দেশের সময়: এখনই লোকসভা ভোট হলে কতটা তৈরি দলের বঙ্গ ব্রিগেড? কার্যত সেটাই যাচাই করতে ২৯ নভেম্বর কলকাতায় সমাবেশে যোগ দিতে আসছেন অমিত শাহ। মূলত কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ‘বঞ্চিত’-দের সামনে রেখেই ওই সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে।

তবে বিজেপি সূত্রের খবর, শাহ আসলে বুঝে নিতে চাইছেন লোকসভায় নামার আগে দলের বঙ্গ ব্রিগেড আদৌও কতটা তৈরি। কারণ, ২০১৪ কিংবা ২০১৯-এর হাওয়া এখন আর নেই। ফলে এবার লোকসভা ভোট যে অনেকটাই সংগঠনের জোরে করতে হবে, ইতিমধ্যেই তা বুঝে গিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব।

আর এখানেই হোঁচট খেতে হচ্ছে তাদের। কারণ, কমিটির রদবদল ঘিরে জেলায় জেলায় রয়েছে বিস্তর ক্ষোভ। ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, ঠিক লোকসভা ভোটের মুখে একটা জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেওয়া হয়েছে দেশবাসীর মনে।

কোনও পুলওয়ামা, কোনও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এবার এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে উদ্বোধন হতে চলেছে অযোধ্যায় রাম মন্দির। ওই মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।

গোটা দেশ থেকে মানুষদের আনার চেষ্টা চলছে। ফলে অনেকেই মনে করছেন, এবার লোকসভা ভোটের আগে রামমন্দির ইস্যুকে সামনে রেখে সুকৌশলে হিন্দুদের মনে ধর্মীয় আবেগ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, গুজরাত কিংবা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে ধর্ম বিষয়টি যতটা প্রভাব ফেলতে পারে, বাংলায় তা মোটেই পড়বে না।

কারণ, এরাজ্যের মানুষ কোনওদিনই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পছন্দ করেন না বরাবরই। বরং এখানে সমস্ত সম্প্রদায় হাতে হাত ধরে থাকতেই ভালোবাসে। সেক্ষেত্রে রামমন্দির ইস্যু যদি বাংলায় প্রভাব ফেলতে না পারে, সেক্ষেত্রে সংগঠনের জোরে ভোটে লড়তে হবে গেরুয়া শিবিরকে। আর এখানেই কয়েক কদম নয়, অনেকটাই পিছিয়ে বিজেপি।

সবচেয়ে বড় বিষয়, এরাজ্যে বিজেপির আসল শক্তি যে উত্তরবঙ্গ, সেখানেও বিজেপি গোষ্ঠী কোন্দলে জর্জরিত। তারউপর বহু জায়গাতেই সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বিজেপি সাংসদদের গত পাঁচ বছরে এলাকাতেই দেখা যায়নি। তাঁরা কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্প আনতে পারেননি। এসব নিয়ে অবশ্য বিজেপি সাংসদরা জেলা ও রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার সাফাই দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ তা মানতে নারাজ।

বহু জায়গায় বিজেপির অন্দরেই এবার প্রার্থী বদলের দাবিও উঠতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখে দিয়েছে বলে তৃণমূল যেভাবে প্রচার শুরু করেছে, তা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে পদ্ম শিবিরের উপর। আর তাই কেন্দ্রীয় আবাস যোজনায় যাঁরা ঘর পাননি তাঁদের জড়ো করে সমাবেশে হাজির করতে চাইছেন রাজ্যের বিজেপি নেতারা। পাশাপাশি আবাস যোজনা প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

আড়ালে হলেও বিজেপি নেতাদের একাংশ এটা মানছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটব্যাঙ্কের অন্যতম ভিত্তি বাংলার গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে মহিলারা। তারপর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প সেই ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতে সাহায্য করেছে অনেকটাই। পাশাপাশি কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের সুবিধা তৃণমূলকে শক্তিশালী করেছে গ্রামেগঞ্জে। এরইমধ্যে ১০০ দিনের কাজ বাংলার গ্রামে একটা কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই কাজ এখন বন্ধ থাকায় গ্রামের বহু মানুষকে পেটের টানে ভিন রাজ্যে কাজে যেতে হচ্ছে। 

তৃণমূল মানুষকে বোঝাতে পেরেছে, কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রেখেছে। সেকারণেই এই পরিস্থিতি। এই ইস্যুকে সামনে রেখেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে আন্দোলন করেছেন। ডিসেম্বরের শুরুতেই আবার এই ইস্যুকে সামনে রেখে জেলায় জেলায় কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রেখেই যে এবার পঞ্চায়েতে ফল খারাপ হয়েছে, মানছেন বিজেপি নেতাদের অনেকে। 

আর সেকারণেই বিজেপি নেতৃত্ব চাইছে, কেন্দ্রীয় আবাস যোজনা থেকে বহু মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঘর পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যাঁর প্রকৃতই ঘর পাওয়ার কথা, তিনি বঞ্চিত থেকে গিয়েছেন। অনেক জায়গায় আবার ঘর হয়নি, অথচ ঘরের নাম করে তুলে নেওয়া হয়েছে টাকা। 

এমন বঞ্চিতদেরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর সভায় হাজির করানোর মরিয়া  চেষ্টা চলছে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর গীতা জয়ন্তীতে বঙ্গে আসার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা না হতেই যে মোদি-শাহরা বাংলা থেকে আসন তুলতে ওয়ার্মআপ শুরু করে দিয়েছেন তা স্পষ্ট। বিজেপি সূত্রে খবর, বাংলায় ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৩৫টি দখল করার টার্গেট দেওয়া হয়েছে এবার। যদিও এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে গেরুয়া শিবির যে ৬-৭টির বেশি আসন পাবে না, তা নিজেরাও জানে। আর তাই শাহর সমাবেশকে সামনে রেখে ঝিমিয়ে পড়া বঙ্গ ব্রিগেডকে চাঙ্গা করাই মূল লক্ষ্য বিজেপির।

উত্তরবঙ্গে চা বলয়ে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক অনেকটাই ধসে গিয়েছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে চা বাগান অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মোটেই ভালো হয়নি পদ্ম পার্টির। দক্ষিণবঙ্গে বিশেষ করে নদীয়া ও দুই ২৪ পরগনায় মতুয়া ভোটও এখন যে পুরোপুরি বিজেপির দিকে নেই, সেটা বিলক্ষণ জানেন দলের নেতারা। তবে তৃণমূলেরও চিন্তা রয়েছে, কারণ উত্তর ২৪ পরগনায় বিশেষ করে ঠাকুরনগরে মতুয়া ভোটকে তৃণমূলের ঝুলিতে আনতে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিলেন যিনি, সেই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখন জেলে।

ফলে তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর এই কাজ এবার কেমন করতে পারেন, তার উপরও নির্ভর করছে অনেক হিসেব নিকেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here