দেশের সময় ওয়েবডেস্ক :কথায় বলে মর্নিং শোজ দ্য ডে। সোমবার পুরুলিয়ার প্রশাসনিক বৈঠকের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কথাই বুঝিয়ে দিয়েছিল কী ঘটতে চলেছে। জেলায় কী কাজ হয়েছে তার একটা ডকুমেন্টরি ভিডিও প্রেজেন্টেশন চালানোর আগে জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, “এ বার আমরা একটা ভিডিও দেখাব।” তা শুনেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হ্যাঁ দেখিয়ে নাও। এরপর আমি দেখাব।”

তারপর যা হল, তা যেন সত্যিই ছকভাঙা। মমতা নিজেও বলেন, “আজকের মিটিংটা আমি একটু অন্য ভাবে করব।”

মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর পিছনের সারিতে এদিন বেশ কয়েকজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। প্রথমে সকলে ভেবেছিলেন, হয়তো কোনও সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী। যাঁদের হাতে মুখ্যমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক ভাবে তা তুলে দেবেন। কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই মালুম হয়, তাঁরা আসলে হাটে হাঁড়ি ভাঙতে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ডেকে এনেছেন। জেলা প্রশাসনের বড় কর্তাদের সামনে তাঁরাই বললেন—কেমন দালাল রাজ চলছে। বিএলআরও দফতরে কী ভাবে কাঁচা টাকার চক্র চালাচ্ছে অসাধু কারবারীরা।

এতদিন প্রশাসনিক বৈঠকে সরকারি কাজে নানা অভিযোগ নিয়ে সরাসরি আধিকারিকদের সতর্ক করতেন৷ এবার সরকারি কাজ করাতে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের নিয়ে সরাসরি প্রশাসনিক বৈঠকে হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রীতিমতো ভুক্তভোগীদের নাম ধরে ধরে কত টাকা ঘুষ চাওয়া হচ্ছে তা ফাঁস করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এ দিন পুুরুিলয়ার প্রশাসনিক বৈঠকেই জমির মিউটেশন করাতে গিয়ে মানুষের হয়রানির অভিযোগে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী৷

পুরুলিয়ার প্রশাসনিক বৈঠকে শুরুর দিকেই মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, পুরুলিয়া জেলার আদিবাসী সমাজের বহু মানুষ জমির মিউটেশন করতে গিয়েও পারছেন না৷ পুরুলিয়ার বলরামপুর ব্লকের বিএলআরও অফিসের দালাল চক্র নিয়ে প্রথমে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী৷ জমির মিউটেশন করাতে গিয়ে যাঁদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে, সেরকম বেশ কয়েকটি আদিবাসী পরিবারের সদস্যরা সেই সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন৷

বলরামপুরের আইসি-কে দাঁড় করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, ‘বলরামপুরের বিএলআরও অফিস চেনেন? অফিসের উল্টো দিকে দুটো দোকান আছে৷ করালি কিঙ্কর এবং প্রিয়াঙ্কা ভ্যারাইটিস৷ বিএলআরও অফিসে জমির মিউটেশন করাতে গেলেই ওই দুটো দোকানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷

পড়াশোনা না জানা মানুষকে বলছে জমির মিউটেশনের কাজে রেট চালু হয়েছে৷ ১৫০০ থেকে ২০০০, ১০০০ থেকে ২০০০৷ জমির মাপ দেখে তিরিশ হাজার পর্যন্ত হয়েছে৷’ অবিলম্বে অভিযোগের তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আইসি-কে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী৷

ক্ষোভের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যাঁরা পড়াশোনা জানে তাঁরা করে নিচ্ছে৷ কিন্তু এখন কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধা পেেত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই জমির মিউটেশন করাতে চাইছেন৷ কিন্তু তাঁরা গেলেই টাকা চাওয়া হচ্ছে৷’

বলরামপুরের পর হুদার বিএলআরও অফিস নিয়েও অভিযোগ করেন মমতা৷ রাজেন হেমব্রম নামে একজন ভুক্তভোগীকে দাঁড় করিয়ে মমতা হাতের নথি দেখে বলেন, জমির মিউটেশন করাতে গেলে ওই ব্যক্তির থেকে প্রতি পাতা পিছু একশো টাকা করে চেয়েছে দালাল৷ মাধব মাহাতো এবং যাদব মাহাতো নামে দুই ভাইয়ের থেকেও মিউটেশন করতে মোটা টাকা চাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী৷

গ্রামের সাধারণ মানুষ শুধু নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে প্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জ্বালামুখ খুলে দিলেন পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের সদস্যরাও। কেউ বললেন, মিউটেশন হচ্ছে না, কেউ বললেন অযথা লোককে ঘোরাচ্ছে, আবার কেউ এও বললেন, বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা সরকারি দফতরের লোকজন নিজেদের পকেটে ঢোকাচ্ছেন। এই শুনেই জেলাশাসকের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ডিএম শুনতে পাচ্ছো? কী জেলা চালাও বলতো! আমার আইডিয়া চেঞ্জ হয়ে গেল।”

মুখ্যমন্ত্রী এদিন এও বলেন, “এত কিছু দিচ্ছি মানুষকে, তবু কয়েকজন এত লোভী কেন হয়ে গিয়েছে। আর কত চাই? আমার পার্টির লোক হলে আমি টেনে চারটে থাপ্পড় মারতাম। তাদের আমি সবসময় শাসন করি।’’

এই যখন চলছে তখন মুখ্যমন্ত্রী ফের একবার জেলা পুলিশকে মনে করিয়ে দেন, ওই দুটো দোকানের (বলরামপুর বিএলআরও অফিসের বিপরীতে) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হয়েছে? প্রশাসন এরকম চলা উচিত, এখানে আমি বললাম সঙ্গে সঙ্গে ওখানে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এর কিছুক্ষণ পর জেলা পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীকে মঞ্চে জানায়, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আগে ওই দুটো দোকান সিল করো। তদন্ত হবে। তারপর দেখা যাবে।”

জেলা প্রশাসনকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আরও দস্তাবেজ দেখান এদিনের বৈঠকে। মমতা বলেন, “একটা চালাকি হচ্ছে। যখনই কোনও প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইছি, বলে দেওয়া হচ্ছে আন্ডার প্রসেস।” এরপর একটার পর একটা ছবি দেখান মুখ্যমন্ত্রী। আড়ষা স্টেডিয়াম থেকে বাঘমুন্ডি স্টেডিয়াম—ছবি দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সব পাঁচ বছর আগের প্রকল্প। একটাও চালু হয়নি। আর লিখে দিচ্ছে আন্ডার প্রসেস!

পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের কাজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট নন তা এদিন পরতে পরতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অনেকের মতে, যে ভাবে এদিন প্রশাসনিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী তা থেকে হয়তো অন্য জেলাও সতর্ক হবে। নইলে হাটের মাঝে গঞ্জনা শুনতে হবে প্রশাসনিক কর্তাদের। যা খুবটা সম্মানজনক নয় বলেই মত অনেকের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here