ইছামতীর টানে”: শম্পা গুহ মজুমদারঃ মার্চ মাসের মাঝামাঝি. এবার কলকাতা তে সুন্দর বসন্তের পরিবেশ. প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ  এই সময়ে কলকাতা ভ্রমণ . কাজের খাতিরে এবার কোলকাতাতে  আসা . কিছুদিনের ছুটিটা কেবল ব্যস্ততাতেই কেটে গেল. হাতে রয়েছে আর মোটে কটা  দিন. কোথায় যাওয়া যায় তাই ভাবছিলাম. এর মধ্যে বনগাঁ থেকে এক বন্ধুর ফোন পেলাম. মতুয়া দের মেলা হচ্ছে . মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর ঠাকুরবাড়ি ও মতুয়া ধাম বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মতুয়া ধাম ঠাকুরনগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। প্রতিবছর চৈত্র মাসে মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরু হরিচাঁদ ও তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শে মতুয়া ধামে মতুয়া মহামেলা বসে।  ছোট ছোট দল ম্যাটাডর বা বাস নিয়ে আসছে বেনাপোল সীমান্তে। মতুয়া মেলার বর্ণনা পরে কোনোদিন লিখবো . আজ বনগাঁ দর্শনই আলোচ্য বিষয় . কিছু  তথ্য আমরা সবাই জানি যে, বনগাঁ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। আদি নাম বনগ্রাম। এখানে ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়  পৈতৃক নিবাসও বনগাঁর  শ্রীপল্লি ব্যারাকপুর। ঐতিহাসিক এই বাড়িটি দীর্ঘ দিন ধরেই অযত্নে পড়ে রয়েছে।  এই শহরের উপর দিয়ে ইছামতি নদী বয়ে গিয়েছে। এই শহরটি ভারতের সব থেকে বড় স্থল বন্দর এবং পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় ও উল্লেখযোগ্য সীমান্তবর্তী এলাকা। যা পেট্রাপোল স্থলবন্দর নামে পরিচিত, এর অপর পারে বাংলাদেশের বেনাপোল অবস্থিত। বেনাপোল ও পেট্রাপোল দিয়ে মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। এখানে বর্তমানে একটি সুসংহত চেকপোষ্ট গড়ে উঠেছে। বনগাঁ শহরকে কেন্দ্র করে ভারত ও বাংলাদেশ এর বেশির ভাগ বাণিজ্য হয়। বনগাঁ লোকাল এর গল্প সবারই জানা .

ঠাকুর নগর মতুয়া মেলা থেকে বেরিয়ে রওনা হলাম বনগাঁর  উদ্দেশে . শর্টকাট রাস্তা টি একজন আমাদের দেখিয়ে দিলেন. কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই মেঠো পথে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম. বাঁশবাগান খালবিল কারোর বাড়ির উঠোনের উপর দিয়ে পথ চলা শুরু হলো. বাঁশ বাগানের শৈল্পিক রূপে মুগ্ধ্য হয়ে কোথা দিয়ে ২৪ মাইল রাস্তা পেরিয়ে এলাম  বুঝতেই  পারলাম না. যশোর রোডের  দুই ধারে বিশাল বিশাল গাছের সারি. ১০০/২০০ বছরের পুরাতন. কান্ড আর ডালপালা কে আশ্রয় কোরে বেড়ে উঠেছে অর্কিডের এর মতন পরজিবী গাছ.   ঘন সবুজ তোরণ এর মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে এগিয়ে চলেছি. প্রথমে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখে নেবো. রাস্তার কোথাও ওনার নাম বা কিছুই নির্দেশ করা নেই. এখন বাড়িটি নানান শরিক এ ভাগ হয়ে গেছে. ফলকহীন দরজা পেরিয়ে বিশাল উঠান ও দালান বাড়ি. দেখে ভালো লাগলো যে, সরকারি সাহায্য ছাড়াই বাড়িটি ভালো ভাবে  সংরক্ষিত. আবার যশোর রোড ধরে পেট্রোপোল সীমান্তের দিকে রওনা হলাম. একটু পরেই ইচ্ছামতী নদীর ব্রিজ পড়লো. ছোটোবেলার কবিতা গল্পে জড়িয়ে রয়েছে ইচ্ছামতী. মনে পরে গেল ,’ যখন যেমন মনে করি /তাই হতে পাই যদি /আমি তবে একখানি হই/ ইচ্ছামতী নদী. কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এভাবেই ঠাঁই পেয়েছে ইছামতী.  খুব ইচ্ছা করছিলো কিছুক্ষন অন্তত নদীর রূপসুধা পান করি . কিন্তু  পেট্রাপোল থেকে ১০৩ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে কলকাতায় ফিরতে হবে, তাই দেরী করার উপায় নেই. বাংলাদেশ সীমান্ত যতই কাছে চলে আসছে ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতি মনের কোনায় ভিড় জমাচ্ছে. মা মাসির গল্পে কত না শুনেছি বাংলাদেশের গল্প. বাগেরহাট, মেঘিয়া, কলসকাঠি.  ইচ্ছা থাকলেও ওদের কারোরই আর নিজেদের জন্মস্থানে যাওয়া হয়নি. এর আগে ভারত পাকিস্তান ও চাইনা বর্ডার দেখেছি. সীমান্তের অনেক আগে থেকেই বেশ কড়াকড়ি নজরে পড়েছিল . এখানে সেরকম কিছুই নজরে পড়ছে না. একদিকে ইমিগ্র্যাশন অফিস আর অন্যদিকে বাস স্টপ, চায়ের দোকান, স্পাইস হোটেল. পেছনে রেলস্টেশন.  ২০১৩ তে পেট্রাপোল আর বেনাপোলে  জয়েন্ট রিট্রাইট সেরেমনি  চালু  করা হয়. যেমন ওয়াঘা ( wagah বর্ডার) হয়ে থাকে. প্রতি দিন এখানে  BSF (Border Security Force) and BGB (Border Guard Bangladesh) এর ফ্ল্যাগ মার্চ হয়. সবই ওয়াঘা সীমান্ত র মতনই হয়ে থাকে. এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা তাই পর্যটকও হাতে গোনা . আমারা  নাম সই করে bsf এর অফিস প্রাঙ্গন এ প্রবেশ করলাম. ওখানে একটি ছোট্ট মন্দির. পেছনে বাঁশ ঝড় তার পর একটি খাল এর পরই   বাংলাদেশ. সবুজ ছাউনি দেওয়া ঘরের সামনে এক খালি গা লুঙ্গি পরা  জওয়ান কে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম.  পাশেই রয়েছে তালা বিহীন ভারত বাংলাদেশ গেট. খোশ মেজাজে দুই দেশের জওয়ানা কে গল্প করতে দেখে ভারি আনন্দ পেলাম. ফটো তুলতে দ্বিধা বোধ করছিলাম. কিন্তু কারোরই আমাদের দিকে নজর নেই. ভরসা করে এগিয়ে গেলাম গেট এর কাছে .বাংলাদেশের  হাসি খুশি বয়স্ক জওয়ান টির  সঙ্গে গল্প জমে উঠলো. আমার মা বাবারা বাংলাদেশ এ জন্মেছেন  শুনে উনিও আনন্দ পেলেন. আমার দাদু বাগেরহাট এ প্রফুল্ল্যচন্দ্র রায় কলেজ এর ইংলিশের অধ্যাপক ছিলেন জেনে এত খুশি হলেন, কারণ ওনার বাড়িও বাগেরহাটে . আমাকে নৃমন্ত্রন জানালেন, ‘ আমাগো দেশে আহেন, কোনো অসুবিধা নাই, বেড়াইয়া যান’. মনে এটি ভরসা পেলাম যে গেটের বাইরে হাত বের করে নির্দ্বিধায় ওপারের ফটো তুললাম. বাংলাদেশের ভেতরে তখন ভারতে  আসার জন্য ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইন. আজকাল একদিনের ও ভিসা পাওয়া যাচ্ছে. মানে বনগাঁ থেকে ওপারে হেঁটে  হেঁটে ঢুকে পড়লেন. অটো রিক্শা, বাস সব পেয়ে যাবেন যশোর, খুলনা ঢাকা সব জায়গাতে যাওয়ার জন্য. ইলিশ মাছ আর ভাত খেয়ে আবার এ পারে চলে আসতে পারবেন. কিন্তু এ কি দেখছি ! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে. এক কাগজ কুরুনু বুড়ি মা নিস্চিন্তে ভারতের গেট পেরিয়ে  বাংলাদেশে ঢুকে গেল. এপারের জওয়ান রা ‘ও বুড়ি মা, ও বুড়ি মা কোথায় যাচ্ছো’, বলে চাচ্যালেও তিনি কান না দিয়ে স্মার্টলি ওপারে চলে গেলেন. আরো এক  অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম. বাংলাদেশের দিকে ইমিগ্রশনের লম্বা  লাইন   পাশের দিকের  একটা ছোট্ট গেট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে. লাইন থেকে যদি কেউ এদিক ওদিক চলে যায় তা নজরদারি করার কোনো ব্যবস্থা নেই. কোথাও কোনো কাঁটা তারের বেড়া নেই. দুই দেশের ট্রেন  লাইন এর সাইনবোর্ড জীর্ণ অবস্থাতে ওয়েলকাম জানাচ্ছে. টেনশন হীন এইরকম সীমান্ত দেখে মন আনন্দে ভোরে গেল. তাইতো এই রকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তো হওয়ার কথা. যদি পাকিস্তান এর সঙ্গে এরকমই সম্পর্ক হতো. তা হলে এত মানুষের প্রাণ যেত না. তবে আপাত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই  ছবির আড়ালে কি ঢাকা পড়ে গেল ,মহিলা , শিশু, গরু  পাচার ও অবৈধ চোরাচালানের নিত্য কাহিনী ? এবার ফেরার পালা. বনগাঁর খাঁটি কাঁচাগোল্লার  গল্প আগেই শুনেছিলাম.  টিনের চলার মিষ্টির দোকানের নরমপাক এর আস্বাদন সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো. কলকাতার পাঁচতারা মিষ্টির দোকানের কাঁচাগোল্লা এর ধরে কাছে ঘেঁষতে পারবে না. সন্দেশের প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম.এ যাত্রা তে র  বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যের বাড়ি দেখা হলো না. আবার আস্তে হবে ইছামতীর টানে. মনের অন্তরালে যে অনুভব করছি এক অপ্রতিরোধ্য আহ্বান ,’ আহেন আমাগো দেশে আহেন’/ দেশভ্রমণ-দেশের সময়ঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here