দেশের সময় , কলকাতা: তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসে সম্প্রতি অভিযান চালায় ইডি। সংস্থার নিউ আলিপুরের অফিসে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নথি উদ্ধার করেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। এমনকী ইডির বিবৃতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংস্থার সিইও বলে উল্লেখ করা হয়।

মঙ্গলবার আদালতে শুনানির সময় ফের অভিষেককে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সিইও CEO বলে উল্লেখ করে ইডি। এরপরই বিচারপতি অমৃতা সিনহার মুখে শোনা যায় অভিষেক-প্রসঙ্গ। ইডির উদ্দেশে বিচারপতি সিনহার প্রশ্ন, ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি কতদূর? তিনি যদি এখনও সংস্থার সিইও হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে সমন পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে?’

বিচারপতির প্রশ্নের পর ইডির তরফে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, কলকাতা হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চে অভিষেকের সঙ্গে তাদের একটি মামলা চলছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর সেই মামলার রায়দান। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রক্ষাকবচ পেয়েছেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। পালটা বিচারপতি সিনহা বলেন, ‘হাইকোর্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রক্ষাকবচ দিলেও তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত না করা বা সমন না পাঠানোর নির্দেশ দেয়নি। কী কারণে অভিষেকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি, তা স্পষ্ট নয়।’ ১৪ সেপ্টেম্বর ইডিকে এই নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি সিনহা। অভিষেকের বিরুদ্ধে ইডির তোলা অভিযোগের ভিত্তিতে কী কী পদক্ষেপ, তা রিপোর্ট আকারে আদালতে জমা দিতে হবে তদন্তকারী সংস্থাকে।

অন্যদিকে পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তও এবার আদালতের নজরদারিতে হবে। মঙ্গলবার এই নির্দেশই দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা। প্রাথমিক নিয়োগে তদন্তে গঠিত সিবিআইয়ের বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট এবার পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করবে। পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তকারী আধিকারিক সুনীল রাওয়াত এদিন সিবিআইয়ের সিটে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

পুর নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও এদিন আদালতে বিচারপতির একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়েন সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিকরা। সিবিআই তদন্ত নিয়ে নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি সিনহা। তদন্তকারী সিবিআই আধিকারিকদের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ‘আপানাদের তদন্তে আদৌ কোনও অগ্রগতি আছে? আগে যা জানিয়েছেন, আজকের রিপোর্টেও কমবেশি একই তথ্য রয়েছে। তদন্তে নতুন তথ্য কোথায়? হঠাৎ করে তদন্তের গতি কী ভাবে কমে গেল? এই দুর্নীতির মাথা কে? আপনারা নীচ থেকে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন। উপর থেকে নীচে নামার ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?’

প্রসঙ্গত, গত ২১ অগস্ট লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কোম্পানিতে টানা ১৬ ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েছিলেন ইডি আধিকারিকরা।  ইডির প্রেস রিলিজ অনুযায়ী, সেখানে থেকে রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের তিনটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-স্টেটমেন্ট বাজেয়াপ্ত করেন তদন্তকারী অফিসাররা। সংস্থার ওই অফিসের তিনটি কম্পিউটারের নথি খতিয়ে দেখে একটি হার্ড ডিস্কও বাজেয়াপ্ত করেন গোয়েন্দারা।

তল্লাশির পর ইডি-র তরফে একটি প্রেস রিলিজ করা হয়। সেখানে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কোম্পানির COO অর্থাৎ চিফ অপারেটিং অফিসার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ওই প্রেস রিলিজে ইডি আরও দাবি করেছে, ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওই কোম্পানির ডিরেক্টর পদেও আসীন ছিলেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই কোম্পানিতে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে তিনি এখনও সিইও রয়েছেন বলে প্রেস রিলিজে দাবি করেছে ইডি।

ঠিক এখানেই প্রশ্ন করেন বিচারপতি অমৃতা সিনহা। তাঁর প্রশ্ন, “ইডি  প্রেস রিলিজে স্পষ্ট উল্লেখ করে দিয়েছে, লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপরও তাঁকে কেন সমন পাঠানো হচ্ছে না?”

মামলাকারীর আইনজীবীর ফিরদৌস শামিমের বক্তব্য, “যেখানে ইডি স্পষ্ট করেই প্রেস রিলিজে উল্লেখ করেছেন নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র যে কোম্পানির সিওও ছিলেন, সেই কোম্পানিরই ডিরেক্টর ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা সেটাই আদালতের সামনে তুলে ধরি। এই কোম্পানিগুলির মাধ্যমেই দুর্নীতির টাকা লেনদেন হয়েছে।”

প্রসঙ্গত, এদিনের শুনানিতে উঠে আসে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের হিসাবরক্ষক চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ। তাঁর অভিযোগ ছিল, ইডি-র তল্লাশির পর সংস্থার কম্পিউটারে ১৬টি অচেনা ফাইল ডাউনলোড হয়েছে। সে প্রসঙ্গে ইডি-র আইনজীবী বলেন, “সন্দেহভাজনের কম্পিউটারে মেয়ের জন্য হস্টেলের খোঁজ করছিলেন। অচেনা ১৬টি ফাইলের একটিতে অফিসারের ওই তথ্য থাকলেও, সেটা অনিচ্ছাকৃত।”

উত্তর শুনে বিচারপতি অমৃতা সিনহার বিরক্ত হয়ে বলেন, “এটা তো হবেই। আপনার অফিসারের উদাসীনতার জন্য হয়েছে এটা। এর ফলে মূল তদন্ত মাঝপথে থমকে যাবে। আজকাল সবার মোবাইল আছে। ব্যক্তিগত বিষয় কীভাবে এখানে আসতে পারে? একজন সিনিয়র অফিসার কী এগুলো জানেন না?”


এরপরই বিচারপতির প্রশ্ন, “কত জন কাজ করছেন? তাঁরা যদি অন্য তদন্তে যুক্ত থাকেন, তাহলে অন্য অফিসার নিযুক্ত করব।”

বিচারপতি সিবিআই-এর আইনজীবীকে আরও বলেন, “যেভাবে তদন্ত এগোচ্ছে সবাই সন্দেহ করছে। আদৌ কবে চাকরি পাবেন বঞ্চিতরা? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জুলাই ২০২১ থেকে শুরু আজও চলছে।”

বিচারপতি অমৃতা সিনহার প্রশ্ন, “যে সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, তাঁর বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করেছেন? আদালতে মামলা রয়েছে আর আপনি বলছেন সমন দেওয়া হবে?”  ইডির আইনজীবী জানান, তাঁকে সমন দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ তিনি আরও একটি মামলা আদালতে করে রেখেছেন। তাঁকে আবার সমন পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ইডি-র আইনজীবী।

উল্লেখ্য, অভিষেকের নামে এই সংক্রান্ত একটি মামলা অন্য এজলাসে বিচারাধীন। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত কুন্তল ঘোষ দাবি করেছিলেন, অভিষেকের নাম বলতে তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। সেই মামলায় বিচারপতি অমৃতা সিনহা ইডি-কে আগেই এফআইআর করে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ইডি এফআইআরও করে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই-এর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল অভিষেককে। ইডিও তাঁকে তলব করেছিল। রক্ষাকবচের আবেদন জানিয়ে বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের বেঞ্চে যায় রাজ্য। সেই মামলা বিচারাধীন।

উল্লেখ্য তিনি হাজিরা দেন। তার মধ্যেই এই সংক্রান্ত আরও একটি মামলায় অভিষেকের বিরুদ্ধে সমন জারি করা যেতে পারে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।

মামলাকারীর আইনজীবীর বক্তব্য, “এই দুটো বিষয় আলাদা। কারণ ইডি প্রেস রিলিজে নির্দিষ্টভাবে একটি কোম্পানির কথা বলা হয়েছে। সেই কোম্পানির ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই কোম্পানিতে অভিষেকের কী ভূমিকা ছিল,সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো একেবারেই পৃথক বিষয়।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here