দেশের সময়:১১টা বেজে ৫০ মিনিট। শনিবার আরও এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হল সারা দেশবাসী। সূর্যের দিকে পাড়ি দিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর মহাকাশযান আদিত্য-এল১।

ভারতীয় রকেট ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (পিএসএলভি)-এর কাঁধে ভর করে ১১টা ৫০ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ন স্পেস রিসার্চ সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে সূর্যের উদ্দেশে রওনা দিল এই মহাকাশযান।

আদিত্য-এল১ উৎক্ষেপণের মুহূর্ত। ছবি সৌজন্যে: ইসরো।

আদিত্য-এল১-এর উৎক্ষেপণ নিয়ে সারা দেশে খুশির আবহাওয়া। বিভিন্ন জায়গা থেকে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে আদিত্য-এল১-এর উৎক্ষেপণের মুহূর্ত দেখতে পাওয়া গিয়েছে। গত ২৩ অগস্ট চাঁদের বুকে পা দিয়েছিলে ইসরোর তৃতীয় চন্দ্রযান। রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে তৃতীয় চন্দ্রযানের ল্যান্ডার বিক্রম। আর তার ১০ দিনের মধ্যেই এ বার সূর্যের দিকে সফল ভাবে উড়ে গেল ইসরোর সৌরযান আদিত্য-এল১।

চাঁদের দক্ষিণ মেরু ছুঁয়ে ইতিহাস গড়েছে ভারত। এবার লক্ষ্য সূর্যের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এই লক্ষ্যকে পাখির চোখ করেই রওনা দিল আদিত্য-এল ওয়ান। যার নেপথ্যে রয়েছেন একঝাঁক বঙ্গসন্তান। চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল দেড় দশক আগে।

এই প্রথম সূর্য অভিযানে ভারত। ইসরো কার্যত আদিত্য-এল ওয়ানের উপর বাজি ধরেছে। ২০০৮ সালে প্রথম আদিত্য নামে একটি মহাকাশ যান তৈরির কথা ভেবেছিল পরাদর্শ কমিটি। গোড়ায় ওই কমিটি মনে করেছিল, সূর্যের বাইরের স্তরের (করোনা) পর্যবেক্ষণে করোনাগ্রাফযুক্ত একটি ছোটখাট উপগ্রহ কাজে লাগানো হবে। যার ওজন হবে ৪০০ কেজি। এই পরিকল্পনা রূপায়ণে ২০১৬-১৭ সালে বরাদ্দ করা হয় ৩ কোটি।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুধুমাত্র এর উৎক্ষেপণের ব্যয়ভার দাঁড়ায় ৩৭৮ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। ইসরো জানিয়েছে, আদিত্য এল ওয়ান পৃথিবী থেকে সাড়ে দশ লক্ষ কিমি দূরে পাঠানো হবে। এই অংশকে বলা হচ্ছে ল্যাগরেজ পয়েন্ট। যেখানে সূর্য ও পৃথিবীর আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ বল একইসঙ্গে ক্রিয়াশীল। ফলে ওই অঞ্চলে স্থির থাকতে পারবে কৃত্রিম উপগ্রহ। মহাকাশের পরিবেশ, আবহাওয়া এবং তার উপর সূর্যের কী প্রভাব পড়ে, তা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করবে আদিত্য এল ওয়ান।

ফলে সূর্য সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য জানা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। আদিত্য এল ওয়ান উৎক্ষেপণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পিএসএলভি সি-৫৭ রকেট। এই অভিযানের সাতটি বিশেষ পেলোড থাকছে। সূর্যের ফোটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার, করোনার পর্যবেক্ষণে যাকে তৈরি করা হয়েছে বিশেষভাবে। উৎক্ষেপণের পর সূর্যের অভিমুখে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পর পাক খেতে শুরু করবে ছোট কক্ষপথে। সেখান থেকে সে সৌরমণ্ডল সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ শুরু করবে।

যাত্রাপথ নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর রাখা হবে বিশ্বের পাঁচটি প্রান্ত থেকে। শ্রীহরিকোটা, আন্দামান ছাড়াও ব্রুনেই, ফিজি এবং আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস থেকে ওই কাজ করবেন বিশেষজ্ঞরা। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে রয়েছেন নদীয়ার বরুণ বিশ্বাস। হরিণঘাটার দিব্যেন্দু নন্দীও চলে গিয়েছেন ইসরোয়।

আদিত্যর সাতটি প্রধান যন্ত্রের অন্যতম সোলার আল্ট্রা ভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপের নজরদারির দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।

চন্দ্রযান-৩ এর সফল অভিযানে যুক্ত ছিলেন সিউড়ির রায়পুরের সৌম্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও মল্লারপুরের বিজয় দাই। আদিত্যর উৎক্ষেপণেও যুক্ত রয়েছেন তাঁরা। সূর্য মিশনে শামিল কোচবিহারের পিনাকীরঞ্জন সরকার। জানিয়েছেন, তিনি যে টিমে রয়েছেন, তার কাজ সৌরযানকে তার কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। তাঁরা সফল হবেন বলে আশা।

পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বাসিন্দা কৌশিক মণ্ডলও রয়েছেন আদিত্য এল মিশনে। যে রকেটে সৌরযান সূর্যের দিকে যাবে, তার গোটা যাত্রাপথে নজর রাখার দায়িত্ব তাঁদের। টিমে রয়েছেন রানিগঞ্জের সানি মিত্র। তিনি আদিত্যের বিকাশ ইঞ্জিন দেখভালের টিমের মেম্বার। দেড় বছর ধরে এর কাজ চলছিল বলে জানিয়েছেন। বললেন, যতক্ষণ না সফল হচ্ছি, ঘুম আসবে না।

আদিত্য-এল১ ভারত থেকে সূর্যের দিকে পাঠানো প্রথম মহাকাশযান। সূর্যের অপর নাম আদিত্য। তাই এই নামকরণ করা হয়েছে মহাকাশযানটির। ইসরো জানিয়েছে, মহাকাশযানটিকে সূর্য-পৃথিবীর মধ্যে একটি ‘হ্যালো’ কক্ষপথের ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট বা এল১ পয়েন্টে স্থাপন করা হবে। প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার ভ্রমণ করে গন্তব্যে পৌঁছবে মহাকাশযানটি। সময় লাগবে প্রায় ১২০ দিন। সূর্যের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে আদিত্য-এল১-কে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে।

ইসরো সূত্রে খবর, উৎক্ষেপণের পর প্রায় ১৬ দিন পৃথিবীর চারিদিকে পাক খাবে আদিত্য-এল১। এই ১৬ দিনে সূর্যের দিকে পাড়ি দেওয়ার জন্য পাঁচটি ধাপে গতিবেগ বাড়াবে আদিত্য। এর পর ১১০ দিন সূর্যের অভিমুখে যাত্রা করে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে নক্ষত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করবে সেটি। এই ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টে সূর্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ বল একসঙ্গে ক্রিয়াশীল। ফলে এই অঞ্চলে পৌঁছে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থির থাকতে পারে। মহাকাশের পরিবেশ, আবহাওয়া, তার উপর সূর্যের কী প্রভাব পড়ে, সে সব জানার চেষ্টা করবে আদিত্য-এল১।

আদিত্য-এল১ যানটিতে মোট সাতটি পেলোড রয়েছে। এগুলি সূর্যের বিভিন্ন স্তর খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ফোটোস্ফিয়ার থেকে ক্রোমোস্ফিয়ার কিংবা সূর্যের একেবারে বাইরের দিকের স্তর কোরোনা, পর্যবেক্ষণ করবে এই পেলোডগুলি। এ ছাড়া, সূর্যের উত্তাপ, সৌরপদার্থের নিঃসরণ, সৌরঝড়ের মতো সূর্যকেন্দ্রিক বিষয়গুলি বুঝতেও বিজ্ঞানীদের সাহায্য করবে। ভিসিবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফি (ভিইএলসি) এবং সোলার আল্ট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ (এসএউআইটি) নামে দু’টি মূল পে লোড রয়েছে। ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট পৌঁছানোর পরে এই ভিইএলসি পেলোড প্রতি দিন ১,৪৪০টি ছবি তুলে পাঠাবে। তাই এই পেলোডটিকেই আদিত্য-এল১-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেলোড বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্য পেলোডগুলি হল— সোলার লো এনার্জি এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার (এসওএলইএক্সএস), হাই এনার্জি এল১ অরবিটিং এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার (এইচইএল১ওএস), আদিত্য সোলার উইন্ড পার্টিকল এক্সপেরিমেন্ট (এসপিইএক্স) এবং প্লাজ়মা অ্যানালাইজ়ার প্যাকেজ ফর আদিত্য (পিএপিএ)। উল্লেখ্য, তৃতীয় চন্দ্রযানের চারটি পেলোড রয়েছে।

আদিত্য-এল১ অভিযানের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৩৭৮.৫৩ কোটি টাকা। এই অভিযান সফল হলে সৌরঝড়ের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে ইসরো। পাশাপাশি সূর্যের আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবও বুঝতে সাহায্য করবে এই মহাকাশযান। এই অভিযানের মাধ্যমে সূর্য সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য ভারতের হাতে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here