কত দিতে হবে ? এই প্রশ্ন শুনে নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেয় যে কুছ ভি নেহি চাহিয়ে।তাকে বিশওয়াস করেই তো বাবুলোগের পরেশান,তাই এটা তার দায়িত্ব। কুলিগিরি তার রোটিরোজি, বিশ সাল ধরে ইমানদারির সাথে সে এই কাজ করছে।আজ বে-ইমান হবে কী করে! আমাদের অন্য কুলি খুঁজতে বারণ করে, টিরেন বহোত লেট ভি আছে, ইনাউন্স হলেই এসে সামান নিয়ে যাবে বলে, সে অন্য প্যাসেঞ্জারদের মাল টানতে চলে যায়।
সকালে আক্ষেপ ছিল স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ভালোত্ব তেমন অনুভব করতে পারিনি বলে।এখন ভিতরে ভিতরে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে থাকি।আসলে আমরা দেখতে শিখিনি।এই গজল ঠুমরির দেশে আমার কানে লালন সাঁই,রামপ্রসাদের গান ভেসে আসে,” বাড়ির পাশে আরশিনর সেথা এক পড়শি বসত করে,আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”।আহা এমন মানবজমিন পতিত রয়ে গেল ! সেখানে সীমিত আবাদে যেটুকু সোনা উঠল তাও বা আমি ছুঁতে পারলাম কই !
একবুক অতৃপ্তি নিয়ে এক কোণে চুপচাপ বসে থাকি।লক্ষ্ণৌতে কিছুই দেখা হল না।কাল রাতে বড়া ইমামবাড়ায় গাইড বলেছিল সকাল ছটার সময় গেলে ভুলভুইয়া দেখিয়ে দেবে।কে জানত ট্রেন এত লেট হবে।জানলে তো ঘুরেই আসা যেত,নবাব বেগমদের লুকোচুরির খেলার রম্যক্ষেত্র।দেখা হল না সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতি জড়ানো রেসিডেন্সি।টাঙ্গা চড়ে নগর সফর না করেই লক্ষ্ণৌ ছেড়ে যাচ্ছি।লক্ষ্ণৌ ছাড়ার কথা মনে হতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে মনে পড়ে।ইংরেজ অযোধ্যা দখল করার পর তাঁকে নির্বাসিত করে। নির্বাসিত নবাব শেষ জীবন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে কাটান।সঙ্গীতপ্রেমী নবাবের দেশত্যাগের করুণ আর্তি ফুটে উঠেছিল তাঁর রচিত ঠুমরি গানে।চিন্তার রেশ ছিঁড়ে যায় লালকুঁয়া এক্সপ্রেসের আগমন সংবাদ ঘোষণা শুনে।আমাদের হয়রানি আর না বাড়িয়ে সাত নম্বর প্ল্যটফর্মেই তার আসা নিশ্চিত হয়।
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যায় ট্রেন। ক্রমে শহর দূরে সরে যেতে থাকে আর লক্ষ্ণৌ ছাড়ার সময় ওয়াজেদ আলী শাহকে মনে পড়বে না তা কি হয় ! মনে পড়ে দেশত্যাগের বেদনায় রচিত তাঁর বিখ্যাত ঠুমরির কয়েক পংক্তি, ” যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী /কহুঁ হাল আদম পর ক্যা গুজরী”।
এর পরের কয়েক ঘন্টা ক্লান্তি আর বিরক্তিতে ভরপুর।শেষ বিকেলে ট্রেন লালকুঁয়া পৌঁছাল।এখান থেকেই আলমোড়া যেতে হবে।আমরা ছাব্বিশজন একটা বাসে,বাকিরা ট্রাভেলা,সুমো জাতীয় ছোটো গাড়িতে।সন্ধ্যের মুখে আমাদের কনভয় যাত্রা শুরু করল।বাসে বসে বাইরে উপভোগ করার মতো কোনও দৃশ্য নেই।মাঝেমধ্যে পথচলতি গাড়ির আলো ঝলকানি অথবা দোকান বাজারের খণ্ডখণ্ড আলো,যা অন্ধকার ক্যানভাসে কোলাজচিত্রের মতো জুড়ে যাচ্ছে,মুছে গিয়ে আবার নতুন চিত্র তৈরি করছে। ভিতরে আমরা তখন ক্লান্তিকর প্রহর যাপন করে চলেছি।
রাত সাড়ে দশটায় আমরা আলমোড়া হোটেলে পৌঁছলাম।ট্রেন লেট না করলে এখানে দুপুর বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা ছিল।এতক্ষণ বিনসর,আলমোড়া ঘুরে এসে বিশ্রাম নিতে পারতাম,তার পরিবর্তে হোটেলে এই আমদের প্রথম পদার্পণ ঘটল।লক্ষ্ণৌ থেকে এখানে তাপমাত্রার হেরফের কয়েক ডিগ্রি।চারতলার খোলা ছাদে আমরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, গুগল জানাল তখন তাপমাত্রা আট ডিগ্রি। আলমোড়ায় সূর্যোদয় ছটা কুড়িতে।প্রচন্ডরকম ক্লান্ত, ফলে এমনিতে ঘুম ভাঙবে কীনা ভরসা নেই।অগত্যা মোবাইল অ্যালার্মের উপরেই ভরসা রাখতে হয়।তারপর নিতান্ত কম বলের শরীরটাকে কম্বলের উষ্ণতায় সঁপে দিই।
(ক্রমশ)।
ছবি। ১.আলমোড়া।
২.আলমোড়া হোটেল।
৩.লক্ষ্ণৌ শহর।