সোনম ওয়াংচুক:

‘পৃথিবীর ছাদ’ হিসেবে বর্ণিত ভারতে হিমালয়ের উত্তরভাগে যে বিশাল ভৌগোলিক ক্ষেত্রটি রয়েছে, অসংখ্য হিমবাহ নির্গত বিশুদ্ধ জল, এশিয়ার অধিকাংশ বড় নদীর প্রাথমিক উৎসগুলি এই অঞ্চলেই রয়েছে। ফলে মানবসভ্যতার আদি সময় থেকেই এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল। আধুনিক যুগেও এই হিমবাহগুলি এই অঞ্চলের প্রধান নদীগুলির প্রধান জলের উৎস। এই জলের স্রোত ১০ কোটিরও বেশি এশিয়াবাসীর জীবন, বিশেষ করে, লাদাখের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য, যাঁরা শীতল ঊষর ভূমিতে থাকেন, তাঁদের জন্য উঁচু পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহ থেকে নির্গত জল সর্বদাই জীবনের উৎস এবং তাঁদের সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে।

হিমালয়ের উত্তরে বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে অবস্থিত লাদাখের বিশিষ্ট ভৌগোলিক এবং জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সুবিদিত। একটি শীতল মরুভূমি রূপে বিখ্যাত লাদাখ ৯৬,৭০১ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এবং ৩ হাজার মিটার গড় উচ্চতায় অবস্থিত। লাদাখের বার্ষিক তুষারপাত ১০০ মিলিমিটার এবং গড় ন্যূনতম তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তুষারাবৃত থাকে। বছরের শুধু এক-তৃতীয়াংশ সময়ই এই অঞ্চল কৃষিকাজের উপযোগী থাকে। এই অঞ্চলের গ্রামগুলি ঊষর বরফের মরুভূমিতে কোন একটি জলধারার পাশে কিংবা গ্রীষ্মকালে বরফ গলে আসা জলধারা বা ঝর্ণার পাশে ছোট ছোট এলাকায় অবস্থিত। এহেন পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক পটভূমি থাকা সত্ত্বেও মানুষের অবহেলা ও লোভের কারণে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে, উঁচু  ওই এলাকাগুলিতে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা অন্যান্য অঞ্চলের মতো লাদাখকেও প্রভাবিত করেছে।

বর্তমানে হিমালয়ের হিমাবাহগুলির উচ্চতা  প্রতি বছর কয়েক মিটার থেকে শুরু করে ১০ মিটারেরও বেশি হারে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এখন তুষারপাতও কমে যাচ্ছে। গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং হিমবাহের আকার  ক্রমশ ছোট হওয়ার ফলে গ্রামগুলিতে জলাভাব দেখা দিচ্ছে। হিমালয়ের কিছু পাহাড়ি গ্রাম এখন ধীরে ধীরে খালি হয়ে যাচ্ছে। কিছু বাসস্থানযোগ্য বাড়ি এবং পরিত্যক্ত কৃষিজমি গ্রামগুলিকে ভুতুড়ে গ্রামে পরিবর্তিত করে তুলেছে। জলাভাব, বাড়িগুলির ভেতর উষ্ণতার অভাব এবং মূল কৃষি-নির্ভর অর্থ ব্যবস্থার দূরাবস্থার মতো তিনটি প্রধান কারণেই লাদাখের যুব সম্প্রদায় গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যেতে শুরু করেছে।

এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয়  সরকারের জনজাতি বিষয়ক মন্ত্রক (এমওটিএ) লাদাখের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভস (এইচআইএএল)-এর সহযোগিতায় ২০১৯-এর নভেম্বরে লাদাখের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির অনুসন্ধান, নথিভুক্তিকরণ এবং উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলির  অন্যতম হল ‘বরফের স্তুপ-এর মাধ্যমে পরিত্যক্ত গ্রামগুলির পুনর্বাসন’। স্থানীয় জনগণ, এই অঞ্চল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও সংগঠন, অসরকারি সংগঠন এবং সরকারের মধ্যে সহযোগিতার মেলবন্ধনে এটি একটি আদর্শ প্রকল্প হয়ে উঠেছে।

এই পরিকল্পনা এবং ‘বরফের স্তুপ’-এর প্রথম নমুনা হিসেবে ২০১৩-র শীতকালে এসইসিএমওএল স্কুলে গড়ে তোলা হয়েছে। পরম্পরাগত প্রথা এবং কৃত্রিম হিমবাহ সম্পর্কে শ্রী চেবাংগ নোর্ফেল-এর সৃষ্টি থেকে প্রেরণা নিয়ে লাদাখের বিভিন্ন স্থানে বরফের স্তুপ গড়ে তোলা হয়েছে। জনজাতি বিষয়ক মন্ত্রক এবং এসইসিএমওএল স্কুলের যৌথ প্রয়াসে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ প্রকল্প এবং শিল্প একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করেছে। ২০১৩-১৪ সালে একটি গ্রামে একটি বরফের স্তুপ ছিল। কিন্তু, তথ্য পরিবেশন, সচেতনতা ও এ ধরনের বরফের স্তুপের নির্মাণশৈলীর উপযুক্ত  প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ২০১৯-২০-তে লাদাখের ২৬টি জায়গায় এ ধরনের বরফের স্তুপ তৈরি করা হয়েছে।

এই প্রকল্প থেকে ব্যক্তিগত এবং সংস্থার উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত সাহায্যের মাধ্যমে বরফের স্তুপ নির্মাণের অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রক্রিয়ায় ভারত ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানের অভূতপূর্ব উন্নতিসাধন করা হয়েছে। ২০১৯-২০-র শীতকালে ২৫০টি গ্রামে সুবিধাভোগীদের প্রশিক্ষিত করে ও লাদাখে বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ শিবির এবং বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বছর শীতকালে অংশগ্রহণকারী গ্রামবাসীরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৫০ লক্ষ লিটার জল সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া, ‘ফার্স্ট লাদাখ আইস ক্লাইম্বিং ফেস্টিভ্যাল’-এর মতো পরিবেশ-পর্যটনের প্রসার স্থানীয় যুবকদের পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগপতি হতে সাহায্য করেছে।

এ বছর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে কুলুম গ্রাম থেকে। এই গ্রামটি লেহ শহরের দক্ষিণ-পূর্বে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুটি ছোট জনবসতি – আপার-কুলুম ও লোয়ার-কুলুম নিয়ে গ্রামটি গড়ে উঠেছে। আপার কুলুমে থাকে সাতটি পরিবার এবং লোয়ার কুলুমে থাকে চারটি পরিবার। গ্রামে হিমবাহ থেকে আসা জলের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় আপার কুলুমের প্রত্যেকেই ২০১২ সালে বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিকটবর্তী উপশি শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা প্রথাগত কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে গিয়ে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। আবার কেউ ঠেলা নিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করেন। ২০১৯-এর নভেম্বর থেকে ২০২০-র ফেব্রুয়ারি – এই চার মাস ধরে এই প্রকল্পের কাজ চলছে। এই কাজ শুরু করার আগে অঞ্চল সমীক্ষা এবং নানা পরিমাপ হিসেব-নিকেশ করে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সেই পরিকল্পনায় ওই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পটি চালু হয়েছে। প্রকল্পটি পরিচালনায় গ্রামবাসীদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়াও কে কি করবে, তাও ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপে যন্ত্রপাতি আনা, পাইপলাইন স্থাপন, বরফের স্তুপ গড়ে তোলার জন্য একটি গোলাকৃতি খাঁচা তৈরি ইত্যাদি কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন কুলুম গ্রামের বাসিন্দারাই, যাঁদেরকে কুলুম্পা বলা হয়। এক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের তৃণমূলস্তরে এই প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা প্রদান করা ছাড়াও, সমস্ত পর্যায়ে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রেরণা যোগানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ববর্তী মাসগুলির পরিশ্রমের ফলে আপার-কুলুম গ্রামের বাসিন্দারা ৪৫ ফুট উঁচু বরফের স্তুপ বানিয়েছে। লাদাখে শীত যখন চরমে তখন পাইপলাইনে জল জমে যাওয়া এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম ভেঙে যাওয়া, পাইপ ফেটে যাওয়া ইত্যাদি কারণে জলের গতি কম হওয়ার মতো বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই নিজেদের মতো করে একটি নতুন সমাধান বের করা সম্ভব হয়েছে। এ বছরের অভিজ্ঞতা আগামী বছরের জন্য একটি সম্পদ হয়ে উঠবে। এবারের শীতের শেষ পর্যন্ত নির্মিত বরফের স্তুপে ৩ লক্ষ লিটার জল সংরক্ষণ সম্ভব হবে। কিন্তু এবার এই বরফের স্তুপ এপ্রিলের শেষেই গলে গেছে। কিন্তু এর মাধ্যমে কুলুমের চাষের খেতে যথেষ্ট পরিমাণ জলসেচ করা সম্ভব হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে কুলুমে জলাভাব সমস্যার সমাধানে সেখানকার অধিবাসীরা যে অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করেছিলেন তা যথেষ্ট সফল হয়েছে।

আগামী বছরগুলিতে এই প্রকল্পে জল ব্যবস্থাপনা কৌশলের পাশাপাশি, এটাকে একটি সমগ্র গ্রাম পুনর্বাসন মডেল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই মডেলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সামিল করা হয়েছে :

➢ কার্বন সিঙ্ক রূপে কাজ করার জন্য এবং বন্যার মতো ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য উপত্যকায় গ্রামের ওপরের দিকে বৃক্ষরোপণ।

➢ আধুনিক বৃক্ষরোপণ এবং সেচ সম্পর্কিত প্রথাগুলি যেমন – ড্রিপ সেচ, হাইড্রোপনিক প্রক্রিয়ার মতো জল কম ব্যবহার করা।

➢ দৈনিক ব্যবহারের জন্য বায়ু, সূর্যালোক, বায়ো-গ্যাস ইত্যাদির মতো বিকল্প শক্তির প্রযুক্তি ব্যবহার।

কুলুমের বরফের স্তুপ এপ্রিল মাস শেষ হওয়ার আগেই গলে গেছে কিন্তু, এর মাধ্যমে কুলুমের খেতগুলিতে জলের প্রয়োজন মিটেছে। এই প্রকল্পে জলাভাবের সমাধানের উদ্দেশ্যে কুলুম্পারা যে অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করেছিলেন তা সফল হয়েছে।

এই স্তুপগুলি পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে এবং ভবিষ্যতে পরিবেশ সংরক্ষণে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। এই বরফের স্তুপগুলি শুধু লাদাখের জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলির জলের অভাবই দূর করবে না, পাশাপাশি গ্রামবাসীদের আত্মনির্ভর করে তুলে তাঁদের পরিবেশ-বান্ধব পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাঁদেরকে পরম্পরাগত পেশা বা কোন নতুন জীবিকা অর্জন করতে সাহায্য করবে।

* লেখক : একজন বিশিষ্ট ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক ও শিক্ষা সংস্কারক এবং এইচআইএএল-এর প্রতিষ্ঠাতা তথা লাদাখে ছাত্রদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি অভিযানের প্রতিষ্ঠাতা-নির্দেশক

এই নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য একান্তভাবে লেখকের নিজস্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here