দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ নরেন্দ্র মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন, শ্রম আইনের খোলনলচে বদল, আলু-পেঁয়াজ থেকে পেট্রোপণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতায় আজ, বৃহস্পতিবার দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে ধর্মঘট। কিন্তু করোনা অতিমারীর মধ্যে এমনিতেই আর্থিক দুর্দশায় থাকা আমজনতাকে এই ধর্মঘট আরও সংকটে ফেলতে পারে, এমনটা ভেবেই উদ্বিগ্ন বহু অর্থনীতিবিদ। তাঁদের বক্তব্য, লকডাউনের ফলে দীর্ঘদিন সংগঠিত ও অসংগঠিত, উভয় ক্ষেত্রেই কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্তব্ধ হয়েছিল বহু শিল্প ক্ষেত্র। কাজ হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেক সংস্থা ঝাঁপ গুটিয়ে ফেলেছে। আনলক-পর্ব শুরু হওয়ায় ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে চলছে। এই পরিস্থিতিতে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট অর্থনীতির চাকাকে ফের স্তব্ধ করে দেবে কি না, এই নিয়েই সংশয়ে রয়েছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। যদিও ধর্মঘটের ডাক দেওয়া শ্রমিক নেতৃত্বের যুক্তি, মোদী সরকারের টনক না-নড়ায় শেষ অস্ত্র হিসেবে এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। কংগ্রেস, বামেরা এবং আরও একাধিক রাজনৈতিক দল এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে।

ধর্মঘট ‘সফল’ করতে বাংলায় বাম ও কংগ্রেস একযোগে রাস্তায় নেমেছে। তারা জানিয়েছে, সড়ক, রেলপথ অবরোধ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সামনে পিকেটিং করা হবে। ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রের ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলো এই ধর্মঘটে শামিল হওয়ায় আজ স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা। এই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এই ধর্মঘটের বিষয়গুলোকে সমর্থন করলেও ধর্মঘটকে সমর্থন করেনি। তবে যে সব বিষয়ে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, সেগুলোর পক্ষে তৃণমূল আজ বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করতে পারে বলে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন। যদিও তৃণমূলের এই অবস্থানকে ‘দ্বিচারিতা’ বলে কটাক্ষ করেছে বামেরা।

এই রাজনৈতিক তরজার মধ্যেই অর্থনীতিবিদদের একাংশ ধর্মঘটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর ন্যায্য অধিকার ধর্মঘট- এই কথা মেনে নিয়েও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ‘এই অতিমারী পরিস্থিতিতে ধর্মঘট ডাকা দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হয়েছে। ধর্মঘট ডেকে ইউনিয়নগুলো তাদের অস্তিত্ব জাহির করতে চায়। এতে কারও লাভ হয় না। অতিমারীর মধ্যে যখন অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তখন ধর্মঘট সাধারণ মানুষের ক্ষতি করবে।’ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি এই ধর্মঘটের বিরোধিতা করছে‌। সে ক্ষেত্রে তাদেরও যুক্তি এই অতিমারী পরিস্থিতি। বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যর বক্তব্য, ‘ধর্মঘট কেউ ডাকতেই পারেন। কিন্তু এই অতিমারী পরিস্থিতিতে যেখানে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে এই ধর্মঘট আদতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করবে।’ তবে ধর্মঘট মানেই কর্মনাশা- এই মতের বিরোধী অর্থনীতিবিদ গৌতম গুপ্তর কথায়, ‘পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে কয়েক দিন আগে প্যারিসে আমজনতা মাঝরাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের মাধ্যমে শহর অচল করেছিল। এখন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা ধর্মঘট করছেন। নরেন্দ্র মোদী সরকার সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতি ভেঙে দিয়ে যে ভাবে সংস্কারের নামে কৃষক, শ্রমিক, আমজনতার উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, সেখানে তো প্রতিবাদ হবেই।’

রাজ্যের ক্ষমতায় আসা ইস্তক তৃণমূল ধর্মঘট ও বন্‌ধের আরও তীব্র বিরোধিতা করছে। এ বারের ধর্মঘটের বিষয়গুলো নিয়ে তৃণমূলও দিল্লিতে ও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ-কর্মসূচি পালন করেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘ধর্মঘটের বিষয়গুলো নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল প্রথম থেকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। কিন্তু আমরা ধর্মঘটের পক্ষে নই। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ জারি থাকবে।’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘মানুষ এই ধর্মঘটের পক্ষে। এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে সমস্ত শ্রমিক সংগঠন ও কৃষক সংগঠন‌। বিরুদ্ধে কে? একমাত্র বিজেপি। তৃণমূল বলছে, তারা দাবিগুলোর পক্ষে, কিন্তু ধর্মঘটের পক্ষে নয়- এটা দ্বিচারিতা।’ জোর করে ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা হলে পাল্টা প্রতিরোধ হবে বলে বামেরা জানিয়েছে।

ধর্মঘটে আজ খাস দিল্লি অচল হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলোও। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে বড় আকারের জমায়েতের প্রস্তুতি নিয়েছে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন। কলকাতায় আজ একাধিক জায়গায় অবরোধ করেছেন ধর্মঘটীরা। মৌলালি থেকে সকালে বড় মিছিল করে বামেরা। প্রথম সারির বাম নেতৃত্ব এই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসও শহরের একাধিক জায়গায় অবরোধ করে ও বিক্ষোভে সামিল হয়।

কেন্দ্রীয় কৃষি আইন, শ্রম কোড, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আজ  ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি। দেশজুড়ে  বাম-কংগ্রেস ১০টি শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে ধর্মঘট হচ্ছে। বামপন্থীদের ডাকা এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে কংগ্রেস। দেশজুড়ে চলা এই ধর্মঘটে ২৫ কোটি শ্রমিক সামিল হয়েছে। যদিও এই ধর্মঘটে সামিল হয়নি  আরএসএসের ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বিএমএস)। তাদের দাবি, এই ধর্মঘট আসলে রাজনৈতিক। 

বনধের সমর্থনে এদিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেন অবরোধ শুরু করেন বাম কর্মী সমর্থকরা। এদিন সকালেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ডোমজুড় স্টেশনে বামেদের রেল অবরোধ শুরু হয় । সিপিএম কর্মীরা লাইনের ওপর গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ করে। আটকে পড়ে আমতা থেকে হাওড়া গামী লোকাল ট্রেন। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে রেল পুলিশ। হাওড়া কাটোয়া ডাউন লাইনের সমুদ্রগড় স্টেশনেও রেলঅবরোধ করেন স্থানীয় সিপিআইএম কর্মী ও বাম সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠন। অবরোধ চলাকালীন রেল পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ান বাম সমর্থকরা।

এদিন হাওড়া-ব্যান্ডেল শাখার চন্দননগর এবং শ্রীরামপুরে সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ অবরোধ শুরু হয়। যার জেরে হাওড়া শাখায়  বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ট্রেন পরিষেবা ।

কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তেও পথঅবরোধ করেন বাম কর্মী সংর্থকরা। এদিন শহরে বেসরকারি বাসের প্রায় দেখা মেলেনি। তবে  প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যা যাতে না হয়, তাই পথে প্রায় দেড় হাজার সরকারি বাস নামাায় রাজ্য সরকার।

কলকাতা সংলগ্ন বারাসতে বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ধর্মঘট সমর্থকদের বিরুদ্ধে। একই চিত্র ধরা পড়েছে দক্ষিণ শহরতলীর গড়িও ও উত্তর কলকাতার চিড়িয়ামোড়েও।

বামপন্থী ট্য়াক্সি সংগঠন জানিয়েছে, আজ তাঁরা গাড়ি রাস্তায় নামাবে না। শহরের অনেক জায়গাতেই এদিন ট্যাক্সি অমিল ছিল।দক্ষিণবঙ্গের মত উত্তরবঙ্গের বরোধ চালান বাম কর্মী সমর্থকরা। 

নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পুড়িয়ে ধর্মঘট সমর্থকদের বিক্ষোভ হাওড়ার শানপুরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here