‘ট্রাভেলগ’ (পর্ব-৯)

লিখছেন- দেবন্বীতা চক্রবর্তী,

মনিকরণে গরম পাথরে হ্যালান দিয়ে গা,হাত,পা সেঁকে বেশ ফ্রেশ লাগার পর আমরা পাশের রাম মন্দির থেকে ঝটপট ঘুরে এলাম । রাত ৯ টা বাজে তবুও পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে তা ঠিক করা যাচ্ছে না কিছুতেই ৷কারন আমরা যেতে চাই পাঞ্জাব , কুলু উপত্যকা আমরা ঘুরতে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু অমৃতসর যেন অদৃশ্য কোনো শক্তিতে আমাদের টানছে ৷

আমরা ছোটরা তো বায়না করতে ওস্তাদ , কিন্তু অবাক হলাম বড়রাও কেমন যেন হঠাৎ বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুঁড়ে বলতে লাগল তারা কুলু নয় সোজা পাঞ্জাব যাবে ,উল্টে তাদের উৎসাহ আমাদের চেয়ে বেশী বই কম নয় ৷ গাড়িতে বসে ও আমরা জপ করতে করতে চললাম ।কিন্তু যে এতক্ষণ যে চুপচাপ আমাদের কথা শুনে মজা নিচ্ছিল সেই দিলবর

( আমাদের ড্রাইভার) আসল বোমাটা ফাটাল ৷ সে এই রাতেই ,এই পথেই আমাদের পঞ্জাব নিয়ে যাবে নিজে এই ভাবেই ড্রাইভ করবে, পুরো রাত লাগবে তবে গিয়ে পঞ্জাব পৌঁছাবে ৷ তবে একটা শর্ত আছে , কেউ গাড়িতে ঘুমোতে পারবে না । শুনে মূহূর্তের জন্য আমরা স্তব্ধ হয়ে গিয়ে তার পর হর্ষধ্বনী করে উঠলাম , জোড় গলায় সবাই জানালাম আমরা কেউ ঘুমাবো না , একটা রাত না ঘুমিয়ে এই অ্যাডভেঞ্চার যে করব তা আমরা খুশি মনে মেনে নিলাম ৷

শুভঙ্কর বাবু আমাদের ব্যবহারে একটু অবাক ই হলেন কারন , যারা এখানে বেড়াতে আসে তারা স্বভাবতই আরাম আয়েশে ঘুরে বেড়ায় , কিন্তু আমরা পাগলামো করতে ই যে এসেছি তা তিনি আমাদের সাথে থেকে বুঝেছেন ,তাই বাড়তি খরচের কথাটা তিনি মনে করিয়ে দিলেন ৷
ঠাকুর বলেছিলেন “টাকা মাটি ,মাটি টাকা “, খরচ হয় হোক কিন্তু এই রাতভোর রোমাঞ্চিত অনুভূতি টাকা দিয়েও কেনা যায় না , রহস্য ,অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের পোকা হলেও চাইলেই হুট করে এমন সুযোগ আসে না | তাই আমরাও সেটা হারাতে চাইলাম না ।

গাড়ি একটা দোকানের সামনে দাঁড়াতে রাতের জন্য টুকুটাকি খাবার কিনে নিলাম , পেটে যে কারও কিছু পড়েনি তা কারও খেয়াল নেই ৷ এবার গাড়ি চলতে শুরু করল , শহর মানালি থেকে আমরা সোজাসুজি অমৃতসরের দূরত্ব প্রায় ৪৩০ কিম রাস্তা , কিন্ত আমরা নগ্গর, জগৎসু, মনিকরণ , মান্ডি সব পেরিয়ে আসার জন্য সেই দূরত্ব এখন দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০০ কিমির মতো ৷ অর্থাৎ প্রায় ৬ ঘন্টার রাস্তা যদি সব ঠিক থাকে ৷

বিরাট বড় একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মনের আনন্দে হাই ভল্যুমে পাঞ্জাবী গান চালিয়ে মানুষ যে কি করে সমানে একটানা গাড়ি চালিয়ে যেতে পারে তা আমি বুঝতে পারলাম না ৷ কি অসীম সাহসে ভর করে আমরা ও চলতে লাগলাম , শর্ত একটাই ঘুমানো চলবে না । জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখনলাম সামনে NH-1 এর মসৃন রাস্তা , দুপাশে ঘন জঙ্গল , তার মধ্যে কিছু না হলেও লেপার্ড আর বুনো শেয়াল তো আছেই, আর পাহাড় ঘিরে মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে ।

বাবা আবার ডাকাতের ভয় ও দেখাচ্ছে , ভয় , আনন্দ আর রোমাঞ্চ মিশিয়ে আমাদের মনের অবস্থা, ও গাড়ি চলছে তো চলছেই ৷ রাত একটা, দুটো , কোনো মালুম নেই কারও , হঠাৎ মনে হল কোখায় যাচ্ছি হারিয়ে গেছি , ড্রাইভার কিন্তু খুবই সাহসিকতার সাথে একটানা গাড়ি চালিয়ে ভোর ৪টের দিকে গাড়ি দাঁড় করালো ৷ সে এবার বিশ্রাম নেবে ৷

আমরা গাড়ির মধ্যে যে যেখানে বসেছিলাম সেখানেই বসে বসেই ঘুমিয়ে নিলাম ৷ ৮ টার দিকে গাড়ি চালিয়ে আমরা পৌছালাম পাঠানকোট , তারপর জলন্ধর হয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছালাম অতি কাঙ্খিত অমৃতসর ৷ আহা……এত কষ্টের পর যে সবাই সুস্থ দেহে অমৃতসরে আসতে পারলাম তা আমাদের পরম সৌভাগ্য ৷ এক গুরুদ্বারা থেকে আর একটি গুরুদ্বারায় গেলে নাকি পূন্য হয় ,তা না জানলেই এই হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া অ্যাডভেঞ্চরে গা ছমছমে রাত উপহার দেওয়ার জন্য দিলবর কে ধন্যবাদ জানালাম ৷ সে এখন আমাদের ড্রাইভার নয় এক পরম শুভাকাঙ্খী ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here