দেশের সময়: কথায় আছে, প্রতিদিন একটি করে আপেল খেলে ডাক্তারের কাছ থেকে দূরে থাকা যায়।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের সঙ্গে আপেলের পরিচয়। আদম আর ইভের গল্প মনে আছে নিশ্চয়! আপেলে কামড় বসিয়েই তো সম্পর্কের শুরু। বলা যেতে পারে, পথচলা শুরু মানব জাতির। অন্তত ইতিহাস সে কথাই বলে। ফলে এই ফলটি মোটেই হেলাফেলার নয়। বড় যত্নের। আদরের।


লাল টুকটুকে কিংবা সবুজ। চোখ ধাঁধানো রং। সুস্বাদু। পেট ভরে। ছোটদেরও পছন্দের। অনেকে তো আবার আপেলের পোকা। এটি শরীরে ভীষণরকম উপকারে লাগে।


কিন্তু আপেল খেতে গিয়ে অবশ্য তার বীজের কথা খেয়াল থাকে না আমাদের। জিভে পড়লে কখনও সখনও ফেলে দিই। কিন্তু অনেক সময়েই নিজেদের অজান্তে পেটে চলে যায় আপেলের বীজ।


কিন্তু, এই আপেলের বীজ থেকে কী ক্ষতি হতে পারে, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসঙ্গে বেশি আপেলের বীজ যদি চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন কেউ, তা হলে সাঙ্ঘাতিক বিপদ হতে পারে। কারণ, এই আপেলের বীজের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে প্রাণঘাতী বিষ!
চমকে উঠলেন নিশ্চয়। তা হলে ভেঙে বলা যাক। চিকিৎসকরা বলছেন, আপেলের বীজের উপর যে খোসাটি থাকে, সেটি বেশ শক্ত। আমরা যদি না চিবিয়ে ওই বীজ খেয়ে নিই, তা হলে সেরকম অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যদি চিবিয়ে খাই, তা হলেই সমস্যা হতে পারে।


কিন্তু কেন?
এর মূল কারণ, আপেলের বীজের মধ্যে থাকে অ্যামিগাডলিন নামে এক ধরনের যৌগ। পেটের ভিতর উৎসেচকের সংস্পর্শে এসে যা তৈরি করে সায়ানাইড। চিনির সঙ্গে মিশে তা পরিণত হয় হাইড্রোজেন সায়ানাইডে। যা মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।
যদিও চিকিৎসকদের বক্তব্য, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অবশ্যই আপেল খাবেন। কিন্তু সতর্ক হয়ে। তাঁদের মতে, আমরা দিনে যদি একটি বা দু’টি আপেলের বীজ ভুল করে চিবিয়ে খেয়েও ফেলি, তা থেকে যে হাইড্রোজেন সায়ানাইড তৈরি হয়, পরিমাণ খুবই কম। শরীর তা মানিয়ে নিতে পারে। তা ছাড়া ভিটামিন বি-১২’এর জন্যও কিছুটা হাইড্রোজেন সায়ানাইড লাগে। শরীর তা সাপ্লাই করে। তবে একসঙ্গে বেশি পরিমাণ আপেলের বীজ চিবিয়ে খেয়ে ফেললে সেক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। আর যেহেতু হাইড্রোজেন সায়ানাইডের কোনও অ্যান্টিডোট নেই, ফলে দেখা দিতে পারে বিপদ।


কতটা আপেলের বীজ খেলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে?
মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি আপেলের বীজে গড়ে ০.৪৯ মিলিগ্রাম সায়ানোজেনিক যৌগ থাকে। একটি গোটা আপেলে বীজ থাকে সাত-আটটি। ফলে একটা আপেলে থাকা সব বীজ চিবিয়ে খেলে সায়ানাইডের পরিমাণ হবে মোটামুটি ৩.৯২ মিলিগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শরীরের ওজন প্রতি কেজি হিসেবে এক মিলিগ্রাম সায়ানাইড বিপদের কারণ হতে পারে। সেই হিসেবে একজন ৬৫ কেজি ওজনের মানুষ যদি একসঙ্গে কমপক্ষে ১৩২টি আপেল-বীজ চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন, তা হলে তাঁর মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর জন্য দরকার ১৮-২০টি আপেল।


বেশি পরিমাণ আপেলের বীজ চিবিয়ে খেয়ে ফেললে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সামান্য পরিমাণ সায়ানাইড হার্ট ও মস্তিস্ককে অচল করে দিতে পারে। হার্ট অ্যাটাক, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাছাড়া বেশি পরিমাণ আপেলের বীজ চিবিয়ে খেয়ে ফেললে সমস্যা হতে পারে পেট ও খাদ্যনালীতে। সায়ানাইড লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হাইপক্সিক অর্গ্যান ড্যামেজ হতে থাকে। তাই সাবধান। আপেল খেতে হবে। কিন্তু অবশ্যই তার বীজ ফেলে দিয়ে।


মনে করা হয়, সমস্ত উদ্ভিদের মধ্যে প্রথম যা চাষের আওতায় আসে তা হল আপেল। হাজার হাজার বছর ধরে নির্বাচনের মাধ্যমে এর জাত উন্নত হয়েছে।

আলেকজাণ্ডার দি গ্রেট ৩২৮ খিষ্ট্রপূর্বাব্দে কাজাখস্তানে খাটো প্রজাতির আপেল গাছ খুঁজে পান। এবং তিনি সেটি মেসিডোনিয়াতে নিয়ে যান। আপেল নিয়ে গল্পের শুরু আজকের নয়। নানা পৌরাণিক কাহিনী আর ধর্মীয় লেখায় উল্লেখ রয়েছে এই ফলটির। তবে কোনওটাই বর্তমান আপেলের গল্প নয়। আমেরিকায় একসময় নতুন মানুষকে স্বাগত জানাতে প্রচুর আপেল গাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। কারণ, সেসময় কেউই তেমন আপেল খেতে পছন্দ করতেন না। কারণ, ফলটি ছিল তেতো। ঠিকই শুনেছেন, আজ যে সুমিষ্ট ফল আপেল খাই আমরা, সেটাই একসময় এতটা তেতো ছিল যে, দাঁতে কাটা যেত না। যুগ যুগ ধরে অনেক চেষ্টার পর মান বাড়ানো হয় আপেলের। তবে আপেল খাওয়ার চল শুরুর আগে তা অ্যাপল সাইডার হিসেবেই পরিচিতি পায়।


মিষ্টি স্বাদের জন্য আপেল পৃথিবীজুড়েই সমাদৃত। গোটা বিশ্বে এই ফলটি চাষ হয়ে থাকে। সবমিলিয়ে আপেলের প্রায় সাড়ে সাত হাজার প্রজাতি রয়েছে। সবথেকে বেশি চাষ হয় আপেলের ম্যলুস প্রজাতির। মধ্য এশিয়াকে আপেলের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়। যেখানে এখনও আপেলের পূর্বসুরী ম্যলুস সিভেরসিকে দেখতে পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এশিয়া এবং ইউরোপজুড়ে আপেলের চাষ হয়ে আসছে। ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মাধ্যমেই লাতিন আমেরিকায় পা রাখে আপেল।


এবার আসা যাক, আপেলের গুণাগুন প্রসঙ্গে। অনেকেরই ধারণা, লাল আপেলের চেয়ে সবুজ আপেল বেশি উপকারি। বাজারে এজন্য সবুজ আপেলের দামও বেশি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আসলে লাল আপেলের নিকটাত্মীয় সবুজ আপেল। সেই সঙ্গে আরও একটি বিষয় জানার থেকে যায়, তা হল আপেল কি সবাই খেতে পারেন? দিনে বা সপ্তাহে ক’টি আপেল খেলে রোগব্যাধি থেকে কিছুটা হলেও দূরে থাকা যায়।


কেউ কেউ আবার আপেলের খোসা ছাড়িয়ে খান। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এমনটা করবেন না। কারণ, ডায়েটারি ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্লাভোনয়েড এগুলি আপেলের ত্বকেই বেশি থাকে। ফলে খোসা ফেলে দিলে তা নষ্ট হয়ে যায়।


চিকিৎসকরা বলছেন, আপেলে পেকটিন জাতীয় উপাদান থাকে। যা কোলন ক্যান্সার রোধ করে। ফুসফুস ও লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। ভালো রাখে হার্ট। আপেলে থাকা ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট উপাদানগুলি স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারি। আপেল খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আপেল দাঁতের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। ফলে ভালো থাকে দাঁত। ত্বক উজ্জ্বল থাকে।

হজমের জন্য উপকারি ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে পারে আপেল। ফলে হজমশক্তি বাড়ে। অ্যালঝাইমার্স রোগের শঙ্কা অনেকটাই কমে। আপেলে ভালোমাত্রায় জল থাকে। ফলে আপেল খেলে শরীরে জলশূন্যতা দূর হয়। শরীর ঠান্ডা থাকে। অনেকে ভাবেন, আপেল খেতে মিষ্টি লাগে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা খেতে পারবেন না। তা কিন্তু নয়। আপেলে থাকা পেকটিন রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ধীর করে। ইনসুলিনের পরিমাণ ঠিক রাখে। ফলে নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়াবেটিস। আপেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বোরণ থাকে। যা হাড় শক্ত রাখতে সাহায্য করে।

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের বিজ্ঞানীরা একাধিকবার বলেছেন, আপেল পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এমনই একটি ফল যে, আপনার টাইপ টু ডায়াবেটিস থাকলেও নিশ্চিন্তে এটি খেতে পারেন। অনেকের ধারণা আছে, আপেল খেলে ফ্যাট বাড়ে। একেবারেই ভুল। বরং এর উল্টোটা। আপনার ওবেসিটি থাকলে রোজ একটি করে আপেল খান। এমনই পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদরা।
আপেলে ভিটামিন এ, ই ও সি থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিয়মিত আপেল খেলে অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্তত ২৩ শতাংশ কমে যায়। ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে ২১ শতাংশ।

কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিজ কমে ৩৫ শতাংশ। আপেলে রয়েছে ট্রিটারপেনয়েডস উপাদান। যা লিভার, স্তন, কোলন ক্যান্সারের কোষ বেড়ে উঠতে বাধা দেয়। খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। আপেলে থাকা ফাইবার প্রায় ক্যালোরি ছাড়াই পেট ভরাতে সাহায্য করে। আপেলের ফ্লাভোনয়েড ও পলিফেনল যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের প্রধান উপাদান। এই উপাদান দু’টি আমাদের শরীরে ডিএনএ’র ক্ষতি রোধ করে। আপেল টার্টারিক অ্যাসিডের ভালো উৎস। যা শরীরকে ফ্রি র‌্যাডিক্যালের প্রভাব থেকে রক্ষা করে। আমরা নানা ধরনের খাবার খাই। এসবের মাধ্যমে শরীরে টক্সিন তৈরি হয়। লিভার থেকে সেই টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে আপেল। আপেলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিস্কের ডোপামিন উৎপাদনকারী স্নায়ুর কোষের ভাঙন প্রতিরোধ করে। ফলে পার্কিনসন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।


গবেষণা বলছে, যাঁরা সপ্তাহে পাঁচটি আপেল খান, তাঁদের ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আপেল খেলে গলস্টোন হয় না। আপেলে পটাশিয়াম থাকলেও তা খুবই কম পরিমাণে। ফলে কিডনি রোগীদের জন্যও নিরাপদ। রোজ একটি করে আপেল খেলে শরীরে রক্ত জমাট বাধার আশঙ্কা কমে যায়। মুখের ব্রণ, কালো দাগ দূর হয়। পাকস্থলী থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হতে সাহায্য করে আপেল। পেট ফাঁপার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।

দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। ডায়ারিয়া সারাতে এবং মাসল টোন করতে সাহায্য করে।
ফ্রুট কাস্টার্ড, ফ্রুট স্যালাড বা জ্যাম-জেলি যেভাবে খুশি আপেল খাওয়া যায়। আর আপেল থেকে তৈরি আপেল সিডার ভিনিগারের হেল্থ বেনিফিট তো কম-বেশি সকলেরই জানা। এটি মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে।
তথ্য বলছে, ১০০ গ্রাম আপেলে রয়েছে ৫২ কিলো ক্যালোরি, শর্করা ১৩.৮১ গ্রাম, সুগার ৯.৫৯, ফাইবার ২.৪০ গ্রাম, প্রোটিন ০.২৬ গ্রাম, টোটাল ফ্যাট ০.১৭ গ্রাম, ফোলেট ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ২.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ৫৪ আইইউ, ভিটামিন ই ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪.৬ মিগ্রা।

তবে আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য অনেক সময় আপেলের গায়ে সিন্থেটিক ওয়াক্স স্প্রে করা হয়। এটি শরীরের পক্ষে খারাপ। হজম প্রক্রিয়া ও শ্বাসযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। পেটের ভিতর আলসার ও কোনও সংক্রমণ হতে পারে। ওয়াক্স যুক্ত আপেল খেলে অন্তঃসত্ত্বাদেরও অনেক সময় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেকারণে আপেল বাজার থেকে কিনে আনার পর তা গরম জলে ধুয়ে নিতে পারলে সবথেকে ভালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here