেশ লম্বা ছুটি নিয়েই এসেছে সে।

নিওওয়াইসের পরিধি ৩০ কিলোমিটারের কম। এর শরীর তৈরি হয়েছে পাথর, গ্যাস আর বরফ দিয়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের কাছাকাছি সৌরবায়ু ও তড়িদাহত সৌরকণাদের সংস্পর্শে এসে এই গ্যাস ও বরফ উবে গিয়ে নতুন পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে। দুটো লেজও গজিয়েছে যার একটি গ্যাসের ও অন্যটির ধুলোর।

কোন তারামণ্ডল থেকে ছুটে এসেছে জানা নেই। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথে তার ঠিকানা ছিল কিনা সেটাও অজানা। বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন, কুইপের বেল্ট বা ওরট ক্লাউড (Oort Cloud) থেকেই নতুন অভিযানের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে নিওওয়াইস। এই ওরট ক্লাউড হল সৌরমণ্ডলের থেকে বহু দূরের এক হিমশীতল বরফের রাজ্য। আমাদের সৌরমণ্ডলের বড় বড় গ্রহগুলির পাশে থাকার অধিকার পায়নি যে ছোটখাটো গ্রহাণু বা মহাজাগতিক বস্তুরা, তাদেরই ঠিকানা ওই বরফের দেশে। প্রায় ৪০০-৫০০ কোটি বছর ধরে ওই বরফের দেশে বাস করে ধূমকেতুরা। হিমশীতল জায়গায় থাকায় এদের শরীর তৈরি হয় পাথর, গ্যাস আর বরফ দিয়ে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সৌরমণ্ডল যতটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাকে পরিমাপ করা হয় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ) দিয়ে। এর বাইরেও যে ঘন আঁধারে ঢাকা ঠাণ্ডার দেশ রয়েছে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না সে দেশকেই বলে ওরট ক্লাউড। আর এখানেই বাড়ি ধূমকেতুদের। নিওওয়াইসও এই ওরট ক্লাউড থেকেই সূর্য-পৃথিবীর সংসারে চলে এসেছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here