১৯৮৩…২০১১…২০২৩?

পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, পোড়খাওয়া অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে আজ ইন্ডিয়ার মন্ত্র টিম-স্পিরিট। কোহলি-শ্রেয়সদের দুরন্ত ফর্ম চিন্তায় রেখেছে হ্যাজেলউডকে। আর এটাই ভারতীয় দলের অ্যাডভান্টেজ। বাইশ গজের বিশ্বযুদ্ধ ঘিরে টগবগিয়ে ফুটছে উত্তেজনার পারদ।

World Cup 2023 Final : IND vs AUS : একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপে মুখোমুখি ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। অহমেদাবাদের নরন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে এই ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। ভারতীয় সময় অনুসারে বেলা ২ টো থেকে এই ম্যাচ শুরু হবে।

অস্ট্রেলিয়ার সম্ভাব্য একাদশ
ট্রাভিস হেড, ডেভিড ওয়ার্নার, মিচেল মার্শ, স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, জস ইংলিশ (উইকেটকিপার), প্যাট কামিন্স (অধিনায়ক), মিচেল স্টার্ক, অ্যাডাম জাম্পা, জস হ্যাজেলউড।

ভারতের সম্ভাব্য একাদশ
রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), শুভমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আইয়ার, কেএল রাহুল (উইকেটকিপার), সূর্যকুমার যাদব, রবীন্দ্র জাদেজা, কুলদীপ যাদব, মহম্মদ সামি, জসপ্রীত বুমরাহ এবং মহম্মদ সিরাজ।

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ আজ অজি-বধে মুখিয়ে ভারত। ১২ বছর পর ইতিহাস গড়ার মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে অধীর অপেক্ষায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী।

ইতিমধ্যেই আমদাবাদ ছাড়িয়ে সেই উত্তেজনা ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা দেশে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, মুম্বই থেকে মণিপুর—সবাই সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র আর একটা জয় দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।

রবিবার দুপুরে বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া আরও একবার মুখোমুখি হবে কাপ জেতার লড়াইয়ে। যা সামনে বসে প্রত্যক্ষ করবে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে নামাঙ্কিত এই স্টেডিয়ামে এত লোকই একসঙ্গে বসতে পারে। এটা একপ্রকার রেকর্ড বৈকি!

আর সেই দর্শকদের মাঝেই দুপুর দু’টো থেকে শুরু হবে চূড়ান্ত ডুয়েল। কে জিতবে, কে হারবে—তা ম্যাচ শেষের পরেই পরিষ্কার হবে। কিন্তু দেশের মাটিতে নীল সমুদ্রের রূপ নেওয়া গ্যালারির সামনে ভারতই যে অলিখিত ফেভারিট হবে, সে কথা সদ্য ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করা বাচ্চাও জানে।

শুধুই কি দেশের মাটিতে খেলার অ্যাডভান্টেজ! তা নয়। খেলোয়াড়দের ফর্মও যে পাল্লা ভারী করছে ভারতের দিকেই। বিশ্বকাপের টানা ১০ ম্যাচে জয়, সঙ্গে প্রায় প্রত্যেকটি ম্যাচে একপেশে লড়াই—টিম ইন্ডিয়াকে নিয়েই তো বাজি ধরছে সবাই। এমনকী জুয়াড়িরাও দেদার টাকা ওড়াচ্ছেন রোহিত-বিরাটদের নামে।

ম্যাচের আগেরদিন তাই ঐচ্ছিক অনুশীলনেও রাহুল দ্রাবিড়ের ছেলেদের দেখা গেল ফুরফুরে মেজাজে। বিরাট যেমন প্র্যাকটিসে না এসে হোটেলেই ছিলেন। হয়তো শেষ যুদ্ধের জন্য নিজেকে আরও কঠোরভাবে তৈরি করছেন তিনি। শান দিচ্ছেন অস্ত্রে, যা তরোয়ালের মতো বাইশ গজে ছারখার করবে বিপক্ষকে।

ফাইনাল ম্যাচ, তার উপর অস্ট্রেলিয়া। লিগ পর্যায়ের অজিদের সঙ্গে এখনকার অজিদের আকাশ-পাতাল তফাত! তাই ফেভারিট হলেও লড়াই হবে সমানে সমানে। সে কথা মানছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মাও। তাই মনের মধ্যে জয়ের আত্মবিশ্বাস থাকলেও, তা নিজেদের মাথায় চড়তে দিচ্ছে না টিম ইন্ডিয়া।

গোটা টুর্নামেন্টে যেমন খেলেছ, ফাইনালে সেটা ধরে রাখলেই যথেষ্ট। তাহলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে রোহিতদের এমনই বার্তা দিয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা কোচ রবি শাস্ত্রী। বলেছেন, খেতাবি লড়াইয়ে ভারতই ফেভারিট। চাপ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আলাদা করে কিছু করার দরকার পড়বে না। স্ট্র্যাটেজি এবং তার রূপায়ণ যেভাবে হয়ে আসছে, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট।

ইডেনে দ্বিতীয় সেমি ফাইনালে ভারতীয় সমর্থকদের অনেকেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, বিশ্বকাপের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য খুবই ঈর্ষণীয়। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন তারা। দু’বারের রানার্স আপ। নক আউট পর্বে অজি ব্রিগেড বরাবরই কড়া টক্কর দেয় প্রতিপক্ষকে।

তাই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আজ ফাইনালে রোহিতদের লড়াই মোটেই সহজ হবে না। রবি শাস্ত্রী অবশ্য এই মতে বিশ্বাসী নন। তাঁর কথায়, ফাইনাল বলে লাফালাফি করার কিছু নেই। এতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। বরং আর পাঁচটা সাধারণ ম্যাচের মতোই দেখা উচিত এটাকে। তাতে মাঠে মেজাজ ধরে রাখা সহজ হবে কোহলিদের।

যে কোনও জরুরি পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল রপ্ত করতে হবে। একটা বিষয় সবসময় মাথায় রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়াকে কোনওভাবেই বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়েই ভাবতে হবে বিরাট ব্রিগেডকে। দলের সাফল্য কোনও এক বা দু’জন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সের উপর নির্ভর করে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই ভালো খেলছে। দলকে জেতাচ্ছে। এটাই টিম গেম। 

এখনও পর্যন্ত যে দশটি ম্যাচ হয়েছে, সেখানে আট-ন’জন ক্রিকেটারের ভূমিকা চোখে পড়েছে। কাপ জয়ের ক্ষেত্রে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

এবারের বিশ্বকাপে আগুন ঝরাচ্ছেন মহম্মদ সামি। ২৩টি উইকেট নিয়ে তিনি সেরা বোলার হওয়ার দৌড়ে। টিম ইন্ডিয়ার এই পেসারের প্রশংসা শোনা গিয়েছে শাস্ত্রীর গলাতেও। বলেছেন, সেমি ফাইনালে সামির পারফরম্যান্স দেখে আমি এতটুকুও অবাক হইনি। ওর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। ব্যাটিং উইকেটেও সামি উইকেট তুলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফাইনালের আগে শামি অজিদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৮৩ সালে অধিনায়ক কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ এসেছিল ভারতের ঘরে। ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন মহিন্দর অমরনাথ। সেবার ১৮৩ রান করেছিল ইন্ডিয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৪০ রানে অলআউট করে দেয় কপিল বাহিনী। ২০০৩-এ অবশ্য তীরে এসেও তরী ডোবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতের। ২ উইকেটে ৩৫৯ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। ১৪০ রানে অপরাজিত ছিলেন রিকি পন্টিং ও ৮৮ রানে নট আউট ড্যামিয়েন মার্টিন। অজিদের রান তাড়া করতে নেমে ভারত ২৩৪ রানেই শেষ করে ফেলে ম্যাচ।

উল্লেখযোগ্যের মধ্যে বীরেন্দ্র সেওয়াগ করেন ৮২, রাহুল দ্রাবিড় ৪৭, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ২৪, যুবরাজ সিং ২৪। টুর্নামেন্টের সেরা হন শচীন তেন্ডুলকর।

এই অধরা স্বপ্নই পূরণ হয় ২০১১ সালে। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে টিম ইন্ডিয়া। ৬ উইকেটে ২৭৪ রান তোলে শ্রীলঙ্কা। সেই রান তাড়া করতে নেমে ৪ উইকেটেই জয় হাসিল করে নেয় ভারত। ৯৭ করেন গৌতম গম্ভীর। ৯১ রানে অপরাজিত থেকে যান মহেন্দ্র সিং ধোনি। বিরাট কোহলি করেন ৩৫। ২১ রানে অপরাজিত যুবরাজ সিং।

আর এবার? চলছে হিসেব-নিকেশ। গ্রাম থেকে শহর, জায়ান্ট স্ক্রিন লাগিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখানোর তোড়জোড় চলছে। টিম ইন্ডিয়ার জার্সি কেনার ধুম।

অনুশীলন পর্বে চেনা ফর্মেই দেখা গেল হিটম্যানকে। সহ ক্রিকেটারদের সঙ্গে আড্ডাও দিলেন। করলেন অনুশীলনও। স্ট্রেট ড্রাইভ, রিভার্স সুইপ আছড়ে পড়ল নেটে। বাঁ হাতি মিচেল স্টার্কের কোণাকুনি ডেলিভারি সামলানোর জন্য বাঁ হাতি থ্রোয়ারকেও নক করলেন রোহিত। আর অ্যাডাম জাম্পার বিরুদ্ধে আক্রমণই যে হবে তাঁর স্ট্র্যাটেজি, তাও বোঝা গেল। নেটে লেগ স্পিনারকে এগিয়ে গিয়ে এমন দু’বার মারলেন যে ওয়াচ ওয়াচ শোরগোলটা প্রায় চারতলার উপর থেকে ছবি তুলতে থাকা মিডিয়ার কানেও পৌঁছল। বোঝা গেল, কাপ জয়ের সংকল্প নিয়েই আমেদাবাদে পা রেখেছেন মুম্বইকর।

অজি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় চ্যাপ্টার ধরে সেরে রেখেছেন প্রস্তুতি। তৈরি থাকছেন সিলেবাসের বাইরের প্রশ্নের জন্যও। নাহলে কি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ঢঙে থার্ডম্যানের উপর দিয়ে ছয় হাঁকানোর চেষ্টায় মাতেন।

রোহিতের মতোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোচ রাহুল দ্রাবিড়। শুক্রবার মাঠে এসেই  সটান চলে আসেন পিচের কাছে। কিউরেটরের সঙ্গে চলল লম্বা আলোচনা। যোগ দিলেন ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর। ফের পিচ দেখলেন। রোহিতও এলেন। দু’জনে মিলে পিচের কাছে গেলেন। রোহিত ক্রিজে শ্যাডো করছেন। দ্রাবিড় এদিকের ক্রিজে স্টান্স নিচ্ছেন।

ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য বিনোদনের ভাণ্ডার নিয়ে আজ হাজির থাকছে মোতেরা। বায়ুসেনার অনুষ্ঠান তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বকাপ ফাইনালে মাতোয়ারা শহর। প্রায় সব হোটেলের সামনে ঝুলছে নো রুম বোর্ড। সর্বত্রই ঠাঁই নেই অবস্থা। রবিবার রাতের জন্য পাঁচতারা হোটেলের রুম বুক হচ্ছে দেড় লক্ষ টাকাতেও। শুক্রবার থেকেই আমেদাবাদে আসতে শুরু করেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। কেউ ট্রেনে, কেউ ফ্লাইটে। হোটেলের মতো উড়ানের ভাড়াও বেড়েছে কয়েকগুণ।

বিশ্বকাপের শহরে পৌঁছেই সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টেটাস দেওয়ার হিড়িক। চলছে টিকিটের কালোবাজারি। তিন হাজার টাকার টিকিটের দর উঠেছে এক লক্ষ টাকা। গরমাগরম কচুরির মতো বিক্রি হচ্ছে নীল জার্সি। বিরাটের ১৮ নম্বর ঘিরেই উন্মাদনা বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও আজ স্টেডিয়ামে হাজির থাকতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী।

শোনা যাচ্ছে, বিশ্বকাপজয়ী সব অধিনায়ককেই দেখা যাবে গ্যালারিতে। থাকছে নাচ-গানও। টগবগে টিম ইন্ডিয়া। এখন শুধু তাদের মিশন মোতেরায় ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষা।

ওয়ান্ডারার্সে কুড়ি বছর আগের ফলের পাল্টা কি দেখা যাবে মোতেরায়? কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০০৩ সালের সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত যেন আজকের অস্ট্রেলিয়া। আটটি ম্যাচ জিতে ফাইনালে পৌঁছেছিল টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু খেতাবি লড়াইয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার দাপটে। সেবার গ্রুপ পর্বেও ভারত হেরেছিল অজিদের কাছে।

তেইশের কাপযুদ্ধের ফাইনালে ওঠার রোডম্যাপেও প্রচুর মিল। এবার লিগ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জিতেছে ভারত। রোহিত বাহিনী অপরাজিত। দশে-দশ করে ফাইনালে নামবে তারা। তাই ঘরের মাঠে টিম ইন্ডিয়াকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ আকাশ ছোঁয়া।

অস্ট্রেলিয়ার তারকা পেসার মিচেল স্টার্ক অবশ্য অতীত পরিসংখ্যান নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন। তাঁর কথায়, কুড়ি বছর আগে কী হয়েছিল, তার কোনও গুরুত্ব নেই এই ফাইনালে। আমার বয়স তখন ১৩। শুধু মনে আছে, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ফাইনালটা উপভোগ করতে চাইছি। যেভাবে গত আটটি ম্যাচে পারফর্ম করেছি, সেটাই মেলে ধরা লক্ষ্য।

১৯৮৭ সালে অ্যালান বর্ডারের নেতৃত্বে ইডেনে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে রিলায়েন্স বিশ্বকাপ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয়বার ভারতের মাটিতে বিজয় পতাকা ওড়ানোর সুযোগ কামিন্সবাহিনীর সামনে। তবে লড়াইটা এবার অনেক বেশি কঠিন। কারণ, প্রতিপক্ষ যে আয়োজক দেশ।

মাঠে শুধু ১৪০ কোটির ১১ সেনানী নয়, গ্যালারিতে ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শকের তুমুল গর্জনের সঙ্গেও লড়তে হবে অজিদের। তাই হয়তো আন্ডারডগ হিসেবেই নামতে চাইছে ক্যাঙারু বাহিনী।   

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here