‘ট্রাভেলগ’-

লিখছেন – দেবাশীষ রায় চৌধুরী,

অভ্যাসমতো সাতসকালে ঘুম ভেঙে যায়।আজ মুন্সিয়ারি ছেড়ে যেতে হবে,একথা মনে হতেই কম্বলের আয়েশ ছেড়ে উঠে পড়ি।আর একবার পঞ্চচুল্লির শিখরে সূর্যকিরণ ছটা দেখে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ছাদে গিয়ে দাঁড়াই।আমার মতো অনেকেই জড়ো হয়েছে ছাদে। প্রাণ ভরে, চোখ ভরে হয়তো শেষবারের মতো দেখে নিলাম মুন্সয়ারির স্বর্গীয় আলোক উদ্ভাস।সকলেই স্মৃতি ধরে রাখতে চায় মুঠোফোনে। সুষমাদি-তুহিনদা,পিউ-সুব্রত,দিশারী-অলক, পূর্ণ-ডালিয়া,পঞ্চচুল্লির পটভূমিকায় সব জুড়ির নানান পোজে ছবি তোলা সারা হল।আমি আত্মপ্রচারবিমুখ মানুষ সেইজন্য ছবি তোলা বিষয়ে নিজেদের কথা বলা উচিত হবে না।আজও চা-আড্ডা ছাদেই হল।তবে বেশি সময় পাওয়া গেল না কারণ ব্রেকফাষ্ট করে বেরিয়ে পড়তে হবে।

ঘন্টাদুয়েক পরে আমরা রেডি হয়ে বাসে উঠে পড়েছি। বাসে লাগেজ তোলা চলছে।একটা ভারী ব্যাগ তুলতে গিয়ে সুকুমারের হাতের আঙুল কেটে রক্তপাত শুরু হল।আমদের কাছে যা ওষুধ ছিল তাতে রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না।হোটেলের পাশেই হেলথ সেন্টারে যেতে হল।গেট দিয়ে ঢুকে যেটা চোখে পড়ে তাহল পরিচ্ছন্নতা। কোথাও এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ চোখে পড়ল না।দেওয়ালে পান-পিকের আলপনা নেই।কম্পাউন্ডের মধ্যে কোনও চিৎকার চেঁচামেচি নেই অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।ইমারজেন্সিতে যিনি ছিলেন খুব যত্ন করে ড্রেসিং করে দিলেন।ইঞ্জেকশন নেওয়ার জন্য অন্য ঘরে যেতে হল।যাওয়ার সময় মেল ওয়ার্ড পেরিয়ে যেতে হয়।ওয়ার্ডে দশ বারোটা বেড,তাতে চার-পাঁচজন রোগী আছেন মনে হল।চিকিৎসাকেন্দ্র এইরকম পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম হলে, পরিষেবা এমন আন্তরিক হলে রোগী মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন।
বাসে ওঠার আগে ভালোকরে চারপাশ দেখে নিই।ঘন নীল আকাশে এখনও চাঁদ জেগে আছে।থইথই রোদ্দুরে ভেসে গেলেও তাকে চিনে নিতে ভুল হচ্ছে না।আবার সেই পুরনো পথ ধরে ফিরে চলা।
আসার সময় অন্ধকারের জন্য দুপাশ ভালো করে দেখা যায়নি।এখন বোঝা যাচ্ছে রাস্তা বেশ দুর্গম।মাঝেমাঝেই ‘সামনে রাস্তা খারাপ’ তাই সাবধানে চলার পরামর্শ বুকে লিখে এক একটা বোর্ড দাঁড়িয়ে আছে।বাঁকের মুখে বাস অনেকটা কাত হয়ে যাচ্ছে আর তখনই চোখে পড়ছে পাশের গভীর খাদ।বাসের ভিতরে হালকা আতঙ্কের ঢেউ উঠে আবার স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে।তবে পুরো রাস্তাটা একই রকম খারাপ নয়।বেশ কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর দুর্গমতা কমে আসে।খানিক পরে ড্রাইভার বাস থামিয়ে বলে,” আগে বির্থি ফলস হ্যায় “।এইটুকু শোনার অপেক্ষা ছিল।হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামার প্রতিযোগিতা শুরু সামনে একটু এগিয়ে যেতে ডানদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাত দেখা যায়।রাস্তা থেকে ধাপেধাপে সিঁড়ি উঠেছে উপরে। সিঁড়ির গা ঘেঁষে একটা দোকান।আমরা চায়ের জন্য দোকানে ঢুকে পড়ি।দোকানের অন্য পাশে কয়েকটা চেয়ার টেবিল সাজানো, তাদের মাথার উপর রঙিন ছাতা।ঝর্ণা দেখতে দেখতে চা খাওয়া এক অন্য অভিজ্ঞতা। প্রায় একশো মিটার উচ্চতা থেকে জলধারা নেমে আসছে।তবে প্রবল বেগে নয়। যা দেখে বিস্মিত হওয়া গেল না।মুন্সিয়ারি থেকে আমরা চল্লিশ কিলোমিটার মতো পথ চলে এসেছি।বাকি আরও অনেক পথ।ড্রাইভার তাড়াতাড়ি বাসে ওঠার জন্য তাগাদা দেয়।
বাস আবার চলতে শুরু করে।পিউএর জেবিএল সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজে,
“গোরি তেরি গাঁও বড়া প্যারা, ম্যায় তো গয়া মারা আকে ইহারে।”বাইরে প্রকৃতি তখন সচ্ হি বড়া প্যারা। পাইন দেওদার পেড় বিন্দাস, যেন আসমান তক উঠে যাবে।আর পাহাড় !ওহ তো সাথহিসাথ চল রহি হ্যায়।বাস বাঁক নিতেই আচানক দিল ঝুমকে ওঠে। ডাহিনা তরফ এক নদীয়া খিলখিলাকর হঁস রহি হ্যায়।ইসকি নাম কেয়া হ্যায় ভাই ? এই প্রশ্নের উত্তরে ড্রাইভার বলে ইসিকা নাম রামগঙ্গা।উতার না হ্যায়”?, সে জিজ্ঞাসা করে।উত্তরে একযোগে সবাই হ্যায়ধ্বনি দেয়।যা শুনে হায়হায় ছাড়া আর কিছুই মনে হল না।
রাস্তা থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খানিকটা নীচে বয়ে যাচ্ছে নদী।জলে তার হালকা নীলা-পান্না আভা,দুপাশে ঘন সবুজ অরণ্য আর মাথার উপরে গাঢ় নীল আকাশ। এখানে নদীর বিস্তার বেশি নয় তবে আলাপ আছে।পাথর আর স্রোতের যুগলবন্দীতে জমে উঠেছে জলতরঙ্গের আলাপ।জলে পা ডুবিয়ে প্রায় সকলেই সেলফিনিমগ্ন। নির্জন প্রকৃতির সন্নিকটে এলে অধিকাংশ বাঙালির গান পায়,কবিতা পায়।আমিও তার ব্যতিক্রম নই।অবধারিতভাবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মনে পড়ল,
“তারপর যে-তে যে-তে যে-তে
এক নদীর সঙ্গে দেখা।
পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা।
সে নদীর দুদিকে দুটো মুখ।
এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্য মুখে
ছুটতে ছুটতে চলে গেল।”…
সারাদিন বসে নদীর ছোটাছুটি দেখলে আমাদের চলবে না।ফলে আমাদের কুড়িয়ে নিয়ে বাস ছুটল পাতাল ভুবনেশ্বরের দিকে।পাতাল ভুবনেশ্বর মন্দির আসলে একটি গুহা।৯০ মিটার গভীর ১৬০ মিটার চওড়া এই গুহা।শারিরীক কারণে আগে থেকেই গুহার ভিতরে না ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।পৌঁছাতে প্রায় আড়াইটা বাজল।সিদ্ধান্ত হল আগে দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর গুহামন্দিরে যাওয়া হবে।আমি নীচে নামব না শুনে অনেকেই ব্যাগ মোবাইল আমার জিম্মায় রেখে দিল কারণ গুহার ভিতরে ক্যামেরা,মোবাইল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।ছোটবেলার বন্ধু পুঁটে ডাক দিল, “চল বন্ধু ঘুরে আসি।”আমি রাজি হই না।আসলে ঈশ্বরে আমার তেমন বিশ্বাস নেই তবে কোনও মতবাদ প্রভাবিত তথাকথিত নাস্তিকও নই।তেমন হলে মন্দির চত্ত্বরে আসতাম না।যদি ছবি তোলা যেত তাহলে গুহামুখ পর্যন্ত নামার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মোবাইল নেওয়া মানা,একথা শুনে অযথা পরিশ্রম করতে ইচ্ছে হয় না।সিঁড়ির একপাশে একখন্ড পাথরের উপর বসে পড়ি।
আমরা ছাড়াও আরও অনেক ট্যুরিস্ট এসেছেন।তাদের অনেকেই দেখছি উঠে আসছেন এরা সবাই ওই গুহামুখ থেকে ফিরে এলেন।কেউই ভিতরে নামার সাহস পাননি।কেউ বললেন বয়স্ক অসুস্থ মানুষরা যাতে ভিতরে প্রবেশ না করেন, এমন অনুরোধ লেখা বোর্ড দেখে তারা ফিরে এসেছেন।কেউ বললেন অপরিসর প্রবেশপথ, তার উপর ৮২ ধাপ নামতে হবে শুনে তারা পিছিয়ে এসেছেন।কারো কাছে জানা গেল শিকল ধরে ঝুলে নামতে হবে দেখে তারা রিস্ক নেননি।এর মধ্যে দু’একজন যারা ভিতরে ঢুকে ছিলেন তারা ফিরে এলেন নায়কের মতো। তাদের ঘিরে ছোটোখাটো ভিড় জমে যাচ্ছে,অভিজ্ঞতা শোনার জন্য।দেখে মনে হচ্ছে এরা বুঝি কোনও শৃঙ্গ জয় করে ফিরলেন।আমি দেখছিলাম মানুষের তৃপ্ত,অতৃপ্ত মুখচ্ছবি।কয়েক শতাব্দীর মিথ আর বিশ্বাস জড়িয়ে আছে এই মন্দির ঘিরে।স্কন্দপুরাণে উল্লেখ আছে এর কথা।আদি শংকরাচার্য এখানে এসেছিলেন।এই গুহা আবিস্কার নিয়ে এক কাহিনী আছে।রাজা ঋতুপর্ণ একবার জঙ্গলের মধ্যে এক হরিণের পিছু ধাওয়া করেন কিন্তু কিছুতেই তার নাগাল পাচ্ছিলেন না।যতবার শর সন্ধান করতে যান ততবার ব্যর্থ হন।এক সময় হরিণ তার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।তাকে অনুসরণ করতে করতে রাজা এক গুহার সামনে উপস্থিত হন।গুহার দ্বাররক্ষী শেষনাগ ঋতুপর্ণকে পথ দেখিয়ে ভিতরে নিয়ে যায়।রাজা সেখানে অমরনাথ,কেদারনাথ সহ বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির দর্শন লাভ করেন।সেখানে রাজা প্রচুর ধনরত্ন ও অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করেন।শেষনাগ রাজাকে গুহার কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে দেয়।একথা কাউকে বললে রাজার মৃত্যু হবে এমন কথাও বলে দেয়।কোনও এক দুর্বল মুহুর্তে ঋতুপর্ণ তার রাণীর কাছে গুহার কথা বলে ফেলায় তৎক্ষনাৎ তার মৃত্যু হয়।এরপর রাণী গুহায় আসেন এবং ভিতরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ করেন।
ভাবনার ঘোরে অনেক সময় কেটে যায় এখনও আমাদের মধ্যে যারা ভিতরে ঢুকেছে তারা ফিরে আসেনি।চা খাওয়ার জন্য আসি পাশের হোটেলে। ভাগ্যিস এসেছিলাম ! হোটেলের জানলা দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল দিগন্তজুড়ে পহাড়ের সারি আর সেখানে সবে শুরু হয়েছে সূর্যাস্তের হোলি খেলা।পাহাড়ে পাহাড়ে মুঠোমুঠো কমলা রঙ ঝরে পড়ল পর মূহুর্তে ঝরে পড়ল সোনালী রঙ। তারপর টকটকে লাল রঙ রাঙিয়ে দিয়ে গেল পাহাড়দলকে।এক অবিস্মরনীয় দৃশ্যের সাক্ষী রইলাম।মনে কোনও অপূর্ণতা থাকল না।গুহার ভিতরের সৌন্দর্য আমরা দেখতে পেলাম না ঠিকই কিন্তু যারা ভিতরে রয়ে গেল তারাও তো এই দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হইহই করতে করতে সবাই ফিরে এল।অন্ধকার নেমে আসছে হারুদা ব্যস্ত হয়ে পড়েন।বাসের হর্ণ ডাক পাঠায়।আমরাও সাড়া দিতে দেরি করি না।সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস আমাদের চকৌরির হোটেলে পৌঁছে দিল।
(ক্রমশ)
ছবিঃ সুপর্ণা রায়চৌধুরী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here