অশোক মজুমদার

খবরটা ভীষণ আনন্দের। আমি দাদু হলাম, খুব খুশি আমি। ১৬ই সেপ্টেম্বর এই খবরটিই আপনাদের জানাবো বলে কিছুটা উত্তেজনার বশে পোস্ট করেছিলাম। অবশেষে ছয়দিন পর ডাক্তার ভগবানের হাত ধরে সিউড়ি সদর হসপিটাল থেকে সেই বিশেষ সুখবর এলো আজ। এই কদিন খুব চিন্তার মধ্যেই ছিলাম। তবে শেষমেষ সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নাতি হয়েছে আমার। অতিমারির এই সাতমাসে এর চেয়ে ভালো খবর আর কীই বা হতে পারে! মাত্র ছয়মাসের আলাপ। তাও ফোনে। কথা বলতে বলতে কখন যে নিজের হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি। কিন্তু মুশকিল এটাই যে অতিমারীর জন্য এখনই নাতির মুখ দেখতে পারবো না। তাছাড়া বেশ দূর সেই বক্রেশ্বরের কাছে লোকপুর গ্রাম। কথা দিয়েছি একটু স্বাভাবিক হলে অবশ্যই যাবো। আপনারা ভাবছেন নিশ্চয়ই, আমি কি বলছি তার মাথামুন্ডু তো কিছুই বোঝাই যাচ্ছে না। বুঝতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ছয়মাস। ঘোর লকডাউন সেসময়। রাস্তাঘাট সুনসান। এক দুপুরে "এই সময়" পত্রিকার বিশিষ্ট চিত্রসাংবাদিক ভ্রাতৃপ্রতিম জয়ন্ত সাউ ফোন করে আমায় জানালো, "অশোকদা ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডে একটি ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসে আছে। বাস চলাচলের ভুল খবর পেয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। ওদের কাছে সেরকম টাকা পয়সাও নেই। ছবি তোলার পরে নিজে থেকেই আলাপ করে জানলাম, ওদের দেশের বাড়ি বীরভূমের জয়দেব। ওরা ওখানে ফিরতে চায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করো। আমি সামান্য কিছু অর্থ ওদেরকে দিলাম।'' সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তর কাছ থেকে ওদের ফোন নম্বর নিয়ে কথা বলে জানতে পারি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ছেলেটি দেশের বাড়ি ফিরতে চায়। সব শোনার পর তখনই সরাসরি ডিজি বীরেন্দ্র সাহেবকে ঘটনাটা জানাই। কিছুক্ষণের মধ্যে ময়দান থানা থেকে ফোন। জনৈক পুলিশ অফিসার বলেন, "ওদের কলকাতার তারা তলার ভাড়া বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি।" আমি সেই অফিসারকে বলি, "দেখুন, এই মেয়েটি সন্তানসম্ভবা। ওদের হাতে টাকা পয়সাও নেই। ওদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো। এই লকডাউনে ওরা তারাতলায় থাকতেও চাইছে না।" অবশেষে নয়াবস্তি থানায় ওদের নিয়ে যাওয়া হয়। থানাতেই খাওয়া-দাওয়া করে এমনকি হাতে সামান্য অর্থ দিয়ে ওইদিনই বীরভূমের জয়দেব থানায় পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই রাতে থানার হাউস কোয়ার্টারে ওদের আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপরের দিন খয়রাশোলে ওদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওখানে ১৪দিন থাকার পর ওদের গ্রাম লোকপুরে চলে যায়। এতক্ষন যাদের কথা বললাম, সেই ছেলেটির নাম ভজন কর্মকার। বছর বত্রিশ বয়স। স্ত্রী সোমা কর্মকার। বয়স সাতাশ বছর। ওদের পারিবারিক অবস্থা শোনার পর মেয়েটি সন্তানসম্ভবা বলে, সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি ওদের পাশে আছি। আছি বলতে ছাড়তে পারিনি। প্রায়দিন ভজন নয় সোমা, তার এই না দেখা কাকুকে ফোনে রোজদিনের নানা কথা শুনিয়ে কেমন যেন আপন করে নিয়েছে। ভজন ও সোমা দুজনেই আমাকে কাকু বলে। লোকপুর গ্রামে দু'কাঠা জমির উপরে টিন ও ত্রিপলের আচ্ছাদনে ওদের বাড়ি। বাবা পঙ্গু হয়ে বিছানায়। গ্রামে ছোট কামারশালায় ওদের পারিবারিক ব্যবসা।মা নেই। ভজনের একমাত্র বোন সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। বোনের ছেলে শুভম সেই থেকে ভজনের সাথেই থাকে।চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া এই ছেলেকে শুভমের বাবা অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিল। ভজন রাজি হয়নি। শুভম এর বাবা অন্যত্র বিয়ে করে নিজের মত থাকে। অভাবের তাড়নায় ভজন কলকাতাতে কাজ করতে শুরু করে। বিয়েও হয়। তারপর সোমাকে নিয়ে কলকাতার তারাতলার ভাড়াবাড়িতে ওঠে। ভজন লোহার দোকানে কাজ করতো। দু'বছরের বিবাহিত জীবনে ও একদিনের জন্যও সোমাকে নিয়ে কোত্থাও বেড়াতে যায়নি। এমনকি কলকাতার কোনো জায়গাও ওরা ঘোরেনি। সামান্য পয়সায় কোনোরকমে নিজেদের সংসার চালিয়ে বাড়তি টাকা ভজন গ্রামের বাড়িতে পাঠাতো। কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিল ভজনের জীবন যুদ্ধ। কিন্তু বাঁধ সাধলো অতিমারির লকডাউন। দোকান বন্ধ। বাড়ি ভাড়া বাকি। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা। বাড়িওয়ালা আলো জল বন্ধ করে দিল। আর কোনো উপায় না দেখে এক ভোরে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোমাকে নিয়ে ধর্মতলায় চলে আসে ভজন। ধারনা ছিলো কিছু একটা পেয়ে যাবে। পকেটে মাত্র ৯০/- টাকা। তারপরই জয়ন্ত ওদের অসহায় অবস্থায় বসে থাকতে দেখে কথা বলে ও আমাকে জানায়। বর্তমানে কলকাতায় লোহার দোকানের মালিক ভজনকে দিল্লিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে চায়। মাইনেও বেশি। ভজন যায়নি। এই সময় সোমাকে ছাড়া থাকতে চায় না সে। বাবা হবে এই আনন্দে যা জোটে নিজের মত শাক, ভাত খেয়ে বাড়িতেই পড়ে থাকে। যাতে সোমার দেখভাল করতে পারে। কারণ ভজনের বাড়িতে মা বা মা স্থানীয় কেউই ওর পরিবারে নেই, এই অবস্থায় তাই সোমাকে একা রেখে কোথাও যাবার কথা ভাবতে পারছে না। আমি সব শুনে সোমার মা বাবার কাছে সোমাকে রাখার কথা বললে ভজন বললো, ওদের বাড়ির চেয়ে সোমার বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ। একবেলা জুটলে অন্যবেলা ভাবতে হয়। তাই শাশুড়িকে ভজন নিয়ে এসেছে সোমার দেখাশোনার জন্য। অন্তঃসত্ত্বা সোমার খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, আমাদের দেশে প্রদীপের নীচে অন্ধকারের ট্রাডিশন আজও সমান ভাবে চলছে। আমি নিজে এই অন্ধকারের ভেতরে বড়ো হয়েছি বলে বুঝতে পারি এদেশে সত্যিই দারিদ্রতা একটা অভিশাপ। বর্ধমানের লোকো কলোনির গ্রামে একটা হাঁসের ডিম সুতো দিয়ে কেটে( বঁটিতে কাটলে কুসুম নষ্ট হয়) চার টুকরো করে আলু দিয়ে ঝোল করতো আমার মা। আমি, বাবা, পিসি, মেজ ভাই- এই চারজনের জন্য। মা খেত না। কোনোদিন এও দেখেছি বাবার খাওয়ার থালায় ভাঙ্গা ডিমের কুসুম মায়ের জন্য থাকতো। তাই যখন ভজনদের মত কাওকে দেখি জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, হার মানবার লেশমাত্র নেই মনে, তখন ওদের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। আমি জানি আমার হাতে আলাদিনের প্রদীপ নেই। আমারও সামর্থ সীমিত। কিন্তু সাহস আর ভরসার হাতটুকু তো আছে। ওইটুকুই করে যেতে চাই যতদিন বাঁচবো। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ভজনদের খাবারের মেনু যা ও হাসতে হাসতে বলে ফেলল, ভোরে উঠে চা, বেকারি বিস্কুট, বা মুড়ি। তারপর ভাত, আলু সেদ্ধ, সরষের তেল,লঙ্কা। দুপুরে ভাত, শাকভাজা, ডাল,কুমড়োর বা লাউয়ের তরকারি। রাতে রুটি বা ভাত পাঁচমিশালি সবজি তরকারি। পারিবারিক কামারশালায় একটু বিক্রি হলে ভজন ডিম ও দুধ কিনে বাড়ি ফেরে। কখনো চারাপোনা। গত আটমাসে ওরা মাংসের মুখ দেখেনি। এইসব শুনে ফোনে ভজনকে বলতাম, "সোমার তো এখন একটু ভালো খাওয়া-দাওয়ার দরকার। ওসব খেলে হবে? আমি কি তোমায় এই ক'মাস মাসে একটু বেশি টাকা পাঠাবো?" ভজন বলত, "না না কাকু আমরা গরীব মানুষ। এভাবেই বড় হয়েছি। আমার ছেলে মেয়েও ঠিক এভাবেই বড় হবে।" বিগত আমফান ঝড়ে ওদেরও খুব ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে বলে ওদের সমস্যা মেটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে ভজন কোনোদিন কোনো অতিরিক্ত টাকাপয়সা চায়নি আমার কাছে, ওর একটাই লক্ষ্য সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবো। দারিদ্র্যতা ওর এই জেদকে হারাতে পারবে না। আর তাই ভজন এই অভাব অনটনের মধ্যেও বোনের ছেলে শুভমকে স্কুলে পড়িয়ে যাচ্ছে। ভজনরাই পারে। আমাদের মত শহুরে এলিটদের এরকম ভাবনার মন কেন যে কোনোদিন হলোনা কে জানে। আমি জানি কিছু কিছু মানুষ করছে। কিন্তু তার বাইরেও বহু মানুষ যদি সবসময় সরকারের সমালোচনা না করে মানুষের পাশে একটু এগিয়ে আসেন তাহলে ভজনের মত পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি। নিজেদের বিবেকের কাছে এই প্রশ্নটাই কোনোদিন রেখে দেখুন তো আমাদের চারপাশের এই মানুষগুলোর জন্য আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই ? করোনার কারণে সাতমাস কাল যাবৎ ঘরবন্দি হয়ে আমরা নিশ্চয়ই অনুভব করেছি সমাজে একে অপরের পরিপূরক না হতে পারলে আমরা কেউ বাঁচবো না। এই অতিমারী তো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালো কতটা জরুরি সুনাগরিক হয়ে ওঠার। সরকারের দিকে বল ঠেলে দিয়ে, সব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে, শুধুমাত্র অভিযোগ করে দিন কাটালে সমাজ সুন্দর হয়না বলেই আমি মনে করি। সোমাকে ভর্তি করার পরে ভজন ছয়দিন ধরে হাসপাতালেই পড়ে ছিলো। এই ছয়দিনে কম করে বললেও দিনে ও রাতে প্রায় দুশোবার ফোন করে সব খবর দিতো। আমি হাজার কাজের ঝামেলার মধ্যেও ওর মনের অবস্থাটা বুঝে সব কথা শুনে গেছি। সত্যিই তো জীবনে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ যে কি আমাদের জীবনে সবারই হয়েছে। তাই সকাল সকাল ভজনের বাবা হবার আনন্দে নিজের প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দটা আরেকবার অনুভূত হল। চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে ভজনের আনন্দটা নিজের আনন্দের সাথে মিলিয়ে দিলাম। ভাবতে অদ্ভুত লাগছে, আমি আমার সাংবাদিক জীবনে কত মানুষ, কত ঘটনা দেখেছি। কত মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। কিছুজনের সাথে যোগাযোগ আছে আবার কতজন হারিয়েও গেছে। কোনো ঘটনা মনকে আনন্দ দিয়েছে। কোনো ঘটনায় দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু জীবনের এইপ্রান্তে এসে এই অতিমারীর সময়ে এই ভজন আর সোমার মত অপরিচিত, অনাত্মীয়দের সঙ্গে এমন নাড়ির টান অনুভব হবে ভাবিনি। তাই আজ আমারও খুব খুশির দিন। আনন্দের দিন। এরমধ্যে ভজনের আবদার, "কাকু একটা নাম ঠিক করে দিতেই হবে।" কথায় আছে সাঁঝবিহান অর্থাৎ সন্ধ্যাসকাল। সেখান থেকেই নাম দিলাম "বিহান"। অনেকদিনের নানা দুর্যোগ দুর্ভোগের শেষে ভজন আর সোমার এমন সকালের অপেক্ষাতেই দিন কাটছিলো। আমারও। আগামীতেও আরও অনেক ভজন সোমারা এভাবেই আমার সাথে জুড়ে থাক, আর এমন বিহান(সকাল) আমার জীবনে বারবার আসুক।। অশোক মজুমদার।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here