দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ওপার বাংলার মৌ-পরিবার যুক্ত হয়েছে এপার বাংলার সঙ্গে। যৌথ পরিবার তৈরি হয়েছে। এমন বন্ধুত্ব যা আগে দেখা যায়নি।

ইচ্ছামতীর ওপার থেকে একঝাঁক মৌমাছি উত্তর ২৪ পরগনার টাকির কাছে অন্য এক মৌ-পরিবারে এসে মিলেছে। কেউ তাদেরকে আনেনি। তারা নিজেরাই উড়ে এসেছে। এপার বাংলায় এসেই এখানকার মৌমাছিদের প্রেমে পড়ে গেছে। তারা আর ফিরে যেতে চায় না। একসঙ্গে জোট বেঁধে পরিবার তৈরি করে ফেলেছে। এপারের মৌমাছিরাও দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছে তাদের। মিলেমিশে একাকার দুই বাংলা।

টাকিতে মৌপালক সলমন সাহাজি মৌমাছি প্রতিপালন করেন। তাঁর বাড়িতে এক ঝাঁক মৌমাছি আছে। সলমনের দাবি, তারা সকলেই পোষা। সলমন ও তাঁর পরিবারকে চেনে। হাতে বসলেও হুল ফোটায় না। পরম যত্নে তাদের প্রতিপালন করেন মৌপালক সলমনও। প্রতিটা মৌমাছিই নাকি তাঁর চেনা। প্রত্যেককে আলাদা করে স্বভাব, বৈশিষ্ট্যে চেনেন সলমন।

তিনি এক দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এক অভূতপূর্ব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এমন অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম। সলমন জানিয়েছেন, ইছামতীর ওপার অর্থাৎ বাংলাদেশের শ্রীপুর-হাড়তদার দিক থেকে একঝাঁক মৌমাছি উড়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের টাকির কাছাকাছি একটা ইটভাটায় ঠাঁই নেয়। ইটভাটার কর্মীরা একঝাঁক মৌমাছি দেখে ভয় পেয়ে সলমনকে খবর দেন। মৌপালক হিসেবে তিনি এলাকায় বেশ পরিচিত। সলমন তাঁর দলবল নিয়ে গিয়ে ওই মৌমাছির ঝাঁককে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। কিছুদিন পরে তিনি দেখেন, তাঁর কাছে যে মৌমাছির দল ছিল যাদের তিনি প্রতিপালন করেন, সেই দলটা উড়ে গিয়ে বাংলাদেশি মৌ-পরিবারের সঙ্গে মিলে গেছে। দুই পরিবারে বেশ আত্মীয়তাও তৈরি হয়েছে। দুই মৌ-পরিবারই একে অপরকে সাদরে আপ্যায়ণ করে গ্রহণ করেছে। কোনও বিরোধ নেই তাদের।

সলমন বলছেন, এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। কাঁটাতার আসলে ভালবাসা, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার পথে বাধা হতে পারে না। মনের টান থাকলে কেউ পর নয়, সকলেই আপন। এপার আর ওপার বাংলা আসলে দুটো ভৌগোলিক অবস্থান মাত্র। তাতে ভালবাসায় ছেদ পড়েনি। সে মানুষ হোক বা মৌমাছি, প্রকৃতিই তার সন্তানদের মিলিয়ে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পতঙ্গবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। মৌমাছিরা সমাজবদ্ধ জীব, একদল মৌমাছি অন্যদল মৌমাছিকেই খোঁজে। যদি এক ঝাঁক মৌমাছি অন্য জায়গায় চলে আসে তাহলে তারা সেই জায়গায় মৌমাছির ঝাঁক বা মৌচাকই খুঁজবে। স্বজাতিদের চিনে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে এদের। আর এর পিছনে মৌমাছিদের শরীর নিঃসৃত এক রাসায়নিক ফেরোমনের ভূমিকাও আছে।

ফেরোমন হল রাসায়নিক পদার্থ। প্রাণীর শরীর থেকে এই রাসায়নিক নির্গত হয় যা সেক্স হরমোনের মতো কাজ করে। তবে ফেরোমনের অন্য ভূমিকাও আছে।

ফেরোমনের গন্ধেই মৌমাছিরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ওপার বাংলা থেকে যে মৌমাছির ঝাঁক উড়ে এসেছিল তারা এপার বাংলার মৌমাছিদের ফেরোমনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়েই সেদিকে উড়ে গিয়েছিল। এই দুই মৌ-পরিবারের মিলন হয়েছে ফেরোমনের কারণেই।

অন্যান্য পতঙ্গদের মধ্যেও এমনটাই দেখা যায়। কোনও এক প্রজাতির স্ত্রী মশা যে জায়গায় ডিম পেড়ে যায়, সেই প্রজাতির অন্য স্ত্রী মশাও সেখানেই গিয়ে ডিম পাড়ার চেষ্টা করে। কারণটা সেই ফেরোমন। মশার শরীর থেকে বেরনো বিন্দু বিন্দু রাসায়নিক সেই জায়গায় পড়ে থাকে। ওই গন্ধ শুঁকেই স্বজাতিকে চিনতে পেরে সেই নির্দিষ্ট জায়গায় উড়ে যায় মশারা। পিঁপড়েরাও একইভাবে ফেরোমনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখে, এমনকি কথোপকথনও চালায়।

ফেরোমন শরীরের বাইরের গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়। কাজের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে ফেরোমনের অনেকগুলো ভাগ আছে, যেমন–ট্রেল ফেরোমন, অ্যালার্ম ফেরোমন, সেক্স ফেরোমন ইত্যাদি। ট্রেল ফেরোমনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, খাবারের খোঁজ করা, খাবার নিয়ে আসা, প্রজনন, কলোনির সীমানা নির্দেশ এ রকম নানা ধরনের কাজ হয়। আর দ্বিতীয়টায় হয় সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সহকর্মীদের সাবধান করা ও যুদ্ধের জায়গায় ডেকে আনা আর শত্রুকে তাড়ানো।

মৌমাছিদের শরীর থেকে দুই ধরনের ফেরোমন বের হয়–প্রাইমার আর রিলিজার । প্রাইমার ফেরোমনের কাজ যোগাযোগ রাখা, প্রজননে সাহায্য করা, এমনকি স্বভাব-আচরণ বিধিও নিয়ন্ত্রণ করা। দ্বিতীয় ফেরোমন কম পরিমাণে বের হয়। সাধারণ প্রাইমার ফেরোমনই আকর্ষণের মূল কারণ।

পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ বলছেন, মৌমাছি সুষ্ঠু রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলে। সেই রাজতন্ত্রে একজনই রানি মৌমাছি যে শাসনভার চালায়। বাকিরা সকলেই কর্মী মৌমাছি। রানি মৌমাছিই একমাত্র প্রজননে সক্ষম, জীবদ্দশায় রানির কাজ দফায় দফায় ডিম পাড়া। সেই কাজে রানিকে সাহায্য করে কিছু পুরুষ মৌমাছি বা ড্রোন যাদের আয়ুষ্কাল খুবই কম। রানির সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরেই তাদের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। এই রাজতন্ত্রে মুখ বুঝে কায়িক পরিশ্রম করে চলে কর্মীরা। এরা স্ত্রীলিঙ্গ কিন্তু বন্ধ্যা। এদের কাজ রানির দেখাশোনা, বাচ্চা মানুষ করা, মধু তৈরি করা ইত্যাদি। মৌমাছিদের মাঝে রয়েছে নির্ধারিত জাতভেদ।

কিছু মৌমাছি জন্মসূত্রেই রানী মৌমাছি, কিছু রয়েছে ড্রোন আর কিছু হল কর্মী মৌমাছি। তাদের সবার পূর্ণতাপ্রাপ্তির সময়সীমাও আলাদা–ড্রোনদের জন্য বরাদ্দ ২৪ দিন, কর্মীদের ২১ দিন আর রানী মৌমাছিটির জন্য ১৬ দিন।

একটি রানি মৌমাছির জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটে ড্রোনদের মাধ্যমে ডিমকে নিষিক্ত করতে এবং মৌচাকে ডিম পাড়তে। দৈনিক দু’হাজারের বেশি ডিম পাড়তে পারে রানি মৌমাছি। নিষিক্ত ও অনিষিক্ত দুই ধরনের ডিমই পাড়ে। নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে কর্মী মৌমাছি হয় এবং অনিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে হয় ড্রোন অর্থাৎ পুরুষ মৌমাছি। 

নিষিক্ত ডিম থেকে রানি মৌমাছিও হয়, তবে সেটা কর্মীরা নির্ধারণ করে। তারা রানি বেছে নেয়। এ দলের রানি বুড়ি হয়ে গেলে এবং অন্যদলে প্রজননক্ষম রানি থাকলে তারা সেই দলের সঙ্গে গিয়ে যোগ দেয়। সদ্য যৌবনা প্রজননক্ষম রানিই পছন্দ কর্মীদের। আর রানির খোঁজ তারা পায় ফেরোমনের গন্ধেই। দেবাশিসবাবু বলছেন, এটাও একটা কারণ হতে পারে দুই বাংলার মৌমাছির মহা-মিলনের।

তবে বিজ্ঞানসম্মত কারণ যাই থাক, মৌপালক সলমন খুব খুশি। তাঁর বিশ্বাস দুই বাংলার মৌমাছিরা একসঙ্গে মিলেমিশে পরাগ সংযোগ ঘটাবে। বাংলাকে সুজলা সুফলা করে তুলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here