ভূমিকম্প হোক বা বন্যা, হাজার বছরও কোনও বিপর্যয় টলাতে পারবে না রাম মন্দিরকে!

দেশের সময় : রাত পোহালেই ২২ জানুয়ারি উদ্বোধন হতে চলেছে অযোধ্যার রাম মন্দিরের ।

এই মন্দিরের পিছনে যেমন অনেক ইতিহাস রয়েছে, তেমনই নতুন যে রাম মন্দির তৈরি হয়েছে, তাতেও স্থাপত্যকীর্তির নানা প্রমাণ রয়েছে। অযোধ্যায় যে রাম মন্দির তৈরি হয়েছে, তা আগামী হাজার বছরেও কোনও ভাবে ক্ষতি হবে না। ভূমিকম্প থেকে বন্যা- কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই এক চুল নড়াতে পারবে না রাম মন্দিরকে।

অযোধ্যায় যে রাম মন্দির তৈরি করা হয়েছে, তাতে লোহা, ইস্পাত বা সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। শুধুমাত্র পাথর দিয়ে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছে। সিমেন্টের বাঁধুনি ছাড়া কীভাবে তৈরি হল রাম মন্দির?

জানা গিয়েছে, প্রাচীনকালে যেভাবে একের পর এক পাথর সাজিয়ে মন্দির তৈরি করা হত, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই রাম মন্দিরও তৈরি করা হয়েছে। একে নাগারা শৈল্প রীতি বলে। খাজুরাহো মন্দির, সোমনাথ মন্দির ও কোনার্কের মন্দির এইভাবেই তৈরি হয়েছে এবং তা এখনও অক্ষত রয়েছে।

রামমন্দিরের ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশনের দায়িত্বে ছিলেন সতীশ সহস্রবুদ্ধে। তাঁর কথায়, নদীর উপর সেতু তৈরির জন্য যে পিলার তৈরি করা হয়, সেইভাবেই রাম মন্দিরের পিলার তৈরি হয়েছে। বৃষ্টির জলেও মন্দিরের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়,  তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

আইআইটি কানপুরের প্রাক্তনী সহস্রবুদ্ধে জানান, মূলত তিনটি কারণে আগামী হাজার বছর রাম মন্দিরের কোনও ক্ষতি হবে না।  প্রথমত, লোহা নয়, শুধু ধাপে ধাপে লোহার পাথর ব্যবহার করে, দক্ষিণ ভারতের মন্দিরশৈলি অনুযায়ী রাম মন্দির নির্মাণ হয়েছে। তাই আগামী এক হাজার বছরেও মন্দিরের গঠনে বিশেষ কোনও বদল হবে না। শুধু মন্দিরের ভিত তৈরি করতেই ১৭ হাজার গ্রানাইট পাথর লেগেছে। গোটা মন্দির তৈরিতে লাগছে দেড় লক্ষ পাথর। পাথরের ওজন ২ হাজার ৮০০ কিলো।

দ্বিতীয়ত, সরযূ নদীর জল যাতে মাটির তলা দিয়ে মন্দিরের কাঠামোর ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য ১২ মিটারের গ্রানাইটের দেওয়াল বসানো রয়েছে। এই পাথর ভূমিকম্প নিরোধকও। ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, ভূমিকম্প বা কোনও প্রাকৃতিক দূর্যোগই মন্দিরের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। অসম্ভব শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে রাম মন্দির।

তৃতীয়ত, শুধু ভূমিকম্প নয়, বাজ পড়েও মন্দিরের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ রাম মন্দিরে থাকছে ২ লক্ষ অ্যাম্পিফায়ার বর্জ্র নিরোধক ব্যবস্থা। বড় বর্জ্রপাত হলেও মন্দিরের পাথরে কোনও চিড় ধরবে না।

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই নাগারা আদল দিয়ে তৈরি মন্দির রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ওড়িশা, অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশে এই স্থাপত্য শৈলীর চল রয়েছে। নাগারা শৈলীর অন্যতম আকর্ষণ শিখর বা শৃঙ্গ। দেখে নেওয়া যাক এই নাগারা স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য গুলি।

১) শিখর
মন্দিরের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারকে বলা হয় শিখর। নাগারা স্থাপত্য শৈলীতে এটি সাধারণত পিরামিড আকৃতির হয়ে থাকে। এর উপরের অংশকে কলশা বলে চিহ্নিত করা হয়।

২) পরিকল্পনা
নাগারা স্থাপত্য শিল্পতে মন্দিরগুলি মূলত বর্গাকার বা আয়তকার আকৃতিতে নির্মাণ করা হয়। এর ঠিক মাঝখানে থাকে শিখর অংশ। যে সব মন্দিরে একাধিক ছোট ছোট টাওয়ার থাকে তাকে মুখমণ্ডপ বলা হয়। এগুলিকে ঘিরে থাকে শিখর।

৩) গর্ভগৃহ
নাগারা স্থাপত্য শিল্পের নির্মিত মন্দির গুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মন্দিরের গর্ভগৃহ অংশ। গর্ভগৃহ মন্দিরের ভিতরের সেই স্থান যেখানে সেই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা বিরাজ করেন। এটি মূলত একটি ছোট ও অন্ধকার কক্ষ। এখানে প্রবেশ করার অধিকার দেওয়া হয় একমাত্র পুরোহিত দের।

৪) প্রদক্ষিণপথ
নাগারা স্থাপত্য শৈলীতে গর্ভগৃহের চারপাশে থাকে একটি প্রদক্ষিণ পথ। এই পথে ভক্তদের প্রবেশ অধিকার দেওয়া হয়। এই পথটি ভক্তদের ভক্তি প্রকাশের জন্য দেবতার চারপাশে ঘড়ির কাঁটার মতো প্রদক্ষিণ করার অনুমতি দেওয়া হয়।

৫) মণ্ডপ
মন্ডপ হলো মন্দিরের মূল হল। এই স্থানেই দেবতার পুজোর জন্য ভক্তরা এসে উপস্থিত হন।
বিভিন্ন রাজ্য ভেদে নাগারা স্থাপত্য শৈলীতে কিছুটা ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন রাজস্থানে নির্মিত নাগারা স্থাপত্যে রাজপুত ঘরানাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই স্থানের মন্দির গুলিতে দুর্ভেদ্য দেওয়াল ও অলঙ্কৃত প্রবেশপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর নিদর্শন দেখা য়ায় মাউন্ট আবুর দিলওয়ারা মন্দির ও রনকপুরের সূর্য মন্দিরে। অন্যদিকে আবার ওড়িশার ভুবনেশ্বর, পুরী ও কোনারকের মন্দিরেও এই শৈলীর কারুকার্য করা হয়েছে। মধ্য ভারতের খাজুরাহো থেকে দক্ষিণ ভারতের বিরুপাক্ষ মন্দির প্রতিটিই বহন করছে এই নাগারা শিল্পকৌশলের শৈলী গুলি।

এই নাগারা শিল্পকৌশলে তৈরি করা অযোধ্যার রাম মন্দির ঠিক কেমন হতে চলেছে তা সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডেলের মাধ্যমে জানিয়েছে শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র।

দেখে নেওয়া যাক ঠিক কি কি বৈশিষ্ট্য থাকছে দেশের বৃহত্তম মন্দিরে গুলির তালিকায় স্থান পাওয়া এই মন্দিরের নির্মাণ কৌশলে।

অযোধ্যার রাম মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে তিন তল বিশিষ্ট। এর প্রত্যেকটি তলের উচ্চতা ২০ ফুট করে। এই মন্দিরে মোট ৩৯২ টি থাম ও ৪৪টি গেট থাকবে।

বিশ্বের সেরা বৃহত্তম মন্দির গুলির তালিকায় স্থান করে নেওয়া অযোধ্যার রাম মন্দিরটির পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট ও প্রস্থ ২৫০ ফুট। এই মন্দিরের উচ্চতা ১৬১ ফুট। মন্দিরের চারদিকে থাকছে আয়তকার দেওয়াল l চার দিকে বিস্তৃত এই দেওয়াল এর দৈর্ঘ্য হবে ৭৩২ মিটার ও প্রস্থ ১৪ ফুট।

মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে রাম দরবারে থাকবে ভগবান শ্রীরামের শিশু রূপ।

মোট ৩২টি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এবং সিংহদ্বার পাড় করে পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করতে হবে মূল মন্দিরের কক্ষে।
এই মন্দিরে মোট ৫টি পটমণ্ডপ বা প্যাভিলিয়ন থাকবে। সেগুলির নাম রাখা হয়েছে Dance Pavilion, Color Pavilion, Sabha Pavilion, Prayer Pavilion ও Kirtan Pavilion। সেই সঙ্গে মন্দিরের প্রতিটি স্তম্ভ ও দেওয়াল গুলিতে খোদাই করা হচ্ছে বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতিকৃতি।

অযোধ্যা রাম মন্দিরে কোনো লোহা ব্যবহার করা হবে না এবং এর মাটিতে কংক্রিট থাকবে না। তবে মন্দিরের নীচে থাকবে ১৪ মিটার পুরু রোলার কম্প্যাক্টেড কংক্রিট। এটিকে কৃত্রিম পাথরের রূপে তৈরি করা হয়েছে।

ভূমি ক্ষয় থেকে এই মন্দিরকে রক্ষা করতে ২১ ফুট উঁচু গ্রানাইট দ্বারা নির্মিত স্তম্ভ মূল প্রস্তুত করা হয়েছে।
মন্দির চত্বরে আরো কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। সেই মন্দিরগুলি মহর্ষি বাল্মিকী, মহর্ষি বশিষ্ঠ, মহর্ষি বিশ্বমিত্র, মহর্ষি অগস্ত্য, নীশাদ্রাজ, মাতা সবরী ও ঋষিপত্নী দেবী অহল্যার নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া এই রাম মন্দির প্রাঙ্গণে আছে বহু প্রাচীন ও পৌরাণিক সীতাকূপ। আর আছে জটায়ু মন্দির।
তীর্থযাত্রী দের সুবিধার জন্য এই মন্দির প্রাঙ্গণে মেডিক্যাল সুবিধা প্রদান করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here