দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ কারও মাটির বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। কারও বাড়ির চাল উড়ে গেছে। অ্যাসবেস্টসের ছাদ ফুটো হয়ে বৃষ্টির জলে ভেসেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। আলো নেই, পর্যাপ্ত খাবার নেই, ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে ত্রাণশিবিরেই আতঙ্কের রাত কাটাচ্ছেন সাগরদ্বীপবাসী। ঝোড়ো হাওয়ার গর্জনে মাঝেমধ্যেই শিউরে উঠছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কেঁদে উঠছে কোলের শিশু। শনিবার অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আছড়ে পড়ার পরে এমনই ছবি দেখা গেল সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবনের কয়েকটি ত্রাণশিবিরে।

সুন্দরবনের একটি ত্রাণশিবিরে

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটা। সাগরদ্বীপের উপকূলে ১২৫ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এক ঝটকায় তছনছ হল উপকূলবর্তী এলাকা। স্থলভাগে ঢোকার পরে তার গতি বেড়ে হল ঘণ্টায় ১৩০-১৩৫ কিলোমিটার। যদিও আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, রাত বাড়লে ঝড়ের দাপটও বাড়বে। গভীর রাতে তার বেগ বেড়ে হতে পারে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। সাগরদ্বীপ থেকে সুন্দরবন পেরিয়ে সে ঢুকবে বাংলাদেশের খেপুপাড়ায়। ঝড়ের গতিপথে পড়বে সুন্দরবন বদ্বীপ অঞ্চল।

ঝড়ের দাপটে ইতিমধ্যেই চরম ক্ষতির মুখে সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেঙে পড়েছে মাটির বাড়িঘর, জলে ভাসছে চাষের জমি। মাথায় হাত ধান চাষিদের। একদিকে ধানের ক্ষেত তছনছ হয়েছে, অন্যদিকে ঝোড়ো হাওয়া কেড়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সন্ধের পর থেকেই সাগরের ধবলাট শিবপুর মৌজার লালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় দেড়শো মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তবে স্থানীয় সূত্রে খবর, রাত দশটার পরে ঘরহারাদের সংখ্যা দু’শো ছাড়িয়েছে।

প্রশাসনের তৎপরতায় ঘোড়ামারা দ্বীপের নিচু এলাকা থেকে লোকজনকে আগেই সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সন্ধে গড়াতে তাঁদেরও ঠাঁই দেওয়া হয় সাগরের স্কুলবাড়িতে। ছোট জায়গায় ঠাসাঠাসি করেই রাত কাটছে আশ্রয়হীনদের।

বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আগেই। সাগরদ্বীপ, সুন্দবনের বেশিরভাগ এলাকা প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। হ্যারিকেনের আলোই সম্বল। আশ্রিতদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন, এই টিমটিমে আলোও কতক্ষণ জ্বলবে জানা নেই। পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থাও নেই শিবিরে। শুকনো মুড়ি চিবিয়েই খিদে মেটাতে হয়েছে সকলকে। যদিও স্থানীয় বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা জানিয়েছেন, ঝড়বৃষ্টির জন্য রান্নার ব্যবস্থা তেমন করা যায়নি। তবে সকলকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বিধায়কের কথায়, “সব মানুষকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কিছু অসুবিধা হচ্ছে, তবে প্রশাসন পূর্ণ সহযোগিতা করছে। আমরা অসহায় মানুষদের পাশে আছি।”

সাগরদ্বীপে তাণ্ডব চালাচ্ছে অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। ঝড়ের দাপটে তছনছ সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। বকখালি, দিঘা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় অনেক আগে থেকেই তৎপর প্রশাসন। শনিবার বিকেলেই নবান্নের কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দফায় দফায় বৈঠক করছেন প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে। নিজেই পরিচালনা করছেন ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ।

নবান্নের কন্ট্রোল রুমেই বসেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মূল অভিঘাত কেটে গেছে। তবে যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, কেউ অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোবেন না।” সাগরদ্বীপের উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার। স্থলভাগে ঢোকার পরে তার বেগ বেড়ে হয়েছে ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। ইতিমধ্যেই সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবনে বেশ কিছু মাটির বাড়ি ভেঙে গেছে, গাছপালা উপড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ। ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঠিক কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন প্রশাসনিক কর্তারা। তৎপর রয়েছে উদ্ধারকারী দলও। সারা রাত জেগে উদ্ধারকাজ তদারকি করবেন জেলাশাসক, পুলিশকর্তারা। বিভিন্ন সাইক্লোন সেন্টারে ২ লক্ষ ৪০ হাজার খাবার জলের পাউচ পাঠানো হয়েছে। ১ লক্ষ ৬৪ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে পাঠানো হয়েছে। প্রায় ৩১৮টি শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই মিলেছে ১ লক্ষ ১২ হাজার মানুষের। প্রশাসনের থেকে সবুজ সঙ্কেত না মেলা পর্যন্ত ত্রাণশিবিরেই রাখা হবে আশ্রিতদের।
হাওয়া অফিস জানিয়েছে, উপকূলবর্তী এলাকায় ইতিমধ্যেই ঝড়ের বেগ ১৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ১০০-১১০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। কলকাতা, হাওড়া, হুগলিতে প্রতি ঘণ্টায় ৬৫-৮৫ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। বুলবুলের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে সাগর, ধবলাহাট, শিবপুর, সাগর ব্লকের চেমাগুড়ি, মৌসুনি, বকখালি এবং ফ্রেজারগঞ্জ এলাকায়। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামীকাল সকাল থেকে ড্রোন উড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নজরদারি চালানো হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here