দেশের সময়: আজ শুভ রথযাত্রা। দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও পুণ্যার্থী পুরীতে। রথের রশি টানার জন্য অধীর অপেক্ষা করছেন তাঁরা। পুরীর রথ ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনী। যেমন জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন যে, পুরীতে প্রভু জগন্নাথদেবের যে রথটি তৈরি হয়, সেটি সম্পূর্ণভাবে কাঠের। এবং রথটি তৈরির জন্য একটিও পেরেক ব্যবহার করা হয় না। রথ তৈরির জন্য যে কাঠ ব্যবহার করা হয়, তা সংগ্রহ শুরু হয় বসন্ত পঞ্চমী থেকেই। আর রথের নির্মাণ ও নকশা তৈরির কাজ শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়।
পুরীতে তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তৈরি স্বপ্নে বিষ্ণু মন্দির গড়ার নির্দেশ পান। তবে সেই মন্দির কেমন হবে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। অবশেষে নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় শ্রীমন্দির।
জগন্নাথদেব যে রথে চড়ে আজ মাসীর বাড়িতে যাবেন, সেই রথের নাম নন্দীঘোষ। বলভদ্র ও সুভদ্রার রথের নাম তালধ্বজ ও দর্পদলন। রথে জগন্নাথদেবের সঙ্গী হন মদনমোহন। এই রথের উচ্চতা ৪৫ ফুট। সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা থাকে রথে। রথের গায়ে থাকে সোনালী ও হলুদ রং। রথের মাথায় যে পতাকা থাকে, তার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী। রথে থাকে চারটি ঘোড়া। বলভদ্রের রথে সঙ্গী হন রামকৃষ্ণ। তালধ্বজ রথের উচ্চতা ৪৪ ফুট। ছ’ফুট ব্যাসের এই রথে মোট ১৪টি চাকা থাকে। ৭৬৩টি কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় এই রথ।
লাল ও সবুজ কাপড় থাকে এই রথে। তালধ্বজ রথের রক্ষীর নাম বাসুদেব। বলভদ্রের রথে থাকেন ন’জন দেবতা। সুভদ্রার দর্পদলন রথে থাকেন সঙ্গী সুদর্শনা। এই রথের উচ্চতা ৪৩ ফুট। এই রথটিতে মোট ১২টি চাকা থাকে। লাল ও কালো কাপড়ে সাজানো হয় এই রথটি। দর্পদলন রথের সারথীর নাম অর্জুন। এই রথের মাথায় যে পতাকা থাকে, তার নাম নদম্বিকা।
রথের আগে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে ১০৮ কলসি জল দিয়ে স্নান করানো হয়। এই অনুষ্ঠানটি স্নানযাত্রা নামে পরিচিত। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, স্নানযাত্রার পরই জগন্নাথদেবের জ্বর আসে। তখন তিনি পনেরো দিন বন্ধ দরজার আড়ালে থাকেন। এরপর রথের আগের দিন পুনঃআবির্ভাব হয় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার। নবযৌবন বেশে ভক্তের সামনে আসেন তাঁরা। প্রথমে অঙ্গরাগ, তারপর নেত্রদান রীতি সেরে হয় নবযৌবন দর্শন।
এই অনুষ্ঠান দেখতে প্রতি বছরের মতো এবারও গতকাল অর্থাৎ সোমবার পুরীতে বহু পুণ্যার্থী ভিড় জমিয়েছিলেন শ্রীমন্দিরে। মন্দির কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, রথের প্রস্তুতির জন্য সোমবার বেলা এগারোটায় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগে অন্তত সাত হাজার পুণ্যার্থী টিকিট কেটে শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করেন নবযৌবন দর্শন অনুষ্ঠান দেখতে।
এখন আর রাজা নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে রীতি। ফি বছর পুরীতে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন রাজ পরিবারের সদস্য। তিনিই রাজা উপাধি প্রাপ্ত। জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার রথের সামনে তিনি ফুল ও সুগন্ধী জল ছিটিয়ে সোনার ঝাঁটা দিয়ে রথ যাওয়ার জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে।
নিয়ম মেনে প্রতি বছর ২২টি সিঁড়ি বেয়ে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে নামানো হয়। একে বলে বৈশি পঁহচা। মন্দিরের সিংহদুয়ার থেকে কুর্মবেড়া পর্যন্ত এই বৈশি পঁহচার প্রতিটি ধাপ খোন্ডালাইট পাথর দিয়ে তৈরি।
কথিত আছে, জগন্নাথদেবের রথের নামকরণ করেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। জগন্নাথদেবের রথ তৈরি করতে দু’মাস সময় লাগে। এই সময়ে বেশকিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কাঠ নির্বাচন। কাঠ সোজা ও খাঁটি হতে হবে। রথ পুরোপুরি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কারিগররা কেউ বাড়ি বা অন্য কোথাও যান না।
যেখানে রথ তৈরি হচ্ছে, সেখানেই থাকতে হয় তাঁদের। একই সময়ে তাঁরা প্রতিদিন আহার করেন। কেউ আমিষ ভোজন করেন না। অত্যন্ত ছিমছাম খাবার খেতে হয় তাঁদের। ব্রহ্মচর্য পালন করা বাধ্যতামূলক। সুতক বা পাটকের মতো কারিগরের পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গে যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই কারিগরকে রথ তৈরির কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যে গাছ থেকে জগন্নাথদেবের রথ তৈরির জন্য কাঠ কাটা হবে, সেই গাছকে প্রথমে পুজো করা হয়। তারপর সোনার কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটা হয়। কুঠারটি অবশ্যই ভগবান জগন্নাথদেবের চরণে স্পর্শ করিয়ে নেওয়া হয়। জগন্নাথদেবের রথ তৈরিতে মূলত ব্যবহার করা হয় নিম ও হাঁসি গাছের কাঠ। রথ নির্মাণের জন্য ৮৮৪টি গাছের ১২ ফুটের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পুরীতে যাঁরা জগন্নাথদেবের রথ সাজান, তাঁরা কারা জানেন? এঁরা ওড়িশার খুড়দা জেলার বাসিন্দা। রাজকিশোর নায়েকের পরিবারই জগন্নাথদেবের রথ সাজিয়ে তোলেন। গোপ, কাকাতপুর, নিমাপাড়া ও অস্তরংগড় থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেন প্রাকৃতিক শোলা। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকেই তাঁরা শোলার ফুল তৈরির কাজ শুরু করে দেন। যতদিন এই কাজ চলে, কঠোর নিয়ম মানেন তাঁরা। কেউ আমিষ খাবার খান না। এই কাজকে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বলে মনে করেন তাঁরা।
অনেকের বিশ্বাস, রথের দিন যদি রথের রশি ছোঁয়া যায়, তাহলে একশো যজ্ঞের সমান পুণ্যলাভ হয়ে থাকে। পুরাণ বলছে, একবার সুভদ্রা কৃষ্ণ ও বলরামের কাছে আব্দার করেন, তাঁকে নগর ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। এরপরই দুই ভাই ও বোন মিলে রথে চেপে নগর ঘুরতে বের হন। ঘোরা শেষে গুণ্ডিচায় মাসির বাড়িতে সাতদিন থাকেন তাঁরা। এরপর সেই রথে চেপেই তাঁরা ফের পুরীতে ফিরে আসেন, সেটাই উল্টোরথ নামে পরিচিত।
কথিত আছে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পন যে, পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি নির্মাণ করতে হবে। সেই আদেশ অনুযায়ী, কাষ্ঠখণ্ড সংগ্রহ করে রাজা মূর্তি তৈরির জন্য উপযুক্ত শিল্পীর খোঁজ করছিলেন। সেইসময় তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান এক বৃদ্ধ। তিনি জানান, মূর্তি তৈরি করতে পারবেন তিনি। কিন্তু এই কাজ করার সময় কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করেন। সেইমতো দরজার আড়ালে তৈরি হতে থাকে মূর্তি।
রাজা-রানি প্রত্যেকেই অধীর আগ্রহে বাইরে অপেক্ষা করছেন। কেমন হবে সেই মূর্তি? তাঁদের যে আর ধৈর্য বাঁধ মানছে না। দরজায় কান পেতে তাঁরা শোনার চেষ্টা করেন। শুনতে পান, ভিতরে কাজ করার শব্দ হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎই একদিন সেই শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। রানি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না। আচমকা দরজা খুলে দেন তিনি। দেখখেন যিনি মূর্তি গড়ছিলেন, সেই শিল্পী নেই। এদিকে মূর্তিও অসমাপ্ত।
এই রহস্যময় শিল্পীই হলেন খোদ বিশ্বকর্মা। অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেখে মুষড়ে পড়েন রাজা। শিল্পীর কাজে বাধাদানের জন্য অনুতপ্ত বোধ করতে থাকেন তিনি। তখন তাঁকে জগন্নাথদেব স্বপ্নাদেশ দেন, এরকমটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এই রূপেই পূজিত হতে চান তিনি। সেই থেকেই ওই কাষ্ঠমূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে শুরু হয় পুজো। পরে তৈরি হয় জগন্নাথ মন্দির। শুরু হয় রথযাত্রা।