দেবাশিস রায়চৌধূরী: ট্রাভেলগ: আমাদের হোটেলের নাম ছিল গোল্ডেন প্যালেস। নামটা শুনতে যতটা রাজকীয়, ব্যবস্থাপনায় ততটাই মধ্যবিত্তসুলভ।যাই হোক কয়েক ঘন্টার ব্যাপার যখন সয়ে নেওয়া যায়।ঠিক ছিল রাত বারোটায় বেরোনো হবে।অ্যালার্ম সেট করা ছিল।সাড়ে এগারোটায় উঠে দেখি কারো কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।দরজা খুলে উঁকিঝুঁকি মারি,কেউ কোত্থাও নেই।কেলো করেছে,সবাই স্টেশনে চলে গেল না কি ! ভয়ে ভয়ে পূর্ণকে ফোন করি,রিং হয়ে যায়,উত্তর আসে না।মাঝরাতে টেনশন বাড়ে।এবার পরশকে ফোন করি।আমার চাপ কমিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় সে বলে,”কাকু ঘুমিয়ে নাও ট্রেন প্রায় তিন ঘন্টা লেট চলছে।দুটোর আগে বেরোনো হবে না।আমি তোমাকে ডেকে দেব”।যাক এবার নিশ্চিন্ত।পাশে আরও নিশ্চিন্তে গৃহিণী ঘুমিয়ে আছেন।কার যেন ডায়লগ ছিল — টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা হ্যায়,সেটা হাড়েহাড়ে মালুম হয়।সেইজন্য “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” এ কথা জেনেও পরশের প্রতি বিশ্বাস না রাখার পাপ করে ফেলি।সে পাপের সাক্ষী থাকল মোবাইলে নতুন করে রাত দেড়টায় সেট করা অ্যালার্ম।যদিও অ্যালার্মের আর প্রয়োজন হয় না।একটার পর থেকেই করিডরে হাঁটাচলা কথাবার্তার শব্দ স্পষ্ট হয়।ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি মহিলা মহলে জমে উঠেছে।বিষয় রাত বারোটার পর সকলের নিদ্রার বারোটাত্ব প্রাপ্তির পর্যালোচনা। আড্ডায় বাঙালির না নেই,সময়জ্ঞানও নেই।ক্রমাগত হাহা হিহি শুনে আমার গৃহিণী সহ গুটিগুটি আরও দুএকজন এন্ট্রি নিলেন।পরশ জানাল হারুদা বলেছেন চারটেয় বেরোনো হবে এবং এটা ফাইনাল।

সাতাশ তারিখের ঊষালগ্নে হোটেল গোল্ডেন প্যালেসের ডেন লেস হবার আনন্দে আমরা সকলে স্টেশনের দিকে চললাম।

সব জায়গাতেই ভালো ও মন্দ স্বভাবের মানুষজন থাকে,তবে আমাদের দুর্ভাগ্য গত সন্ধ্যায় আমদের সাথে যে কজন স্থানীয় মানুষের আলাপচারিতা হয়েছে তাতে ভালোত্বের ছিঁটেফোঁটাও পাইনি।সকালে স্টেশন যাওয়ার পথে অটোচালকও সেই ট্র‍্যাডিশনের কোনও ব্যত্যয় ঘটালেন না।লালকুঁয়া এক্সপ্রেস সাধারণত সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে এক থেকে সাতে লাগেজ নিয়ে যাওয়া বেশ দুরুহ।পুর্ব অভিজ্ঞতার ফলে বেশ ভয়ে ভয়ে কুলির সাথে কথা বলতে হল।সেও নিশ্চিত হয় জানাল ট্রেন সাতেই আসবে।দরদস্তুর করে আমাদের কয়েকজনের মালপত্তর তার ট্রলিতে তুলে দেওয়া হল।সাবওয়ে পেরিয়ে ওভারব্রিজ টপকিয়ে জানমাল সহযোগে সে আমাদের সাত নম্বরে পৌঁছে দিয়ে, পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে চলে গেল।সাতসকালে সাতের চক্করে পড়লাম।সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে যারা আগে থেকে অপেক্ষা করছেন তারা জানালেন যে সাতটা নাগাদ ট্রেন আসার সম্ভাবনা।এরপর সময় কাটানোর জন্য চাতকের মতো বারবার চা-তক যাওয়া আসা ছাড়া কিছু করার নেই।হঠাৎ কেউ একজন এসে খবর দিল ট্রেন সাত নয় পাঁচ নম্বরে আসবে।বিদেশে এরকম সাতপাঁচ কথায় কান দিতে নেই ভেবে চুপ থাকি।কিন্তু কথাটা পাঁচকান হতে সময় লাগে না।সকলের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে। আবার তল্পিতল্পা নিয়ে পাঁচে যেতে হবে।কী মুশকিল ! আবারও কুলি পাকড়ানো আসান কাম নয়।তবে প্রায় ছুটতে ছুটতে আমাদের পূর্বপরিচিত কুলি মুশকিলআসান হয়ে হাজির। সে জানাল তার বিলকুল জানা ছিল না যে টিরেন আজ আচানক পাঁচ নম্বরমে লাগবে।সে আমাদের কোনো মুসিবত হতে দেবে না।সামানউমান সে নিজেই পাঁচে পৌঁছে দেবে।আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি।স্বভাবতই দরদামের দরকার পড়ে। সে কতটা দাঁও মারতে চাইছে বুঝে নেওয়া দরকার।

কত দিতে হবে ? এই প্রশ্ন শুনে নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেয় যে কুছ ভি নেহি চাহিয়ে।তাকে বিশওয়াস করেই তো বাবুলোগের পরেশান,তাই এটা তার দায়িত্ব। কুলিগিরি তার রোটিরোজি, বিশ সাল ধরে ইমানদারির সাথে সে এই কাজ করছে।আজ বে-ইমান হবে কী করে! আমাদের অন্য কুলি খুঁজতে বারণ করে, টিরেন বহোত লেট ভি আছে, ইনাউন্স হলেই এসে সামান নিয়ে যাবে বলে, সে অন্য প্যাসেঞ্জারদের মাল টানতে চলে যায়।

সকালে আক্ষেপ ছিল স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ভালোত্ব তেমন অনুভব করতে পারিনি বলে।এখন ভিতরে ভিতরে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে থাকি।আসলে আমরা দেখতে শিখিনি।এই গজল ঠুমরির দেশে আমার কানে লালন সাঁই,রামপ্রসাদের গান ভেসে আসে,” বাড়ির পাশে আরশিনর সেথা এক পড়শি বসত করে,আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”।আহা এমন মানবজমিন পতিত রয়ে গেল ! সেখানে সীমিত আবাদে যেটুকু সোনা উঠল তাও বা আমি ছুঁতে পারলাম কই !

একবুক অতৃপ্তি নিয়ে এক কোণে চুপচাপ বসে থাকি।লক্ষ্ণৌতে কিছুই দেখা হল না।কাল রাতে বড়া ইমামবাড়ায় গাইড বলেছিল সকাল ছটার সময় গেলে ভুলভুইয়া দেখিয়ে দেবে।কে জানত ট্রেন এত লেট হবে।জানলে তো ঘুরেই আসা যেত,নবাব বেগমদের লুকোচুরির খেলার রম্যক্ষেত্র।দেখা হল না সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতি জড়ানো রেসিডেন্সি।টাঙ্গা চড়ে নগর সফর না করেই লক্ষ্ণৌ ছেড়ে যাচ্ছি।লক্ষ্ণৌ ছাড়ার কথা মনে হতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে মনে পড়ে।ইংরেজ অযোধ্যা দখল করার পর তাঁকে নির্বাসিত করে। নির্বাসিত নবাব শেষ জীবন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে কাটান।সঙ্গীতপ্রেমী নবাবের দেশত্যাগের করুণ আর্তি ফুটে উঠেছিল তাঁর রচিত ঠুমরি গানে।চিন্তার রেশ ছিঁড়ে যায় লালকুঁয়া এক্সপ্রেসের আগমন সংবাদ ঘোষণা শুনে।আমাদের হয়রানি আর না বাড়িয়ে সাত নম্বর প্ল্যটফর্মেই তার আসা নিশ্চিত হয়।

প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যায় ট্রেন। ক্রমে শহর দূরে সরে যেতে থাকে আর লক্ষ্ণৌ ছাড়ার সময় ওয়াজেদ আলী শাহকে মনে পড়বে না তা কি হয় ! মনে পড়ে দেশত্যাগের বেদনায় রচিত তাঁর বিখ্যাত ঠুমরির কয়েক পংক্তি, ” যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী /কহুঁ হাল আদম পর ক্যা গুজরী”।

এর পরের কয়েক ঘন্টা ক্লান্তি আর বিরক্তিতে ভরপুর।শেষ বিকেলে ট্রেন লালকুঁয়া পৌঁছাল।এখান থেকেই আলমোড়া যেতে হবে।আমরা ছাব্বিশজন একটা বাসে,বাকিরা ট্রাভেলা,সুমো জাতীয় ছোটো গাড়িতে।সন্ধ্যের মুখে আমাদের কনভয় যাত্রা শুরু করল।বাসে বসে বাইরে উপভোগ করার মতো কোনও দৃশ্য নেই।মাঝেমধ্যে পথচলতি গাড়ির আলো ঝলকানি অথবা দোকান বাজারের খণ্ডখণ্ড আলো,যা অন্ধকার ক্যানভাসে কোলাজচিত্রের মতো জুড়ে যাচ্ছে,মুছে গিয়ে আবার নতুন চিত্র তৈরি করছে। ভিতরে আমরা তখন ক্লান্তিকর প্রহর যাপন করে চলেছি।

রাত সাড়ে দশটায় আমরা আলমোড়া হোটেলে পৌঁছলাম।ট্রেন লেট না করলে এখানে দুপুর বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা ছিল।এতক্ষণ বিনসর,আলমোড়া ঘুরে এসে বিশ্রাম নিতে পারতাম,তার পরিবর্তে হোটেলে এই আমদের প্রথম পদার্পণ ঘটল।লক্ষ্ণৌ থেকে এখানে তাপমাত্রার হেরফের কয়েক ডিগ্রি।চারতলার খোলা ছাদে আমরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, গুগল জানাল তখন তাপমাত্রা আট ডিগ্রি। আলমোড়ায় সূর্যোদয় ছটা কুড়িতে।প্রচন্ডরকম ক্লান্ত, ফলে এমনিতে ঘুম ভাঙবে কীনা ভরসা নেই।অগত্যা মোবাইল অ্যালার্মের উপরেই ভরসা রাখতে হয়।তারপর নিতান্ত কম বলের শরীরটাকে কম্বলের উষ্ণতায় সঁপে দিই।

(ক্রমশ)।

ছবি। ১.আলমোড়া।

২.আলমোড়া হোটেল।

৩.লক্ষ্ণৌ শহর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here