বাঘের জন্য এপিটাফ…..।।

অশোক মজুমদার

বাগঘরার জঙ্গল এখন শান্ত। কমে গেছে কৌতূহলী মানুষজনের ভিড়, বনকর্তাদের আনাগোনা। বিদায় নিয়েছে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফাররা। এখন বাতাসে শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে গল্প, অনুমান আর কী হতে পারতো তা নিয়ে বিশ্লেষণ ও চাপানউতোর। তবে সেলফিবাজদের উত্তেজনায় এখনও ভাঁটা পড়েনি। বাঘের মৃতদেহের পাশে বা তার ওপর ঠ্যাং তুলে দাঁড়িয়ে বীরত্ব ফলানো ছবি এখনও ভেসে যাচ্ছে মোবাইল থেকে মোবাইলে। মরে গিয়েও বাঘটি সোশ্যাল মিডিয়ার দেখনদারদের সার্ভিস দিয়ে চলেছে। আর কিছুদিন পর এসবও থেমে যাবে। আদিবাসী মানুষ, বাঘরোল, বুনোশুয়োর, সাপ, বেজি, ভাম, গোসাপ ইত্যাদি দু চারটে ছোটখাটো বনচর, চোরাশিকারি ও কাঠুরেদের নিয়ে এই জঙ্গল আবার জঙ্গলেই ফিরে যাবে।

আমার মনে হয় নিজের প্রাণ দিয়ে বাঘটি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও বনবিনাশের বিপদ বুঝিয়ে দিয়ে গেলেও হুঁশ ফিরবে না আমাদের। স্থানীয় মানুষ বন সংরক্ষণের বদলে তাকে শুধু একটা রোজগার ও আহরণের জায়গা হিসেবেই দেখবেন। অবাধে চলবে গাছ কাটা ও চোরাশিকার। জঙ্গলে ডিউটি দিয়েও বনকর্মীরা সেই দশটা পাঁচটার সরকারি বাবু হিসেবেই থেকে যাবেন। এন জি ও রা শহরের পাঁচতারা হোটেলে জঙ্গল বিনাশের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সেমিনারের আয়োজন করবেন। তাতে আর কিছু না হোক ফান্ড বাগানো যাবে। আর আমরা যারা বাইরে থেকে জঙ্গল দেখতে যাই তারাও এলাকাটাকে একটা মস্তি আর হুল্লোড়ের জায়গা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবো না। কারণ আমাদের কাছে বাগঘরা তো ‘রাত গ্যয়া তো বাত গ্যয়া’র’ মত খবরের কাগজ আর টিভির খবর ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেছে।

আমার মনে হয় এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে, একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘকে অন্তত তার পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিচরণের জায়গাসমেত একটা অরণ্য আমরা দিতে পারি সেই কাজটা আমাদের এখনই শুরু করা উচিৎ। সেখানে চোরাশিকারি আর গাছ কাটার সংগঠিত চক্র থাকবে না। বনজীবী মানুষরা বাঁচার প্রয়োজনে জঙ্গলে নিশ্চয় ঢুকবেন কিন্তু প্রথার ধুয়ো তুলে নির্বিচার শিকার বন্ধ করতে হবে। আদিবাসী মানুষদের এটা ধৈর্য ধরে বোঝানোর প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু স্থানীয় বনকর্মীদেরই। এমনিতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে জঙ্গলের ছোটখাটো প্রাণী মারলেও বাঘ, হাতির মত বড় জন্তু ওরা মারেন না। বরং পুজো করেন। তাই তাদের ঘাড়ে দোষ চাপানোটা কোন কাজের কথা নয়। বরং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অরণ্য সংরক্ষণের কাজ শুরু করলে হতভাগ্য বাঘটির ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পাপ কিছুটা লাঘব হবে।

আদিবাসীদের চোরাশিকারি ও কাঠ ব্যবসায়ীরা যাতে ব্যবহার করতে না পারেন বনকর্মীদের সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নাহলে এই গরীব মানুষগুলি তাদের হাতে ব্যবহৃত হবেন। লোক লাগলে সংশ্লিষ্ট বনকর্তাদের বলুন, কিন্তু দায়িত্ব এড়িয়ে বসে থাকবেন না। ব্যাঘ্র সংরক্ষণের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাজ্যে একটা বাঘ আপনাদের নজরদারি সত্বেও পিটিয়ে মারা হল তা কিন্তু আপনাদেরই লজ্জা। শুনি, এন জি ও রা এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করেন। কিন্তু তা মোটেই বাড়েনি। তা হলে এ ঘটনা ঘটতো না। তাদের কাজ মনিটর করার একটা সংহত ব্যবস্থা থাকা দরকার। শুধু একটা ঝকঝকে ইংরেজিতে একটা মোটাসোটা রিপোর্ট পেশ করে দিলে দায়িত্ব মিটবে না।

বাগঘরার হতভাগ্য বাঘটি নিজের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের বন ও বন্যপ্রাণ বিনাশের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়ে গেছে। বাগঘরা একটা শিক্ষা। এই শিক্ষা ও শিক্ষাদাতাকে আমাদের মনে রাখতে হবে। আমার মনে পড়ছে গরুমারার জঙ্গলের বন দপ্তরের বিখ্যাত কুনকি হাতি যাত্রাপ্রসাদের কথা। মানুষকে সে খুব ভালবাসতো। অন্য হাতিদের আক্রমণে সে মারা যায়। গরুমারায় তার একটা স্ট্যাচু রয়েছে। তা বন্যপ্রাণ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছে। বাগঘরার জঙ্গলেও এই হতভাগ্য বাঘটির স্মরণে একটা স্ট্যাচু বসাতে পারি আমরা। যার নিচে থাকবে বাংলার কোন এক বিখ্যাত কবির লেখা একটি এপিটাফ। এই শোকগাথা আমাদের মর্মান্তিক ঘটনাটিকে বারবার মনে করিয়ে দেবে। জাগিয়ে রাখবে একটি যন্ত্রণাময় স্মৃতি। ১৩ই এপ্রিল যেদিন বাঘটির মৃতদেহ পাওয়া গেল সেদিনটিকে রাজ্য জুড়ে বন্যপ্রাণ সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করার কথাও ভাবা যেতে পারে।

মনে রাখবেন, আমাদের এই প্রিয় সবুজ গ্রহটি বন ও বন্যপ্রাণ ছাড়া অসম্পূর্ণ। দুটোকেই রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু মানুষের। ভালোবাসা ছাড়া একাজ হবে না।

অশোক মজুমদার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here