দেশের সময়: কর্ণাটকে কুর্সি বদল। থেমে গেল গেরুয়া ঝড়। হাত-এর ঘায়ে দাক্ষিণাত্যে কুপোকাৎ পদ্ম। দক্ষিণের এই রাজ্যের ফল স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিল, দিল্লির মসনদে মোদী-অমিত শাহদের গদি টলমল। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। কর্ণাটক বিধানসভা ভোট এবার আক্ষরিক অর্থেই ছিল মোদী বনাম গান্ধী পরিবারের প্রেস্টিজ ফাইট। সমস্ত কর্মসূচি ছেড়ে প্রচারের শেষ ক’টা দিন কর্ণাটকে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯টি সভা, ৬টি রোড শো করেন তিনি। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না।

কংগ্রেসও অবশ্য গেরুয়া ঝড় থামিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছিল। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তো বটেই, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে যে সোনিয়া গান্ধী কোথাও কোনও মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দেননি, সেই সোনিয়াও সভা করেন প্রচারের শেষবেলায়। অবশেষে ভোটের ফলে গান্ধী পরিবারের মুখেই জয়ের হাসি। অন্যদিকে, বেলুনের মতো চুপসে গেল পদ্ম শিবিরের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ। যদিও জয়ের পরও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না হাত শিবির। ঘোড়া কেনাবেচায় নামতে পারে বিজেপি। ভোট শতাংশে পিছিয়ে থাকা বিজেপি ইতিমধ্যেই জেডিএসের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বলে খবর। কংগ্রেসও কথা বলছে জয়ী নির্দলদের সঙ্গে। দলের জয়ী প্রার্থীদের গোপন আস্তানায় নিয়ে যেতে তৎপর কংগ্রেস। বিশেষ হেলিকপ্টারে বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জয়ী কংগ্রেস প্রার্থীদের। দিল্লিতে কংগ্রেস অফিসের সামনে বাজি ফাটিয়ে উল্লাস চলছে। বেঙ্গালুরুতে কংগ্রেস কার্যালয়ে চলছে লাড্ডু বিলি।

অন্যদিকে, কন্নড়ভূমে খাঁ খাঁ করছে বিজেপি অফিস। কর্ণাটক জয়ে উচ্ছ্বসিত রাহুল গান্ধী বলেছেন, টাকা অর্থাৎ পুঁজিবাদের সঙ্গে গরিব মানুষের শক্তির লড়াই হয়েছে। গরিবের শক্তি হারিয়ে দিয়েছে টাকাকে। জবরদস্তি করে আমরা সেখানে লড়িনি। আমরা ভালোবাসার সঙ্গে লড়াই করেছি। এবং প্রমাণ হল, এই দেশ হিংসা চায় না, ভালোবাসা চায়। কর্ণাটকে ঘৃণার বাজার বন্ধ হল। ভালোবাসার দোকান খুলল। ইস্তাহারে যা বলেছি, প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই তা কার্যকরী হবে। বললেন, এবার থেকে প্রতিটি রাজ্যেই কর্ণাটক মডেল কার্যকর হবে।

হার মেনে নিয়ে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের বক্তব্য, কোথায় খামতি ছিল খতিয়ে দেখব।

মোদীর ঘৃণার রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে, কর্ণাটক ভোটের ফল নিয়ে মন্তব্য কংগ্রেস নেতা পবন খেরার। কংগ্রেসের দাবি, এই অভাবনীয় জয়ের জন্য কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। কর্ণাটকে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা আটদিন ছিল। তারই ফল মিলল ভোটে। ৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার চালাচ্ছিল বিজেপি। কর্ণাটকের মানুষ তার উচিত জবাব দিয়েছে। দক্ষিণ ভারতে একমাত্র জমিও হারাল বিজেপি, কটাক্ষ বাঘেলের। ঘরের মাঠ হিমাচলের পর এবার অ্যাওয়ে ম্যাচেও গোহারা হারলেন বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা।

এদিকে, কর্ণাটকে ভোটের ফল কি বাংলার জন্যও শিক্ষা? এনিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। প্রশ্ন উঠেছে, তোষণের রাজনীতি বন্ধ হয়ে এবার কি মূল ইস্যু নিয়ে রাজনীতি শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গে?

এর আগে হিমাচলে হেরেছে বিজেপি। দিল্লির কর্পোরেশন ভোটেও দাঁত ফোটাতে পারেনি মোদি-অমিত শাহদের দল। হেরেছে সিমলা কর্পোরেশনে। আর এবার হাতছাড়া হল কর্ণাটক। ফল ঘোষণা হতেই আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেললেন কর্ণাটকের কংগ্রেস সভাপতি শিবকুমার। বললেন, সোনিয়া গান্ধীকে কথা দিয়েছিলাম, কর্ণাটক উপহার দেব। কথা রাখতে পেরেছি। রাজ্যের মানুষকে ধন্যবাদ। তাঁরা দুর্নীতির সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। কর্ণাটক জয়ে বঙ্গেও উজ্জীবিত হাত শিবির। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় নেমে উল্লাসে মাতেন কংগ্রেস কর্মীরা। সবুজ আবির মেখে, মিষ্টি বিলি করে তাঁরা কর্ণাটক জয়কে উদ্‌যাপন করেছেন।

কর্ণাটকে ভোটের ফল নিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ধর্মের সুড়সুড়ি কখনও রাজনীতির ইস্যু হতে পারে না। বিজেপির এই ধর্মের রাজনীতির প্রত্যাখ্যান শুরু হয় বাংলা থেকেই। ২০২১ সালেই বাংলার মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, ধর্ম কিংবা জাতপাতের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয় না বাংলা। ২০২৪ সালেও বাংলাই পথ দেখাবে। অভিষেকের প্রশ্ন, বিজেপি ডবল ইঞ্জিনের সরকারের কথা বলে। কর্ণাটকে তো পাঁচ বছর ডবল ইঞ্জিনের সরকার ছিল। কী হয়েছে সেখানে? কমিশনের সরকার চলেছে। মণিপুরে তো ডবল ইঞ্জিনের সরকার। তা হলে মণিপুরে আগুন জ্বলছে কেন? আসলে ডবল ইঞ্জিনের সরকার মানে ট্রাবলের সরকার।  

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, কর্ণাটকের জয় আরও একবার প্রমাণ করল বিজেপিকে হারাতে পারে একমাত্র কংগ্রেস। এ রাজ্যেও সমস্ত দলের কর্মীদের কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। হয় কংগ্রেস নয় বিজেপি। মাঝে আর কোনও দল করে লাভ নেই। তৃণমূল সর্বভারতীয় দল থেকে আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। এরপর আগামী দিনে গ্রামীণ দলে পরিণত করে দেব, হুঙ্কার অধীরের। কংগ্রেস কর্মীদের বক্তব্য, বজরংবলীকে সামনে রেখে মোদি কর্ণাটকে জিততে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বজরংবলী আমাদের দেবতা। তাঁকে নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত করা যায় না। কর্ণাটকের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, আসল ইস্যু হাতে কাজ, পেটে ভাত। এই ইস্যুতেই লড়াই করছেন রাহুল গান্ধী। তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রার ফল মিলল কর্ণাটকে। বাকি জায়গাগুলিতেও পড়বে। বিজেপি ফিনিশ হয়ে যাবে।

তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, নো ভোট টু বিজেপি, ফর্মুলা কর্ণাটকে কাজে এসেছে। মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে। এবার মোদি-অমিত শাহদের গদি ছাড়ার পালা। আমাদের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলেছিলেন, কর্ণাটক থেকেই বিজেপির পতনের শুরু হবে। আমাদের একটাই বক্তব্য, যে যেখানে শক্তিশালী, তাদের নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিকল্প জোট তৈরি হোক। এর পাল্টা হিসেবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অবশ্য বক্তব্য, সরকার তো বদলাতেই পারে। আমরা তো তৃণমূলের মতো ভোট লুট করে জিতি না। তাছাড়া কর্ণাটকে এখনও যা পরিস্থিতি, চাইলে আমরা সরকার গড়তে পারি। সুকান্তের এই মন্তব্য ঘিরে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, এর আগে যেমন কংগ্রেস ও জেডিএস ভাঙিয়ে কর্ণাটকে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি, আবারও কি সরকার গড়তে সেই ঘোড়া কেনাবেচায় নামতে চলেছে গেরুয়া শিবির?

কর্ণাটকের ফল প্রসঙ্গে মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের বক্তব্য, ভোটে জেতা নয়, বিজেপি ঘোড়া কেনাবেচাতেই বিশ্বাসী। রাজস্থানের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী শচীন পাইলট বলেছেন, কর্ণাটকে দুর্নীতির সরকারের পতন হয়েছে।

কর্ণাটকের ফলের পর বিজেপি বিরোধী জোটের যে সলতে পাকানো শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই, তা বিশেষ গতি পাবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। এই জোট নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। কিছুদিন আগেই তিনি নবান্নে এসে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে গিয়েছেন। এরপর সাক্ষাৎ করেছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন কিংবা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। আগাম ১৮ তারিখ দিল্লিতে দেশের সমস্ত অ-বিজেপি দলগুলির মূল নেতানেত্রীদের নিয়ে জোটের বৈঠক হওয়ার কথা। ওই বৈঠক থেকেই বিরোধী জোটের কর্মসূচি নয়া গতি পাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here