দেবাশিস রায়চৌধুরী

আজও অ্যালার্ম বেজে ওঠার আগে ঘুম ভাঙল।আসলে বাইরে বেরোলে অন্তরঘড়ি আপন খেয়ালে চালু হয়ে যায়। তার ঘুম ভাঙানিয়া সুর ভিতরবাগে ঠিক বেজে ওঠে।বাঁদিকে অর্ধেক দেওয়াল জুড়ে পর্দাটানা কাঁচের জানলা।পর্দা সরিয়ে দিতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই।সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের সারি।আকশে চালধোয়া জল রঙ ছড়িয়ে আছে।পাহাড়ের চূড়াগুলি দৃশ্যমান তাদের দেহ এখনও কুয়াশার চাদরে মোড়া।অনেকটা নীচে মনে হয় একটা আবাসিক স্কুল।ছোটোছোটো কয়েকটা শরীর দেহচর্চায় ব্যস্ত।ঘরে আর মন রয় না।টুপি মাফলার গরম পোষাকে শরীর মুড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।কাল রাতে শুনেছিলাম ছাদ থেকে সূর্য ওঠা দেখা না গেলেও মুহূর্তটা উপভোগ করা যাবে।ছাদে উঠতেই প্রথমে যেটা উপভোগ করলাম তা হল শীত।একেবারে জম্পেশ ঠান্ডা,সাত ডিগ্রি।শীত অনুভব নিমেষে ভুলে গেলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে।আকাশ থেকে আস্তে মুছে যাচ্ছে চালধোয়া জল আর ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আতপ চালের শুভ্রতা।দূর পাহাড়ের ওপারে জেগে উঠছে আলো।যেমন পর্দা সরে যাওয়ার পর নাট্যমঞ্চ ধীরেধীরে আলোকিত হয় তেমন করেই বিক্ষিপ্তভাবে এক একটা চূড়া জেগে উঠতে থাকে।পঞ্চচুল্লি,চৌখাম্বা নন্দাদেবী আরও কিছু পাহাড়।শিখরে শিখরে লাগে রঙ।গাঢ় হতে না হতেই বদলে যায় সে রঙ।অবাক হয়ে দেখতে থাকি আমরা ক’জন মুগ্ধ দর্শক।কিছুক্ষণের মধ্যে আলোয় ভেসে যায় চারপাশ।আড়ামোড়া ভেঙে জেগে ওঠে আলমোড়ার প্রকৃতি।বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।হাতে হাতে গরম চা পেয়ে যাই, জয়ন্তবাবু তাগাদা দেন।এক ঘন্টার মধ্যে বেরোতে হবে।আজ আমাদের মুন্সিয়ারি যেতে হবে।ট্যূর প্রোগ্রাম অনুযায়ী ১৭০ কিলোমিটার আর সাত ঘন্টার জার্নি।পাহাড়ি রাস্তা যত তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করা যায় ভালো হয়।ব্রেকফাস্ট রাস্তায় সেরে নেওয়া হবে।

আবারও মনখারাপ হয়।আলমোড়াতেও আমাদের কিছু দেখা হল নাএখানে রয়েছে ১৯১৬-য় প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ আশ্রম।স্বামী বিবেকানন্দ এখানেই নিবেদিতাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন।শোনা ছিল খুব কাছেই লাখুদিয়ায় গেলে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র দেখা যায়। আলমোড়া ব্রিটিশ নির্মিত শৈলশহর নয়।কুমায়ুনের রাজা কল্যাণচাঁদ আলমোড়াকে আবিষ্কার করেন।কুমায়ুনের নিজস্ব ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে এই শহর।সেইজন্যেই হয়তো আলমোড়াকে ” কুমায়ুনের সাংস্কৃতিক রাজধানী” বলা হয়।

সকাল আটটার মধ্যে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ার কথা ছিল।বাঙালিদের যে সময়জ্ঞান খুব প্রখর এমন বদনাম অতি বড় বাঙালি বিদ্বেষীও দিতে পারবে না।অবশ্য এ’কথাও ঠিক যে,এতজন মানুষকে সঠিক সময়ে একজায়গায় জড়ো করাও চাট্টিখানি কথা নয়।তাছাড়া দলে বয়স্ক-অসুস্থ মানুষ এবং বাচ্চারা আছে।যাইহোক কিছুটা দেরি হলেও সকলে একজায়গায় হওয়া গেল।মালপত্র গাড়িতে তোলার ফাঁকে ফটোসেশন চলল।এখানে কিছুই দেখা হল না বলে,সকলেই একটু বিমর্ষ।মৃদু দাবি উঠল যাবার পথে অল্প সময়ের জন্য হলেও বিনসর ঘুরে যাওয়ার।মুন্সিয়ারির দূরত্ব এবং সময় স্বল্পতার কারণে এই দাবি খারিজ হয়ে গেল।এবার প্রস্তাব এল বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত আলমোড়ার রামকৃষ্ণ আশ্রম ঘুরে যাওয়ার।এবার বাদ সাধল বাসের ড্রাইভার।কিছুক্ষণ পর শহরে রোজকার মতো নাকী বড় গাড়ির জন্য নো এন্ট্রি লাগু হয়ে যাবে,ফলে বেরোনো মুশকিল হবে।সুতরাং আকাশে মেঘ না থাকলেও সকলেই মনের মধ্যে কয়েক দিস্তা মেঘ নিয়ে বাসে উঠল। বাস ছাড়ল সকাল সাড়ে নটা নাগাদ।শুরু হল দীর্ঘ যাত্রা। বিকেল চারটের আগে মুন্সিয়ারি পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই।

বাস চলতে শুরু করে।ক্রমে শহর ছাড়িয়ে যেতে থাকে আর আমাদের মনের মেঘও উড়ে যেতে থাকে।আর যাবে নাইবা কেন ? চারপাশের প্রকৃতি নির্ভার আনন্দে ঝলমল করছে এখানে সামান্য অপ্রাপ্তি তুচ্ছ হয়ে যায়।

প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর যাত্রা বিরতি হয়।লোকালয় খুব একটা নেই।একটা গাড়ি সারানোর দোকান,তারপাশে আর একটা বন্ধ দোকান,কিছুটা দূরে এক ডাগদার সাবের দাওয়াখানা ব্যস, ঔর কুথাও কুছভি চোখে পড়ছে না।দোকানের পিছনে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেশ খানিক নীচুতে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে।যেখানে আমরা আছি তার একপাশে দোকানঘর অন্যপাশে খাড়া পাহাড়।উপরে গভীর জঙ্গল।বন্ধ দোকানের সামনের সিঁড়িতে নামানো হয়েছে জলখাবারের পাত্র।মেনু লুচি,তরকারি।শীতের হাওয়া আর রোদ্দুর গায়ে মেখে ছড়িয়েছিটিয়ে বেশ পিকনিকের মেজাজে ব্রেকফাস্ট পর্ব শেষ হল।ছোটো গাড়িগুলো আগে বেরিয়ে গেল কিন্তু আমাদের বাসের ড্রাইভার ও খালাসি তখনও পাশের গ্যারেজের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছে।ওদের তাগাদা দিতে গিয়ে জানা গেল বাসের স্টেপনিমে থোড়া গড়বড় হ্যায়।কাম চল রহা হ্যায়,জাদা সে জাদা দশ মিনিট ঔর লাগেগা।লাগে তো লাগুক।ধূমপায়ীরা সুযোগের সদ্ব্যবহারে সচেষ্ট হলেন।আমি পানাসক্ত নই।আবার তপস্বীও নই।তাই সবসময় দোদুল্যমান অবস্থায় থাকি।এই পর্যায়ে প্ররোচনা ভয়ংকর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটায়।এক্ষেত্রে আমার হাফপ্যান্টবেলার বন্ধু পুঁটে সেই দায়িত্ব নিল।ছেলেবেলার কয়েকশো দুষ্টুমির পার্টনার শৈশব স্মৃতি উস্কে দিয়ে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়।অগত্যা বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ধোঁয়া ওড়াই(বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ :তামাক ক্যান্সারের কারণ)।ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় বেলা গড়িয়ে যায় কিন্তু স্টেপনি স্টেপ নিয়ে সমস্যা কাটে না।চল্লিশ মিনিট পর স্টেপনি বাসে ওঠে সাথে আমরাও।সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে।গান গল্প আড্ডায় বাস জমজমাট। পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস চলেছে।ঘন অরণ্য অনেক নীচু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পর্বত সানুদেশে কিছুটা সমতল তারপর আবার উঠেছে পর্বত শিখরের দিকে।অজস্র পাখির ডাকে ভরে আছে চারপাশ। জনবসতি চোখে পড়ে না।আলোছায়াময় আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের এক আশ্চর্য মাদকতা গ্রাস করে।প্রকৃতি হাতছানি দেয়।সেই ডাক উপেক্ষা করা সহজ নয়।প্রকৃতির ডাকে কেউকেউ উশখুশ করে ওঠে। বাস থামে।অনেকেই প্রকৃতির নির্জনতায় ছুটে যায়।এই অবসরে পরশ,অমিয়,শুভংকর ফটোশ্যুটে ব্যস্ত সেরে নেয়।মিনিট কুড়ি পর আবার চলা শুরু হয়।তবে বেশিদূর যাওয়া হয় না।ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাস থমকে যায়।রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে ফলে যান নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে।আগের গাড়িগুলো দিব্যি বেরিয়ে গেল।বাসের সামনের দুটো গাড়ির আগে নোএন্ট্রি বোর্ড লেগে গেল।পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট পর নিস্কৃতি মিলল।দুপুর নিভে আসছে। খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।অথচ খাওয়ার সম্ভাবনা দূর অস্ত।কারণ দুপুরের খাবার রয়েছে আমাদের সাথের ছোটো গাড়িগুলোতে,কিন্তু তারা আমাদের ফেলে বেশ কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেছে।ফোন করলে উত্তর আসছে চলে এসো আমরা অপেক্ষা করছি।কতদূর তা বোঝা যাচ্ছে না।এখন আর কারো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে মন নেই। গল্প, গান স্তব্ধ।শুধু পেটে আর কানে পুরোনো গানের লাইন গুনগুনিয়ে উঠছে, “কতদূর আর কতদূর বল মা”! সাড়ে তিনটে নাগাদ দেখা তাদের দেখা পাওয়া গেল।হাক্লান্ত বাসযাত্রীদের তখন খাওয়ার ইচ্ছে প্রায় নেই।সবচেয়ে ছোটো পাপান ঘুমিয়ে পড়েছে।কোনক্রমে খাওয়া শেষ করে বাস ছাড়তে প্রায় সাড়ে চারটে হল।আমাদের দলের অন্য গাড়িগুলো আমরা এখানে পৌঁছানোর অনেক আগেই রওনা হয়ে গেছে।এখান থেকে মুন্সিয়ারি আশি কিলোমিটার।

পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে এলে তেমন কিছু দেখার থাকে না।স্বাভাবিক নির্জন পথ অন্ধকারে আরও নির্জন হয়ে ওঠে।বাইরে কিছুই দেখা যায় না।উল্টোদিক থেকে আসা গুটিকয় গাড়ির হেডলাইটে মাঝেমাঝে বোঝা যাচ্ছে পাশের খাদ অথবা জঙ্গলের অস্তিত্ব।বাসের ভিতর সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছে।

এখন চা চা করে প্রাণ করে আনচান।কিন্ত চাইলেই চা মেলে না।মাইলের পর মাইল পেরিয়ে যাচ্ছি অথচ কোনও জনপদ নেই।অবশেষে একজায়গায় বাস থামল।ড্রাইভার জানাল এখানে চা মিলবে।বাস থেকে নামতেই ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।একটামাত্র দোকান।চা থেকে আনাজপাতি সব পাওয়া যায়।কাছেই ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিসের ভরসাতে দোকান চলে।দোকানি বেশ আপ্যায়ন করে ভিতরে বসতে বললেন।ভিতরে চারজন ফরেস্ট গার্ড ক্যারাম খেলছেন।”হামভি খেলেঙ্গে”,বলে অলক ওদের পাশে বসে পড়ল।হাঁ জি,হাঁ জি বলে একজন হাসিমুখে জায়গা ছেড়ে দিল।”হামারা সাদা না কালো গুটি”?, অলকের প্রশ্নের উত্তরে একজন জানায় সফেদ কালা সব বরাবর আছে।এখানে আপনা আপনা মর্জিমে খেল চলে।এখেলার নিয়ম বুঝতে দিমাগ লাগে।শেষে বোঝা যায় চারজনেই সাদা কালো লাল সব গুটি ফেলতে পারে।শুধু কেউ নিজের বেসের(কোলের)গুটি ফেলতে পারবে না।অবাক অলক জানতে চায়,তাহলে হারজিত বোঝা যাবে কীভাবে! উত্তরে ওরা তাজ্জুব কী বাত শোনায়।এতো কোই লড়াই কা ময়দান নেহি। স্রিফ টাইমপাস কে লিয়ে যে খেল তাতে হারজিতের কোনও জরুরত আছে কী ! ঠিকই তো,এভাবে কখনও ভাবিনি। আমরা ঘরে বাইরে লড়তে লড়তে কখন যেন খেলাকেও যুদ্ধের সমপর্যায়ে নিয়ে গেছি।এখন খেলার ময়দান আর নিছক বিনোদনভূমি নয় যুদ্ধক্ষেত্রও বটে।গরম চা আমাদের খানিকটা চনমনে করে দিল।আবারও বাস চলল।বোঝা যাচ্ছে আরও খাড়াই পথে গাড়ি চলছে।রাস্তাও ক্রমশ খারাপ হচ্ছে সেটা ঝাঁকুনিতে মালুম হচ্ছে।এই রাতে আমদের বাস ছাড়া আর কোনও গাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।ড্রাইভার খুব সতর্কতার সাথে আস্তে আস্তে চালাচ্ছে।হেডলাইটের আলোয় মাইলস্টোনের লেখা পড়ে ফেলা যাচ্ছিল।সেখানে মুন্সিয়ারির দূরত্ব চার কিলোমিটার দেখা যেতেই সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

দূরের পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো আলোর বিন্দু জনবসতির আভাস দিচ্ছিল।রাত নটার পর আমাদের বাস মুন্সিয়ারির হোটেলে পৌঁছাল।আক্ষরিক অর্থে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকলাম।এখন মুন্সিয়ারির তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here