দেশের সময়: এই তল্লাটে পা রাখলেই আপনি টের পাবেন দেশভাগের যন্ত্রণা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ওপার বাংলা থেকে শরণার্থী হিসেবে সবথেকে বেশি মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বনগাঁয়। যে ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা সড়ক। একাত্তরে এই যশোর রোডের আশপাশের সেই চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর, গোবরডাঙা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা আর অশোকনগরে বাংলাদেশিদের ঠাঁই হয়েছিল সড়কের কোণে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরে।

মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে একাত্তর সালে লিখেছিলেন ১৫২ লাইনের মর্মস্পর্শী কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। গিন্সবার্গের ওই কবিতায় সুর দিয়ে সেই গানকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেন বব ডিলান। আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি রাস্তায় অখ্যাত কতগুলি নিরীহ মানুষের যন্ত্রণা পৌঁছে যায় সারা বিশ্বে। এর পিছনে ছিল প্রয়াত সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করের অবদান।

সীমান্ত শহরের বইমেলায় সেসবই যেন আরও একবার তরতাজা হয়ে উঠল স্মৃতিতে। ৩৪ তম উত্তর ২৪ পরগনা জেলা বইমেলার আসর বসেছে বনগাঁয়। শহরের খেলাঘর ময়দানে এনিয়ে জেলা বইমেলা এবার তৃতীয় বছরে। চাঁদের হাটে বনগাঁর বই পার্বণ ঘিরে উৎসাহের যেন অন্ত নেই। 

এখন কচিকাঁচারা মোবাইল গেমে মগ্ন। সুকুমার রায়, লীলা মজুমদারের মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে না। আর তাই শিশু কিশোরদের বইমুখী করতে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন বনগাঁর পুরপ্রধান গোপাল শেঠ। বইমেলার মাঠে পা রাখলেই স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে বই উপহার। সেই বই নেওয়ার জন্য হামলে পড়ছে ভিড়। নতুন বই হাতে পেয়েই তাতে মুখ গুঁজছে খুদেরা। সত্যি এ এক বিরল দৃশ্য। যা দেখে মুগ্ধ লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা। পুরপ্রধান জানালেন, মেলার প্রতিদিন আমরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৫০ হাজার টাকার বই বিলি করেছি। একটাই লক্ষ্য, ছেলেমেয়েদের মোবাইলের আসক্তি থেকে বের করে নিয়ে এসে বইমুখী করা। কারণ, বইয়ের বিকল্প হয় না। 

বিটলস্‌–এর প্রাক্তন সদস্য জর্জ হ্যারিসনের বন্ধু ছিলেন রবিশঙ্কর। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ঘরছাড়া মানুষের দুরবস্থার কথা তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন হ্যারিসনকে। তারপর ১৯৭১–এর পয়লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যারে ওই শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন হ্যারিসন, রবিশঙ্কর, রিংগো স্টার সহ অনেকে। সেখানেই গিন্সবার্গের কবিতাকে নিজের গানে মূর্ত করে তুলেছিলেন ডিলান। ওই অনুষ্ঠানের টাকা ভারতে ঠাঁই নেওয়া শরণার্থীদের উন্নয়নের জন্য ইউনিসেফের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। অতীতে এই বনগাঁ দিয়ে  কলকাতা-খুলনা রেল চলাচল করত। ট্রেনের নাম ছিল বড়িশাল এক্সপ্রেস। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন বনগাঁ শহরে ভারতীয় সেনারা ক্যাম্প করেছিল। বনগাঁ স্টেডিয়ামে কামান এনে রাখা হয়েছিল। সাঁজোয়া গাড়ি যাতায়াত করত শহরের পথ দিয়ে। আর আকাশ পথে গোঁ গোঁ করে উড়ত যুদ্ধবিমান। তা নিয়ে আতঙ্কে ভুগতেন গাঁয়ের মানুষ। উড়োজাহাজ গেলেই সকলে নিচু হয়ে বসে পড়তেন।

সন্ধ্যার পর কোনও বাড়িতে আলো জ্বালানোর নিয়ম ছিল না। দেশভাগের এই যন্ত্রণা নিয়েই এবার উপন্যাস লিখতে চলেছেন জনপ্রিয় লেখিকা দেবারতি মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘ অসুস্থতার পর প্রথম বাইরে বেরিয়েই এসেছিলেন বনগাঁ বইমেলায়। ইছামতীর শহরে পাঠকদের আবেগ দেখে আপ্লুত তিনি। বললেন, প্রাচীন শহর বনগাঁ। এই শহরের মাটিতেই শ্বাস নিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র। এই শহরের বইমেলায় আসতে পেরে আমি গর্বিত। ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে দুই বাংলার সীমান্তের মিলন অনুষ্ঠানে হাজির থাকার। বললেন, ভাষার কোনও দেশ হয় না। সীমানা হয় না। কাঁটাতার দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা যায় না। দেখুন ভিডিও

এখানকার মানুষ আজও গর্ব করে বলেন, বনগাঁ হাইস্কুলে ছাত্র ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় খেলাঘর মাঠের কাছে ছাত্রাবাসে থেকেই তাঁর পড়াশোনা। শহরে মন্মথনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে তিনি সাহিত্যপাঠের আসরে আসতেন। যা খ্যাত ছিল লিচুতলা ক্লাব নামে। ইছামতী নদীর নামে উপন্যাসও লিখেছেন। পথের পাঁচালি উপন্যাসের কিছুটা অংশ তো ইছামতীর পাড়ে বসেই লেখা। ‘নীলদর্পণ’ লিখে গোটা দেশে শোরগোল ফেলে দেওয়া দীনবন্ধু মিত্রের জন্মও বনগাঁয়। চৌবেড়িয়া গ্রামে। সাহিত্যিক মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর নামেই যিনি বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন, তাঁরও জন্মভিটে এই বনগাঁয়। ঐতিহাসিক এই শহর বরাবরই শিল্পচর্চায় উৎসাহী।

না হলে এই বনগাঁ, ঠাকুরনগর কেন ‘আপন’ হবে ‘ফিরে এসো চাকা’র কবি বিনয় মজুমদারের। কর্মজীবন, হাসপাতালের সময়টুকু বাদ দিলে গোটা জীবন আর স্বেচ্ছানির্বাসন কেটেছে উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর স্টেশন ছোঁয়া শিমুলপুরে। কবি বিনয় মজুমদার মানে, কখনও দিনের পর দিন নির্বাক। কথা বললে, হাস্যরসের আড়ালে এমন গূঢ় মনস্তত্ত্ব। কবিতা লিখলে তা নিয়ে পাঠকের চেয়ে বেশি শোরগোল কবিমহলে। আবার বছরের পর বছর একটি শব্দও না-লেখার কঠিন জেদ। প্রেমিকা গায়ত্রীর মতোই কবিতার প্রতি কখনও তীব্র ভালবাসা, কখনও তীব্র বিদ্বেষে ফুঁসতেন। পুরস্কার, আত্মপ্রচারের ঘোর বিরোধী। নামজাদা কবি-সাহিত্যিকেরা জন্মদিন পালন করতে, পুরস্কার দিতে বাড়ির উঠোনে জড়ো হয়েছেন। দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন কবি। দেখুন ভিডিও

পলেস্তারা খসা বাড়িটার ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে এসে মাথা নেড়ে নেড়ে অবাক হয়ে ইতিউতি চেয়ে থাকত দু’টো চড়াই। আঙুল তুলে দেখিয়ে বলতেন, ‘দেখো, ওদের একটা গায়ত্রীর মতো না! ও কিন্তু পাঁচ ফুট নয় ছিল।’ আজও তাঁর পোঁতা নানা গাছে ফল ধরে। বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধ ম-ম করে। এসবই উঠে এল বইমেলার মাঠে, স্টলে কবি, সাহিত্যিকদের সঙ্গে পা,ঠকের আড্ডায়। বইমেলার অঙ্গন আলোকিত করলেন সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শিশু সাহিত্যিক মনজিৎ গায়েন, কবি সুদীপ্ত মাজি আরও কত কে।

কবি লিখেছেন, হঠাৎই আকাশ কালো করে উথালপাথাল নারকেল গাছ, তালগাছ। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। 

এই বৃষ্টির জলে মুছে যাক বনগাঁর যত ব্যর্থতা…

.সাফল্য ফিরুক মুঠো মুঠো কবিতায়। বই উঠুক প্রতিটি হাতে। বনগাঁর বাসিন্দারা চেঁচিয়ে বলুক, ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,/ রথ হ’য়ে, জয় হ’য়ে, চিরন্তন কাব্য হ’য়ে এসো।/ আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/ সুর হ’য়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।’ এই কামনা নিয়েই পরের বছর বই পার্বণের অপেক্ষা শুরু হবে কাল থেকে। আগামী মঙ্গলবার বইমেলার শেষ দিন। বুধবার মেলার উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। এসেছেন অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা অঙ্কুশ। কিন্তু সবার উপরে পাঠক। কাতারে কাতারে ভিড় জমিয়েছেন তাঁরা। বই কিনেছেন। বই নিয়ে আলোচনা শুনেছেন। অংশ নিয়েছেন। আর গোটা বইমেলাকে রঙিন করে তুলেছে বনগাঁর শিল্পীদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বই বিক্রি নিয়ে দারুণ খুশি প্রকাশকরা। যেসব প্রকাশক এবার স্টল পায়নি, তাদের আবদার আগামীবার তাদের যেন স্টল দেওয়া হয়।

এই বইমেলা হালের নয়, বনগাঁ শহরে আয়োজিত বইমেলা এই বছর ৩৪ তম বর্ষে পা রাখল। আর সেই বইমেলা ঘিরে মানুষের উৎসাহ ছিল দেখার মত।

বুধবার বনগাঁ বইমেলার উদ্বোধন হয়। সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, সাহিত্যিক নলিনী বেরা, সঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, জেলা শাসক শরদকুমার দ্বিবেদী, পুলিশ সুপার জয়ীতা বসু‌ সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, বনগাঁর পুরপ্রধান গোপাল শেঠ, মহকুমা শাসক প্রেমবিভাস কাঁসারী, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বীনা মণ্ডল, হাবড়ার পুরপ্রধান নারায়ণচন্দ্র সাহা, প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর সহ জেলার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here