দেশের সময়: আমরা বাজারে গিয়ে চকচকে চাল কিনি, যাতে ভাত ধবধবে সাদা হয়। কিন্তু পালিশ করা এই চালে কোনও গুণ নেই। কারণ, মেশিনে পালিশ করতে গিয়ে উঠে যায় চালের উপরের ত্বকে থাকা ফাইবার।এই ফাইবারের মধ্যে থাকে আসল পুষ্টিগুণ। সুতরাং, আমরা দাম দিয়ে যে চাল কিনি, তার আসলে কোনও উপকারিতা নেই। তাহলে কোন চাল কিনব? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন কালো চালের ভাত খান। হাজারো রোগ থেকে দূরে থাকবে শরীর।

কালো, সে তো জগতের আলো।
আর কালো চাল! একেবারে ‘সুপার ফুড’।
বিনা ওষুধে সুস্থ থাকার ট্যাগ লাইন হতেই পারে, ‘ভাত রাখবে ফিট, কালো চাল হিট’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো চালের জাদুতেই উধাও হবে শরীরে বাসা বাঁধা নানা রোগ-ব্যাধি। ক্যান্সার থেকে ডায়াবেটিস, রুখে দিতে পারে এই চাল। এমনকী ইদানীং কালের অন্যতম সমস্যা ওবেসিটি কব্জা করতেও এই চালের জুড়ি মেলা ভার।


আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে, খাবারই ওষুধ। কালো চালের ভাত ঠিক তেমনই। কৃষি বিজ্ঞানী থেকে পুষ্টিবিদরা বলছেন, প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ব্ল্যাক রাইস শরীরে ডি টক্সিফিকেশনে সাহায্য করে। হার্ট ভালো রাখে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। খারাপ কোলেস্টরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়। লিভার সুস্থ রাখে। সেকারণে কালো চালের ভাতকে সপ্তাহে অন্তত তিনদিন ডায়াটে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরাও।

আধুনিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের কারণে অসুখ বিসুখের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকে ভাত খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও ভাত থেকে পাওয়া গ্লাইকোজেন গলতে সময় নেওয়ায় শরীরে মেদের পরিমাণ বাড়ে। ফলে মোটা হয়ে যাওয়া ঠেকাতেও বহু মানুষ আজকাল ভাতকে বাতিলের তালিকায় ঠেলে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটছে না।

গবেষকদের দাবি, মুশকিল আসান হতে পারে ব্ল্যাক রাইস। দেখতে কালো। কিন্তু খেতে ভালো। দেখতে সুন্দর বাজারে পালিশ করা সাদা ধবধবে চালের রূপের সঙ্গে পেরে উঠবে না ঠিকই, কিন্তু গুণে হাজার গোল দেবে এই চাল।

আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (এসিএস)-র ২৪০তম জাতীয় আলোচনা চক্রে বলা হয়েছে, এক চামচ কালো চালে অ্যান্থোসায়ানিন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে এক চামচ ব্লু-বেরির চেয়েও অনেক বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যে ব্ল্যাক রাইসের চাষ বাড়াতে কাজ করে চলা সহকারি কৃষি অধিকর্তা ডঃ অনুপম পাল জানিয়েছেন, আসলে ব্ল্যাক রাইসের ভাত ভেষজ ওষুধ। এই ভাত শুধু যে পুষ্টিগুণে ভরপুর তা নয়। বহু রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার কৃষক প্রদ্যুত সামন্ত কালাভাত গুঁড়ো করে তার সঙ্গে বাদাম, চিনি, ছাতু মিশিয়ে স্বাস্থ্যবর্ধক পানীয় তৈরি করেছেন। তা বিক্রিও হচ্ছে। হুগলির চন্ডীতলায় আটা ও কালাভাতের গুঁড়োর মিশ্রণে রুটি তৈরি করে খাওয়ানো হচ্ছে। কালাভাতের বিস্কুট তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার একডালিয়া এভারগ্রিন রোডের একটি রেস্তরাঁয়। পায়েস, পাস্তাও হচ্ছে। মণিপুরে কালো চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠে খাওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এই চালের ভাত খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক কম হয়। সেকারণে একে অ্যান্টি-ডায়াবেটিস রাইসও বলা হয়। জিঙ্ক থাকায় এই চালের ভাত প্রসূতিদের ক্ষেত্রে পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কালো চালে রয়েছে ভিটামিন ই। যার কাজ, চোখ ও ত্বককে ঠিক রাখা। এর ক্যালোরি অনেক কম। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

গবেষণা বলছে, ধমনিতে অ্যাথরোস্ক্লেরোসিস ঠেকাতে ও প্লাক গঠনে বাধা দেয় কালো চালে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। ব্ল্যাক রাইসের অ্যান্থোসায়ানিনের মধ্যে থাকা ফাইটো কেমিক্যাল খারাপ কোলেস্টরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়। লিভার থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায়। ফাইবার বেশি থাকায় এই চালের ভাত খেলে অল্পতে পেট ভরে যায়। হজমশক্তি বাড়ে। এর অ্যান্থোসায়ানিন শরীরে ফ্রি র‌্যাডিক্যালের বৃদ্ধি রুখে দেয়।

পুষ্টিবিদদের মতে, দেশ-বিদেশে এই চাল নিয়ে গবেষণা চলছে। এই চালের ভাত মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। বার্ধক্য, স্নায়ুরোগ ঠেকায়। চিকিৎসকদের মতে, অন্যান্য চালের তুলনায় কালো চালে ফাইবার বেশি।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বেশি থাকায় প্রদাহজনিত রোগ সারাতে এই চালের ভাত কাজে আসতে পারে।
অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর প্রাণ রসায়ন ও পুষ্টি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ডাঃ দেবনাথ চৌধুরি বলেছেন, ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম আমি এই চালের ভাত খাই। কালো চাল নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। এর যথেষ্ট গুণাগুন রয়েছে। সাধারণ চালের তুলনায় পুষ্টিমূল্যও অনেক বেশি। ফলে কালো চালের ভাত খাওয়া যেতেই পারে।


কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ অর্ণব সেনগুপ্ত বলেছেন, আমিও ব্ল্যাক রাইস খেয়েছি। মন্দ নয়। কালো চাল নিয়ে গবেষণায় অনেক কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু মানবদেহের উপর রোগ প্রতিরোধ কিংবা রোগ নিরাময়ে এই চালের থেকে তৈরি ভাতের কতটা কার্যকারিতা রয়েছে, তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আরও গবেষণার প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।

অলটারনেটিভ মেডিসিন নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ডাঃ দেবাশিস বক্সি ব্ল্যাক রাইসের গুণে মুগ্ধ। তিনি বলেন, আমি রোগীদের নিয়মিত কালো চালের ভাত খাওয়ার পরামর্শ দিই। এই চাল একেবারে ওষুধের মতো। এর উপকারিতা সম্পর্কে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে।
বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অরূপ দাসবিশ্বাস অবশ্য বলছেন, ব্ল্যাক রাইস নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনও মতামত নেই। এই চালটি সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেসব এখনও প্রমাণিত নয়।

কালো চালের গুণ দেখে রাজ্য সরকার এর চাষের এলাকা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। বাংলার কালো চাল বিদেশেও যাচ্ছে। জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ব্ল্যাক রাইস বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকা কেজি দরে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ চালের তুলনায় কালো চালের ভাত রান্না করতে বেশি সময় লাগে। সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে প্রেসার কুকারে ৫টি বাঁশি দিয়ে রান্না করতে হবে। ফ্যান গলিয়ে ভাত খেতে চাইলে এক কাপ চালের জন্য দু’কাপ জল দিতে হবে রান্নায়। কালো চাল ধোয়া জল শিশুদের টনিক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, এতটাই গুণ এর। একবার পরখ করে দেখতে ক্ষতি কি!

গোটা পৃথিবীতে ব্ল্যাক রাইসের ৬০টিরও বেশি জাত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় চিন, জাপান, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও উত্তরপূর্ব ভারতের মণিপুরে। আমাদের দেশে কালো চালের ইতিহাস বহু প্রাচীন। শুরুর দিকে বিক্ষিপ্তভাবে চাষ হতো। এর পর প্রায় ৩০০ বছর কালো চালের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে রাখে চিনের মিঙ্গ রাজারা (১৩৬৮-১৬৪৪)।

সাধারণ মানুষের এই চালের উপর কোনও অধিকার ছিল না। ভারতে ব্ল্যাক রাইসের ২০টিরও বেশি জাত রয়েছে। ১০০ গ্রাম ব্ল্যাক রাইসে ৩২৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত অ্যান্টি অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এ রাজ্যে ব্ল্যাক রাইসের ‘কালাভাত’ জাতটি মূলত বেশি চাষ হয়। মহারাষ্ট্র থেকে জাতটি আনা হয় এখানে। ১০০ গ্রাম ব্ল্যাক রাইসে ৮.৫ গ্রাম প্রোটিন, ৩.৫ মিলিগ্রাম আয়রন, ৪.৯ গ্রাম ফাইবার পাওয়া যায়। সাদা ও বাদামি চালের সঙ্গে তুলনা করলে যা দাঁড়ায় তা হল, কালো চালে সবচেয়ে বেশি প্রোটিন এবং বাদামি চালের দ্বিগুণ ফাইবার রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here