দেশের সময়: গত এক সপ্তাহ বা তার কিছু বেশি সময়, রাজ্যে সিপিএম অনেকটাই জেগে উঠেছে। চিরকূটে চাকরি নিয়ে তৃণমূল একের পর এক তথ্য সামনে নিয়ে আসতেই যেন শীতঘুম ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়েছে বামেরা। মিছিল, মিটিং করে নিজেদের অন্তত প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টায় মরিয়া সিপিএমের নেতা-কর্মীরা।

হ্যাশট্যাগ চোর টিএমসি বলে ‘দ্য লেফ্ট ক্রিয়েটিভ’-এর পক্ষ থেকে দুর্নীতির বর্ণপরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল করতে নেমে পড়েছে সিপিএমের আইটি সেল। আর এসবের জেরেই বঙ্গ বিজেপি যেন অনেকটাই কোণঠাসা।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আর বিশেষ দেরি নেই। আর ওটা তো ফাইনাল ম্যাচ। তার আগে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন, যেটা কি না সেমি ফাইনাল হিসেবেই দেখছে সব রাজনৈতিক দলই। এসময় বঙ্গ বিজেপির যখন গ্রামেগঞ্জে সংগঠন মজবুত করে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার কথা, তখন তাঁদের সেভাবে মাঠে ময়দানে দেখাই যাচ্ছে না। কলকাতায় কিছু কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে, কখনও আবার তিনি দিল্লি ছুটছেন। কিন্তু দলের বাকিরা কোথায়? এই প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করে দিয়েছে। তা হলে কি তৃণমূল যেটা চেয়েছিল, সেটাই হতে চলেছে? সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির অলিখিত জোট সাগরদিঘি মডেলকে ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ময়দানে নেমে পড়েছে জোড়াফুল শিবির। আর তাই জোড়াফলা নিয়ে আক্রমণে নেমেছেন তৃণমূলের নেতানেত্রীরা।

একদিকে, যখন খোদ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়ে কলকাতায় ধর্নায় বসছেন, ঠিক তখনই দলের সেনাপতি যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফাঁস করছেন চিরকূটে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর পরিবারের সদস্যদের চাকরির কেলেঙ্কারি। বঙ্গ বিজেপির বিপদ অবশ্য অন্য জায়গায়। মোদি-অমিত শাহরা সবসময় টার্গেট উঁচুতে বেঁধে দেন। সেই টার্গেটে পৌঁছনো সম্ভব নয় জেনেওে তাঁরা সেটাই করেন।

এবার কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে সন্দিহান খোদ বিজেপির একাংশ। কিন্তু লক্ষ্যকে তারা স্থির করেছেন অনেক উঁচুতে। স্লোগান তৈরি করা হয়েছে আব কি বার চারশো পার! দিল্লির তরফে বেঁধে দেওয়া এই তারে সুর মেলাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা বঙ্গ বিজেপির। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার আদৌ বুঝতে পারছেন না, কীভাবে অঙ্ক মিলবে। ২০২১ সালে রাজ্য বিধানসভায় অমিত শাহরা হুঙ্কার দিয়েছিলেন, আব কি বার ২০০ পার। কিন্তু পদ্মফুল আটকে গিয়েছে ৭০-এ। এবার তাই লোকসভায় বাংলা থেকে টার্গেট ২৫। যদিও বিজেপির এই টার্গেটের কথা শুনে তৃণমূল মস্করা করতে ছাড়ছে না। তাদের টিপ্পনি, বিজেপির তো পান্তাভাত খাওয়ারও অবস্থা নেই। এ তো দেখছি বিরিয়ানি খাওয়ার শখ জেগেছে। 

এনিয়ে অনেকে অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, ২০১৯ সালে লোকসভায় তিনশো আসন পার করেছিল বিজেপি। তা হলে এবার চারশো নয় কেন? রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, গত লোকসভায় ভোটের আগে দেশজুড়ে কাজ করেছিল জাতীয় ভাবাবেগ। তার সঙ্গে এই বাংলায় বিজেপির উত্থানের পিছনে ছিল তৃণমূলের নেতিবাচক ভোট। কারণ, তার এক বছর আগেই বাংলায় হয়ে গিয়েছিল পঞ্চায়েত ভোট। আর ওই ভোটে জেলায় জেলায় বিরোধীরা কার্যত সেভাবে প্রার্থীই দিতে পারেনি। বলা ভাল, অনুব্রত মণ্ডলদের দাপটে প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা। সাধারণ মানুষ মন খুলে ভোটবাক্সে তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারেননি। তারই জের আছড়ে পড়েছিল লোকসভা নির্বাচনে।

শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে রাজ্যে বিধানসভা ভোটে গো-হারা হেরে রণে ভঙ্গ দিয়েছিল কংগ্রেস ও বামেরা। ফলে মমতা বিরোধী ভোটাররা বিজেপিকেই খড় কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। এতদিনে তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের পর এক জনমুখী প্রকল্প গ্রামবাংলার মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রুপশ্রী, যুবশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প বাংলায় তৃণমূলের ভিতকে এতটাই মজবুত করেছে যে, এখনও তা টলে যাওয়ার মতো সময় আসেনি। মানুষ ট্রেনে-বাসে মমতার সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ঠিকই, কিন্তু বিকল্প? এই প্রশ্ন উঠতেই তাঁরা কাউকেই মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসানোর মতো সাহস দেখাচ্ছেন না। 

আর সিপিএম ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করেছে, ফলে তাদেরকে এখনই ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছেন না রাজ্যবাসী। এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের। বরং তাদের বক্তব্য, সিপিএম জেগে উঠলে অন্তত তাদের ভোট তাদের ঝুলিতেই যাবে। অর্থাৎ বামের ভোট রামে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেই সুবিধা তৃণমূলই পাবে। নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূল সরকারে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, একথা দলের নেতা-কর্মীরাও মানছেন। দুর্নীতিগ্রস্তরা শাস্তি পাক, এটা চান দলের সৎ নেতারা। কিন্তু এই দুর্নীতির শিকড় শুধু এই আমলেই নয়। 

তা ছড়িয়ে ছিল বাম আমলেও। তৃণমূলের তরফে দাবি করা হয়েছে, সিপিএম নেতা সুজনবাবুর পরিবারের এগারোজন সদস্য চাকরি পেয়েছেন। এটা কি আদৌও স্বাভাবিক কোনও ঘটনা? অভিযোগ তোলা হয়েছে, সুজনবাবুর স্ত্রী পরীক্ষা নিয়েই চাকরি পেয়েছেন। ফলে তৃণমূল সরকারের আমলে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে আঙুল তোলার আগে নিজেদের দিকে তাকানো উচিত সিপিএমের।

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, একটি লিস্টে তেরোজনের চাকরি পাওয়ার বিষয়টি আমি দেখেছি। ওই লিস্ট দেখে বলতে হচ্ছে, চোরের মায়ের বড় গলা। একটা পরিবার থেকে তেরোজনের চাকরি। কেউ বাদ যায়নি। তারা আবার দুর্নীতি নিয়ে বড় বড় কথা বলছে। আরও একধাপ এগিয়ে ওই তালিকা নিয়ে তদন্ত দাবি করেছেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি বলেছেন, একটি পরিবার থেকে এতজনের চাকরি পাওয়ার বিষয়টি মোটেই স্বাভাবিক নয়। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য সুজনবাবুর সাফ মন্তব্য, কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তা নিয়ে আদালতে যাক। প্রয়োজনে আদালতেই এর উত্তর দেব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here