দেশের সময় এর বিশেষ প্রতিবেদন–দিন কয়েক আগে জঙ্গলমোহলে গিয়ে মুখ্যোমন্ত্রী যে ভাবে প্রশাসনিক বৈঠক থেকে একের পর এক নানা সরকারি ঘোষণা করেছেন এবং সেখানে দলের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন তাতে একটা বার্তা পরিষ্কার মুখ্যমন্ত্রী বুঝে গেছেন যে জঙ্গলমোহলে দলিত প্রান্তিক মানুষজনদের মধ্যে একটা সরকার বিরোধী মানসিকতা ক্রমেই ধূমায়িত হতে শুরু করেছে,যাকে ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বিজেপি।মুখ্যমন্ত্রীর এই আশঙ্কা যে একশোভাগ সত্যি তা জঙ্গলমোহলে ঢু মারলে যে কেউ বুঝতে পারবেন।বাম আমলে বিদ্রোহের ধ্বনি শোনা গেছিল প্রথম এই জঙ্গলমোহল থেকেই।জঙ্গলমোহলের অউন্নয়ন,আদিবাসী মানুষজনদের প্রতি দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা এই বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করেই একসময় সেখানে মাওবাদী কার্যকলাপ বে়ড়ে উঠতে থাকে,সরকার বিরোধী মানুষের জেহাদকে কাজে লাগিয়ে মাওবাদীরা গোটা জঙ্গলমোহল জুড়ে একসময় প্রভাব বিস্তার করেছিল।আজকে সিপিএম যে অভিযোগ করে যে তৃণমূল একদিন মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল,তা সম্পূর্ন সত্যি না হলেও এটা ঘটনা যে মাওবাদীদের প্রভাবকে তৃণমূল একসময় ব্যবহার করেছিল।মমতা সেদিন মনে করতেন যে মাওবাদীরা সিপিএম বিরোধী হওয়ায় সেখানকার মানুষজনকে সিপিএমের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে মাওবাদীদের সহযোগিতা নেওয়া যেতেই পারে।মাওবাদীরাও সে সময় মনে করেছিল সিপিএমের রাষ্ট্রীয় শক্তিকে প্রতিহত করতে পরিস্থিতির চাপে মমতার সঙ্গে নরম সম্পর্ক রাখা যেতেই পারে।সেই জন্যই সে সময় মাওবাদী নেতা কৃযাণজী এ রাজ্যে মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।বলাই বাহুল্য এসব কোনটাই কোন দীর্ঘ মেয়াদি রাজনৈতিক সখ্য ছিল না,থাকার কথাও নয়।এমনকী এর কোনটাই খাতায় কলমে স্বীকৃত নয়,শুধু মাত্র মৌখিক একটা কৌশলী অবস্থান মাত্র ছিল।কিন্তু এটা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে সে সময় জঙ্গলমোহলের একটা বড় অংশের মানুষ যারা মাওবাদীদের সঙ্গে চলে গেছিল বঞ্চনা ও অবহেলার কারণে তাদের অনেকেই মমতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সিপিএম বিরোধীতা করতে।সেই কারণেই সিপিএমের সংগঠন একেবারে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল।মমতা সেই সমর্থন নিজের দিকে টেনে একদিকে যেমন মাওবাদীদের সংগঠনকে দুর্বল করে দিয়েছেন,তেমনি জঙ্গলমোহলে নিজের নিয়ন্ত্রন কায়েম রাখতে নানা উন্নয়ন কর্মসূচি ঘোষণা করে গেছেন লাগাতার।কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে অন্য জায়গায়,ক্ষমতায় এসে তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা অনেকেই আঁখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন,জড়িয়ে পড়েছেন নানা দূর্নীতিতে।সরকারি সুযোগ সুবিধা সাধারণ মানুষ যত না পেযেছেন তার চেয়ে বেশী পেয়েছেন নেতারা।জঙ্গলমোহলের দলিত-প্রন্তিক মানুষজন একই রকম বঞ্চনা ও দারিদ্রের মধ্যে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে।মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে,এমনিতেই জঙ্গলমোহলের সাঁওতাল,মুন্ডা মানুষজনরা স্বভাব বিদ্রোহী,রাষ্ট্রের অনাচারের বিরুদ্ধে তারা বার বার গর্জে উঠেছে।তৃণমূলের শাসনেও তাদের বঞ্চনা ও অবহেলার জন্য প্রথমেই বিদ্রোহের বার্তা জঙ্গলমোহলই দিয়েছে।পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমোহলে বিজেপি যে ভাল ফল করেছে তার কারণ এই নয় যে সেখানকার মানুষ বিজেপিকে ভালবাসে,তার কারণ এটাই যে জঙ্গলমোহলের মানুষ তৃণমূলের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছে।শবরদের সম্প্রতি যে মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে তাও প্রমাণ করছে যে জঙ্গলমোহলে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় নি।বিপদের এই ঘন্টা শুনতে ভুল করেন নি মুখ্যমন্ত্রী,এবার জঙ্গলমোহলে তাঁর যে বাড়তি সক্রিয়তা নজরে পড়েছে তা এই কারণেই।এলাকা ধরে ধরে কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী,বদলে দিয়েছেন এলাকার দায়িত্বে থাকা নেতাদের।এমনকি প্রশাসনিক কর্তাদের বদলি করেছেন একেবারে প্রশাসনিক বৈঠক থেকেই।একান্ত বৈঠকে জানিয়েছেন এবার থেকে জঙ্গলমোহলের কাজের তদারকি তিনিই করবেন,তৈরি করছেন বিশেষ জঙ্গলমোহল নজরদারি কোড় কমিটি।সব মিলিয়ে বিপদের আঁচ পেয়েই যে প্রশাসনকে জঙ্গলমোহল নিয়ে বাড়তি উদ্যোগ নেবার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তাতে কোন সন্দেহ নেই।জঙ্গলমোহলের মানুষ অবহেলা অপমান বরদাস্ত করে না বেশীদিন,সেটা জানেন বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলছেন জঙ্গলমোহল তাঁর আত্মা,তাকে তিনি ছেড়ে যাবেন না।মুখ্যমন্ত্রীর এই সক্রিয়তা জঙ্গলমোহলের মানুষ কী ভাবে নেবে তা পরে বোঝা যাবে কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সেই নেত্রী যিনি এ রাজ্যের রাজনীতির মাটিকে সবচেয়ে ভাল চেনেন ও বোঝেন।