দেশের সময়: তৃণমূলের একটি জনপ্রিয় স্লোগান, ‘খেলা হবে’। স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিভিন্ন সময় এই স্লোগানটি বলে দলের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খেলা হতে গিয়ে যে তলে তলে খেলার মোড় এতটা ঘুরতে পারে, সত্যিই কি তার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা? পুজোর আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া ব্যানার-পোস্টার পড়েছিল কলকাতায়। তাতে লেখা ছিল, নতুন তৃণমূল।

ওই পোস্টার ঘিরে তুমুল জল্পনা তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। নতুন তৃণমূল বলতে কী বোঝাতে চাইছেন অভিষেক, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছিল চর্চা। পরে অভিষেক ঘনিষ্ঠ মহলে নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, একেবারে মানুষ যেমনটি চায়, সেভাবেই তৃণমূলকে পাবে তারা। আর এরজন্য মাত্র ছ’মাস সময় নেবেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ থেকে অভিষেক বার্তা দিচ্ছিলেন, এবার নেতার জলের বোতল বয়ে দিয়ে কিংবা নেতার বাড়িতে কোনও ভেট বা উপহার পাঠিয়ে পঞ্চায়েতে তৃণমূলের টিকিট পাওয়া যাবে না।

রীতিমতো বায়োডেটা খতিয়ে দেখে তারপর তাঁকে পঞ্চায়েতে জোড়াফুলের প্রার্থী করা হবে। দলের প্রার্থীরা হবেন একেবারে স্বচ্ছ ইমেজের। এসব থেকে ধরে নেওয়া হচ্ছিল, এবার পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রার্থী নির্বাচনের গোটা দায়িত্বটাই বোধ হয় অভিষেক নিজে হাতে সামলাবেন। কিন্তু আচমকা নয়া চিত্রনাট্য সামনে। তাতে একেবারে নতুন চরিত্র। কিন্তু কে তিনি? তিনি আর কেউ নন, খোদ রায়সাহেব! হ্যাঁ, তিনি মুকুল রায়। 

মুকল রায়ের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বনগাঁর তৃণমূলনেতা রতন ঘোষ,শনিবার দুপুরে তোলা ছবি- দেশের সময়৷

সবাই যখন পুজোর রেশ গায়ে মেখে ছুটির মেজাজে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন, তখনই মুকুল রায়ের সঙ্গে দ্বাদশীতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি সেরে ফেলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে মমতার বাড়ি যান মুকুল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মিনিট দশেক কথা হওয়ার ছিল। কিন্তু সেই বৈঠক গড়ায় এক ঘণ্টা দশ মিনিট। মমতা-মুকুল কী কথা হয়েছে, তা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে, সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুকুল রায়কে দলের হয়ে পঞ্চায়েতের দায়িত্ব নিতে বলেছেন। আর এরপরই খেলা ঘুরতে শুরু করেছে। মমতার সঙ্গে মুকুলের ওই বৈঠকের পরই রায়সাহেবের বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা।

ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মন্ত্রী মুকুল রায়ের বাড়ি গিয়ে দেখা করে এসেছেন। তাছাড়া রোজই উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতারা রায়সাহেবের বাড়ি যাচ্ছেন। নিয়ম করে প্রতিদিন দশ থেকে পনেরোজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে বৈঠক করছেন মুকুলবাবু। এই বৈঠকের জন্যও সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে। দুপুর আড়াইটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত বৈঠক চলছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা নেতাদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছেন মুকুল রায়। কে, কী দায়িত্বে রয়েছে। কে, কেমন কাজ করছে সেসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন। 

দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তৃণমূলে যদি কেউ বাংলাকে হাতের তালুর মতো চেনেন, নিঃসন্দেহে তাঁর নাম মুকুল রায়। তাছাড়া মুকুলের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট, তাঁর অভিজ্ঞতা। কোন এলাকায় ভোটের সমীকরণ কী, সেখানে কীসের অঙ্কে ভোট হয়, কোথায়, কাকে দিয়ে ভোট বৈতরণী পার হওয়া যায়, তা মমতাকে বাদ দিয়ে মুকুলের মতো ভাল বোঝার মতো কেউ নেই তৃণমূলে। সেকারণেই মুখ্যমন্ত্রী এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আনঅফিসিয়ালি মুকুলকে এই দায়িত্ব নিতে বলেছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। আর দলনেত্রীর কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পরই নিজের ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছেন রায়সাহেব। 

তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, টাইগার ইজ ব্যাক। আপাতত রায়সাহেব হোমওয়ার্ক করছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ময়দানে নামবেন। তাঁর চালেই পঞ্চায়েতে ধরাশায়ী হবে বিরোধীরা। 

এদিকে, মুকুল ও মমতার বৈঠকের পর থেকে তৃণমূলে মুকুল অনুগামী বলে পরিচিত নেতা-কর্মীরা অনেকটা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁরাও দাদার বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখার অপেক্ষায় মুখিয়ে রয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মুকুল যদি নিজে হাতে দলের হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করেন, তাহলে অভিষেক? বিষয়টি নিয়ে অবশ্য তৃণমূলের কেউ কোনও মুখ খুলতে চাইছেন না। তাঁদের সাফ বক্তব্য, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকে যা দায়িত্ব দেবেন, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করবেন।

তৃণমূল শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। ফলে এসব নিয়ে অযথা বিতর্কের কোনও কারণ নেই। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতির যা অবস্থা, তাতে তৃণমূলকে বেগ দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই বিরোধীদের। কিন্তু পঞ্চায়েতে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে দলীয় কোন্দল। টিকিট না পেয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া কিংবা তলে তলে ছুরি মেরে দলের অফিশিয়াল প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে। আর এর জেরে অনায়াসেই জেতার জায়গায় থাকা পঞ্চায়েতের বহু আসন তৃণমূলের হাতছাড়া হতে পারে। তার সুযোগ নিতে পারে বিরোধীরা।

দলের এই গোষ্ঠীকোন্দল সামাল দিতেই মুকুলকে আসরে নামাতে চাইছেন মমতা। কারণ, অতীতেও তিনি খুবই সফলভাবে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দিয়েছেন। সবপক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে মিটিয়েছেন টিকিট নিয়ে ক্ষোভ। তাছাড়া কোথায়, কাকে প্রার্থী করলে জেতার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারেও রায়সাহেবের অভিজ্ঞতা অনেকটাই বেশি। এসব দিক থেকে অভিষেকের চেয়ে মুকুলকেই অনেক বেশি পারফেক্ট মনে করছেন মমতা।

আগামী বছরের শুরুতেই পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা। তাছাড়া ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে কি তৃণমূল সুপ্রিমো পুরনো অস্ত্রে ফের শান দিতে চাইছেন, মুকুলকে আসরে নামনো ঘিরে এমনই জল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে বঙ্গ রাজনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলায় একের পর এক দুর্নীতি কাণ্ডে জর্জরিত তৃণমূল। দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী জেলে। সরকারি আমলারাও দুর্নীতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলে। ফলে স্বচ্ছতা বজায় রেখে এগিয়ে চলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেইসঙ্গে আরও বড় চ্যালেঞ্জ, দলের গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দেওয়া।

কারণ, বহু জেলাতেই পুরনো গোষ্ঠী বনাম নয়া গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব চরম আকার নিয়েছে। দলের রাজ্য নেতৃত্ব বারবার সতর্ক করার পরও পরিস্থিতির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। মুকুলকে সামনে রেখেই এই কোন্দল মেটানোই মূল লক্ষ্য তৃণমূল নেত্রীর। জোড়াফুলের জন্মলগ্ন থেকে মমতার সঙ্গে থাকলেও মুকুল রায় মাঝে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু সেই সফর ছিল ক্ষণস্থায়ী। কয়েক মাসের ব্যবধানে ফের তিনি তৃণমূলে ফিরে আসেন। কিন্তু তারপরও কেমন যেন বেসুরো ঠেকেছে তাঁর কথাবার্তা। মাঝেমধ্যেই বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছেন তৃণমূল সম্পর্কে, যা নিয়ে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে দলীয় নেতৃত্বকে।

তারপর বেশ কিছুদিন চুপচাপ ছিল সবকিছু। মুকুল রায় কোথায়, কী করছেন, কেমন আছেন, এসব নিয়ে তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতারা সেভাবে খোঁজখবরও রাখতেন না। কিন্তু দ্বাদশীতে দলনেত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরই সেইসব নেতারা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। রায়সাহেবের খোঁজখবর নিতে, তাঁর বাড়িতে গিয়ে হত্যে দিতে শুরু করেছেন। এখানেই জল্পনা, মমতার সঙ্গে বৈঠকে কী এমন আলোচনা হল যে, রাতারাতি এভাবে খেলা ঘুরতে শুরু করল। সাদা চোখে বলা হচ্ছে, মুকুল রায় মমতার বাড়িতে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে যে শুধু বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে খরচ করবেন না মুখ্যমন্ত্রী, তা বিলক্ষণ জানেন তৃণমূল নেতারা।

ফলে তাঁরাও বিষয়টি এখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না যে, পঞ্চায়েতের আগে জল কোন দিকে গড়াতে পারে। তবে, বসে না থেকে দলের পুরনো সৈনিকের বাড়িতে ইতিমধ্যেই ভিড় জমাতে শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। গত সপ্তাহেই মুকুল রায়ের বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। একসময় পার্থ ভৌমিকের সঙ্গে মুকুল রায়ের সম্পর্ক ছিল সাপেনেউলে। ফলে রায়সাহেবের বাড়িতে পার্থর যাওয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

শুধু পার্থ ভৌমিক নন, মুকুলের বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন রাজ্যের আরএক মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। দেখা করেছেন তৃণমূল নেতা সুবোধ সরকার সহ অনেকে। ফলে সবমিলিয়ে জোর জল্পনা, পুরনো মেজাজে কবে ফিরছেন রায়সাহেব?

বর্তমানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের যে পদে রয়েছেন, সেই পদে থেকে দীর্ঘদিন কাজ করে তৃণমূলকে রাজ্যে ক্ষমতায় আনার পিছনে বড় অবদান রয়েছে মুকুল রায়ের। একথা দলের বহু নেতা-কর্মীই প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। সেই মুকুলকেই আগামী লোকসভা ভোটের আগে কাজে লাগানো যায় কি না তা নিয়েই দলনেত্রী চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন বলে মনে করছেন তৃণমূলের একাংশ।

তাদের মতে, একারণেই পঞ্চায়েতের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে মুকুলের হাতে। সেমি ফাইনালে তিনি কেমন খেলেন, তা দেখেই ফাইনালে তাঁর পজিশন ঠিক করা হবে। ২০২১ সালের ২১ জুন বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন মুকুল। তারপর মাঝেমধ্যেই তিনি কাঁচরাপাড়ার বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকের বাড়িতে এসে থাকতেন। কিন্তু সেখানে সেভাবে তৃণমূলের কোনও নেতা-কর্মীকে ভিড় জমাতে দেখা যেত না। ২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ সমাবেশে যোগ দিলেও মঞ্চে দেখা যায়নি মুকুল রায়কে।

তবে ৮ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বুথ কর্মী সম্মেলনে মঞ্চে ছিলেন রায়সাহেব। মাঝে একদিন তৃণমূলের রাজ্য দফতরে গিয়ে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সির সঙ্গে দেখা করে আসেন মুকুল রায়। তারপরই মমতার সঙ্গে দ্বাদশীতে বৈঠক, স্বাভাবিকভাবেই নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মুখে যে যাই বলুন না কেন, তৃণমূলের একটা বড় অংশ অবশ্য এখন মুকুলবাবুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here