দেশের সময়: দার্জিলিংয়ের প্রাচীন নাম দর্জেলামা। ইতিহাস বলছে, দার্জিলিং পাহাড়ে মহাকাল মন্দিরের কাছে একটি অতি প্রাচীন গুহা ছিল। সেই গুহাপথে যাওয়া যেত ভুটানের লাসা পর্যন্ত। যদিও পরে সেটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই গুহার নাম থেকেই দার্জিলিং নামকরণ হয়।


ঠিক ম্যালের পিছনে বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মহাকাল মন্দিরে। পাহাড়বাসীর মতে, এই মহাকালই দার্জিলিংয়ের প্রাচীন দেবতা। মন্দিরে অবস্থিত দুর্জয় শিব লিঙ্গের নাম থেকেই দার্জিলিং নামকরণ হয়েছে।


বলা হয়, দুর্গম জঙ্গলের ভিতর একটি গুম্ফা ছিল। সেই গুম্ফার কাছেপিঠে পূজিত হতেন বজ্রযানী বৌদ্ধদের দেবতা মহাকাল। ১৭৭৫ সালের একটি লিপি থেকে জানা গিয়েছে, এটি সিকিমের পেডং মঠের শাখা ছিল। মহাকাল ঠিক কত প্রাচীন, তার কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। ইংরেজদের ইতিহাস বলে, ১৮১৫ সালে নেপালের শাহ বংশীয় হিন্দু রাজারা, যাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তাঁরা জায়গাটি আক্রমণ করেন। এবং বৌদ্ধ মঠটি ধ্বংস করে দেন। অনেক পরে ১৮৭৮ সাল নাগাদ স্থানীয় বৌদ্ধ ভুটিয়ারা নতুন করে একটি মঠ স্থাপন করেন দার্জিলিংয়ের লেবং রোডে। ভুটিয়াবস্তিতে সেটি এখনও আছে।


মহাকাল মন্দিরে আগে কালো পাথরে লিঙ্গাকার প্রতীক ও তার পাশে একটি ত্রিশূল ছিল। ভুটিয়াদের বিশ্বাস, এখানে শিবের বিয়ে হয়েছিল। তখনই তিনি ত্রিশূলটি ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের অপর নাম গৌরীশিখর। দার্জিলিংয়ের পশ্চিমে সিঙ্গালীলা নামে যে পর্বতশ্রেণি দেখা যায়, গৌরীশিখর তারই উপরে অবস্থিত। তিব্বতে একটি পর্বতমালা রয়েছে, তার নাম ‘শিবজটা’। ‘শিবলা-সঙ্কট’ নামেও রয়েছে একটি পর্বত। নামগুলি থেকেই অনুমেয়, মহাদেব ও পার্বতীর নামে এইসব পর্বতের নামকরণ হয়েছে।

শৈব ধর্মের প্রভাব রয়েছে পাহাড়জুড়ে। লেপচারা মহাদেবকে ‘চিরেনজি’ নামে উপাসনা করেন। তাঁদের মতে, চিরেনজির স্ত্রীর নাম ‘উমাদেবী’। মেচ জনজাতিও শিবের উপাসক। তাঁরা শিবকে বলেন ‘বথো’। কেউ কেউ আবার মহাকালও বলে থাকেন। লামারা শিবকে বলেন, পশুপতিনাথ। রাজবংশী কোচরা শিববংশীয় বলে পরিচয় দেন।


হিন্দুদের মতে, মহাকাল দেবী মহাকালীর ভৈরব। কালীপুজোর সময় এই মহাকাল ভৈরবের পুজো করতে হয়। আবার বজ্রযানী বৌদ্ধ সাধকরা দার্জিলিংয়ে মহাকালের উপাসনা করেন। মন্দিরের দু’পাশে দু’জন পুরোহিত বসে থাকেন। একজন হিন্দু পুরোহিত, অন্যজন বৌদ্ধ লামা। এ এক আশ্চর্য সহাবস্থান। দু’জনেই তাঁদের মতো করে পুজো করান দর্শনার্থীদের। পুণ্যার্থীরা সাতবার এই স্থান প্রদক্ষিণ করেন।

তার পর বেড়ার গায়ে, গাছের শাখায় নানা বর্ণের সুতো ও কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন। পতাকার মতো উড়তে থাকে সেগুলি। একে ‘বায়ুঘোটক’ বলে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, হাওয়ার সঙ্গে তাঁদের প্রার্থনা পৌঁছে যায় দেবলোকে। মহাকালের কাছে একটি হোমকুণ্ড আছে। সেখানে হোমক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিছু দূরে রয়েছে এক লামার সমাধি। আগে এখানে সময় জ্ঞাপক তোপধ্বনি দেওয়া হতো। এখন জলাপাহাড় থেকে তা দেওয়া হয়। খানিকটা দূরে পৃথক মন্দিরে পাথরে খোদাই করা দেবী মহাকালীর মূর্তি রয়েছে। তাঁর গায়ের রং নীল। দেবীর হাতের অস্ত্র অনেকটা বজ্রতারার মতো।


প্রবাদ আছে, নেপালের ফুন সো লামগে নামে এক রাজার আমলে লামারা এখানে গুম্ফা তৈরি করেন। তাঁরাই জায়গাটির নাম দেন দার্জিলিং। তাঁদের কথায়, ‘দ’ মানে পাথর। ‘বজে’ মানে শ্রেষ্ঠ। আর আর ‘লিঙ্গ’ মানে প্রদেশ বা স্থান। অর্থাৎ লামাদের পবিত্র পাথরের গুম্ফা বা তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গা।


অনেকে বলেন, দার্জিলিং নামটি এসেছে তিব্বতীয় শব্দ থেকে। দোর্জে শব্দের অর্থ বজ্রধ্বনি। যা মূলত ইন্দ্রের রাজদণ্ড। আর ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ জায়গা বা জমি। সুতরাং বজ্রদেশের দেশ।


ইতিহাস বলে, গোর্খারাজ পৃথ্বিনারায়ণ যুদ্ধ করে নেপাল দখল করেন। চারদিকে রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন তিনি। তিব্বত, দক্ষিণ চীনের কিছু অংশ, ত্রিহুত ও শারণ জেলা পর্যন্ত অধিকারে আসে তাঁর। ফলে সিকিমের রাজা রাজ্যচ্যুত হয়ে সদ্য ভারতে আসা ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। এর পর লর্ডমায়ারের সময়ে নেপালের রাজার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। গোর্খারাজ যুদ্ধে হেরে গিয়ে ১৮১৬ সালে ইংরেজ সেনাপতি, স্যার ডেভিড অক্টারলোনির সঙ্গে সন্ধি করেন। তাঁর শর্ত ছিল, সিকিম ও তার দক্ষিণদিকে ইংরেজদের প্রতিনিধি থাকবেন।


ইংরেজ সরকার অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিকিম রাজ্য তার উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দেয়। সিকিম, ইংরেজদের মিত্র রাজ্য হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু ১৮৩৪ সালে এসে আবার সিকিম ও নেপালের সীমানা নিয়ে বিবাদ দেখা দেয়। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সেই বিবাদ মেটান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর এ. লয়েড।
শোনা যায়, প্রখ্যাত দুই ব্রিটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জোসেক হুকার এবং স্যার এ. ক্যাম্পবেল সিকিম থেকে পরিব্রাজক হিসেবে ওষধি গাছপালার সন্ধানে বর্তমান দার্জিলিংয়ের পার্বত্য গ্রামটিতে আসেন।

এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তাঁরা। মেজর লয়েডকে তাঁরা জায়গাটির কথা বলেন। লয়েড তখন পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট। তিনি নিজে চোখে জায়গাটি দেখতে আসেন। শীতল পরিবেশ। চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি। মুগ্ধ হয়ে যান লয়েড। তিনি সিকিম রাজাকে অনুরোধ করেন বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে জায়গাটি দান করতে। সেকথা ফেলতে পারেননি সিকিম রাজা।


সিকিম, নেপাল, ভুটান ও ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে দার্জিলিং জেলার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৭৮০-১৮১৭ সালের মধ্যে নেপালিদের আধিপত্য, ইঙ্গ-গোর্খা যুদ্ধ, সগৌলির সন্ধি, তিতালিয়া চুক্তি জড়িয়ে রয়েছে সেই ইতিহাসের সঙ্গে।


১৮৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লেফটেন্যান্ট লয়েডকে তাঁর রাজ্যের সীমান্তের কিছুটা জায়গা দান করেন। তৈরি হয় দানপত্র। সেই দানপত্রে সিকিম রাজা লেখেন, রঙ্গিত নদীর দক্ষিণ থেকে বালাসন, কহাইল ও ছোট রঙ্গিত নদীর পূর্ব এবং রাঙ্গলি ও মহানন্দার পূর্বপাড় পর্যন্ত অঞ্চলটি উপহার দিলাম। এখানেই ইংরেজরা গড়ে তোলেন তাঁদের নয়া উপনিবেশ, যার নাম হয় দার্জিলিং। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাইয়ের কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত দার্জিলিং জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।


খাড়া পাহাড়। চির তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। গভীর জঙ্গল। ঝরনা। বন্য জীবজন্তু, এটাই ছিল এখানকার নিজস্ব সম্পদ। বেশিরভাগ সময় বৃষ্টি হয়। কখনও আবার চারদিক ঢাকা থাকা কুয়াশায়। মেঘ কেটে কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর সোনা রোদ পড়লে ঝলমলিয়ে ওঠে চারদিক। এই পাহাড়ের আদি-বাসিন্দা ভুটিয়ারা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বলতেন, খাচেন ঝঙ্গা। খাচেন শব্দের অর্থ মহাতুষার। ‘ঝ’ মানে শৃঙ্গ।

‘ঙ্গা’ মানে পঞ্চশৃঙ্গ। ভুটিয়ারা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেবতা মানেন। দুর্গম পাহাড়ের ভিতরে অপূর্ব মনোরম জায়গাটিতে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সেনানিদের গ্রীষ্মকালীন আবাস, যার নাম ছিল স্যানাটোরিয়াম। পরবর্তীতে ধীরে বঙ্গদেশের গভর্নরের গ্রীষ্মাবাস, অখণ্ড বাংলার বহু জমিদারের ও রাজার বিলাসবহুল আবাস তৈরি হয়। কিন্তু আবাস গড়ে তুলতেই তো হবে না, যাতায়াতের জন্য রাস্তা চাই।

১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি শুরু করেন। পাঙ্খাবাড়ি থেকে কার্শিয়াং পর্যন্ত প্রথম রাস্তা তৈরি হয়েছিল। রাস্তাটি তৈরি করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি লেফটেন্যান্ট লর্ড নেপিয়ার। রাস্তার কাজ শেষ করতে লেগেছিল পাঁচ বছর। তখন পাহাড়ে সাকুল্যে দশটি ঘর। তবে কয়েক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৩০টি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দার্জিলিংয়ের আবিষ্কর্তা লয়েডের বাড়ি মাউন্ট প্লেসান্ট। আর সেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানী জোসেফ হুকারের বাড়ি ব্রায়ান স্টোন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here