দেশের সময়: পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট সাদা বাড়ি। বড় বড় পাল্লা দেওয়া জানলা। তিনকোনা আর্চের ভঙ্গিতে টিনের চাল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই বারান্দা। পাশে গোলাকৃতি বৈঠকখানা। কার্শিয়াংয়ের গিদ্দা পাহাড়ে এই বাড়িতেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে টানা ছ’মাস গৃহবন্দি করে রেখেছিল ব্রিটিশরা। পরে মুক্তি পেয়েও বহুবার এই বাড়িতে এসেছেন নেতাজি।

ঐতিহাসিক এই বাড়ি ঘিরে রয়েছে নেতাজির নানা স্মৃতি। এই বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে চিঠিতে কথাবার্তা হয়েছে সুভাষচন্দ্রের। নেতাজিকে লেখা কবিগুরুর চিঠি আজও সংরক্ষিত রয়েছে এই বাড়িতে। অসমের এক ডেপুটি পুলিস সুপারের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু। সালটা ১৯২২। তথ্য বলছে, ১৯৩৬ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বাড়িতে অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন নেতাজি।

বাড়িটি এখন নেতাজি সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন সকালে নেতাজির ছবির সামনে ধূপ জ্বেলে দিন শুরু হয় গিদ্দা পাহাড়ের বাসিন্দাদের। তাঁরা যেমন নেতাজিকে ভোলেননি, তেমনই মনে রেখেছেন হেলেনা বিবিকে। কবেই মারা গিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে কী করে ভুলবে কার্শিয়াং?

কারণ, নেতাজি যখন গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন, তখন তিনিই তো সুভাষচন্দ্রের যাবতীয় গোপন চিঠিপত্র পাউরুটির ভিতরে ভরে পৌঁছে দিতেন দলের নেতাদের কাছে। শুধু হেলেনা কেন, গিদ্দা পাহাড় মনে রেখেছে মোতিমায়া লেপচাকেও। তখন মোতিমায়ার সাত বছর বয়স। গিদ্দা পাহাড়ের বাড়িতে নেতাজির সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন তিনিই। ঐতিহাসিক এই বাড়িটি এখন উচ্চ শিক্ষা দফতরের অধীন নেতাজি ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজের একটি বিশেষ কেন্দ্র।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, নেতাজি শেষবার এই বাড়িতে এসেছিলেন ১৯৩৮ সালে। গিদ্দা পাহাড়ের বাড়ি থেকে তাঁকে নিয়মিত থানায় হাজিরা দিতে হত। যেদিন তাঁর থানায় হাজিরা দেওয়ার তারিখ থাকত, তাঁকে দেখতে পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে লোক জড়ো হয়ে যেত। পর্যটকদের কেউ কেউ দার্জিলিং ঘুরতে এসে এই বাড়িতে একবার ঢুঁ মারেন।

তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই কম। স্থানীয়দের আক্ষেপ, গিদ্দা পাহাড়ে নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত এই জায়গাটি পর্যটকদের সামনে আরও বেশি করে তুলে ধরা উচিত ছিল সরকারের। গিদ্দা পাহাড়ের বাড়িটিতে নেতাজির বেশকিছু দুর্মূল্য ছবিও রয়েছে।

জানা যায়, মুক্তি পাওয়ার পর নেতাজি যখন এসেছেন এখানে, প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন তিনি। পাগলাঝোরার কাছে ঝরনার ধারে নেতাজির তোলা বেশকিছু ছবিও আছে। রয়েছে নেতাজির ব্যবহার করা খাট, ড্রেসিং টেবিল, লেখাপড়ার টেবিল, চেয়ার। নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র ১৯৩৪ সালে বাড়ির চত্বরে একটি ক্যামেলিয়া গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছ এখনও আছে। বাড়িটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বসু পরিবারের অধীনে ছিল।

১৯৯৭ সালে রাজ্য সরকার বাড়িটি সংস্কার করে। এর পর ২০০০ সালে বাড়িটি মিউজিয়াম আকারে উদ্বোধন হয়। এই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব একারণেই, এখানে বসেই নেতাজি হরিপুরা কংগ্রেসের ভাষণ লিখেছিলেন। গান্ধীজি ও জহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখেছেন। গরমের ছুটিতে বা পুজোর সময় বসু পরিবারের সদস্যরা এই বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে নেতাজিও এসেছেন।

১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তার তথ্য রয়েছে। ১৯৩৩ থেকে দু’বছর এখানেই গৃহবন্দি ছিলেন নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্রও। এই বাড়িতে বসেই যেমন নেতাজি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন, আবার ভাইপো, ভাইঝিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন। তাদের দোলনায় চড়িয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here