অশোক মজুমদার

বৈশাখ বলতেই মনে পড়ে হালখাতা, বাংলা ক্যালেন্ডার, নতুন পঞ্জিকা আর দক্ষিণেশ্বর ও কালীঘাটে পুজো দেওয়ার ধুম। নববর্ষে নতুন জামাকাপড়ও পরেন অনেকে। এবার সেসব কিছুই নেই। এ এক অন্য বৈশাখ। করোনার ধাক্কা বাঙালির এই বিশেষ দিনটাকে একেবারে অন্যরকম করে দিয়েছে। তছনছ হয়ে গেছে পয়লা বৈশাখে আমার চেনা রুটিন। শুধু আমাদের পয়লা বৈশাখই নয়, কোভিড-19 শুষে নিয়েছে পৃথিবীর জীবনের রঙ। সব উৎসব এখন বন্ধ। গির্জা, মসজিদ, মন্দিরে রাজত্ব করছে শূন্যতা।

করোনা ভাইরাস মুছে দিয়েছে সীমান্ত। গোটা পৃথিবী স্রেফ একটা অসুখের আতঙ্কে কাঁপছে। বিজ্ঞানীরাও একে মোকাবিলার ব্যাপারে নিশ্চিত কোন আশ্বাস দিতে পারছেন না। তারা শুধু বলছেন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দুনিয়াজোড়া মানুষ এখন ঘরবন্দী। কৃষক, মজদুর, ভবঘুরে, ফুটপাথবাসী কারো সঙ্গে কারো তফাৎ নেই। করোনা বাঘে-গরুকে একঘাটে জল খাইয়ে ছেড়েছে। ভাইরাসের ক্ষমতা আছে বলতে হবে!

এমন একটা যুদ্ধ আমরা লড়ছি যেখানে গোলা বারুদের কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের লড়তে হবে সংস্কারমুক্ত মন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ এবং বিজ্ঞানসন্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। আজ অবধি সারা বিশ্বে মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষই জিতেছে। বহু মানুষকে হারাতে হলেও আমরা জানি, করোনা, তোমাকে পরাস্ত হতেই হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধে পৃথিবী অনেক সময় নষ্ট করেছে, তাতে মানুষের কোন লাভ হয়নি। এই যুদ্ধে কিন্তু জিতবে মানবতা।

করোনা ওলটপালট করে দিয়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রুটিন। সেদিন সাংবাদিকদের তিনি বললেন, আমি পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে প্রতি বছর মা কালীকে রাত বারোটায় কালীঘাটে গিয়ে যে পুজো দিই, তা এবার ঘরে বসে একাই করবো। দেশে বা বিদেশে পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুন না কেন, আমাদের দিদি কালীঘাটে গিয়ে এই পুজো দেবেনই। বিদেশ হলে তিনি আগে ফেরেন। আবার জরুরি কাজে দেশের অন্য প্রান্তে থাকলে, পুজো দিয়ে আবার সেখানে ফিরে গেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। প্রথমদিকে আমি এই পুজোয় উপস্থিত থাকতাম, তারপর দিদিই বারণ করেন। বলেন, দ্যাখ, আমি চাইনা পারিবারিক এই ব্যাপারের ছবি উঠুক।

ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় কালীঘাটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মায়ের হাত ধরে ভাইয়ের বৌদের নিয়ে উনি হেঁটে মন্দিরে যেতেন। ঠিক বারোটায় পুজো। নিজের হাতে আরতি করতেন। এত নিষ্ঠা সহকারে পুজো করতেন যে আমরা কেউ কোন কথা বলতাম না। সেই পুজো জীবনে প্রথমবার উনি মন্দিরে গিয়ে করবেন না। আমি জানি আমাদের দিদি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সবার মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে প্রার্থনা করবেন। এতবার দিদির কথা বলছি তার কারন একটাই, মা, বোন, দিদি, দাদা, ভাইদের কাছে তিনি এতটাই সহজভাবে থাকেন, মানুষের জন্য এত ভাবেন, তা আমাদের অবাক করে দেয়।

বন্ধু চিত্রসাংবাদিক পার্থ পাল আজ সকালে পুরুলিয়া যাওয়ার আগে দিদির প্রসঙ্গ টেনে অনেক কথা বলছিল। পার্থ বললো, ‘জানো অশোকদা, আন্দোলনের সময় মমতাকে পুলিশ যখন মারতো তখন আমার মা বলতো, এই মেয়েটাকে এত মারে কেন রে? কি করেছে, কোন দোষে ওকে মারছে? মা রাজনীতির ধারেকাছে ছিলনা তবু খবর দেখে এগুলো বলতো।’ আমি বললাম, আমার মায়েরও তো সেই একই কথা, মা বলতো দেখিস এই মেয়ে একদিন দেশ শাসন করবে।

কিছুদিন আগে বন্ধু চিত্রসাংবাদিক সলিল বেরার মা বাড়ির ছাদে প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকক্ষণ মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে প্রার্থনা করেন। দিদি মুড়ি খান বলে বহুবার আমায় বলেছেন, একটু মুড়ি দিয়ে আসবি মমতাকে? সলিলের মুখে প্রদীপ জ্বালানোর কথা শুনেই মাসিমাকে ফোন করলাম, কি গো প্রধানমন্ত্রী বললো আর তুমি ছাদে উঠে গেলে? জবাবে মাসিমা বলেছিল প্রদীপ জ্বালানোটা আমাদের রোজকার ব্যাপার। আমি শুধু মমতার জন্য প্রার্থনা করতেই ছাদে উঠেছি। বুঝতেই পারছেন আমরা যারা একটু লেখাপড়া শিখে বুদ্ধিজীবী হওয়ার চেষ্টা করছি, তারা যাই ভাবি না কেন আমাদের মা বাবার কাছে দিদি আসল ভগবান হয়ে আছেন।

আজ যখন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করোনা অতিমারির উপশমের জন্য একা মায়ের কাছে প্রার্থনা করবেন তখন আসুন আমরাও বাড়িতে পয়লা বৈশাখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সময় দিদির জন্য প্রার্থনা করি – দিদি, তুমি এভাবেই আমাদের পাশে থেকো আর নিজেকে সুস্থ রেখো। তোমাকে আমাদের দরকার। প্রণাম নিও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here