‘ট্রাভেলগ’ (পর্ব-৭)
লিখছেন~ দেবন্বিতা চক্রবর্তী,
নগ্গর প্যালেস থেকে বেড়িয়ে মনটা হঠাৎ টনটন করে উঠল । সত্যি …কত পথ পেরিয়ে এলাম এত দিনে , আবার এই পথ কোনো দিন যেতে পারব কিনা জানি না , কথায় আছে নদী দিয়ে যে জল বয়ে যায় তা আর ফেরে না । সেই প্রবাদ সত্যি প্রমান করে আমাদের পাশ দিয়ে কুল কুল ধ্বনীতে বয়ে চলেছে বিপাশা , তার স্বতঃস্ফূর্ত গতি মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে ৷
সূর্যের শেষ কিরন সেই জলে পড়ে চিকচিকে নরম সৌন্দর্য্যে চোখ কে আরাম দিচ্ছে ৷ সাড়ে সাড়ে চাষ করা আপেল ক্ষেতির ঢাকা প্লাস্টিকের কভার গুলোর উপর গিয়ে পিছ্লে যাচ্ছে আলোর ছটা ৷ আমরা শুনলাম এই নভেম্বর, ডিসেম্বর টা নাকি আপেল গাছ সবে লাগানো হয় , রসালো আপেল পাওয়া যাবে ,এসব দেখতে দেখতে কখন যে ১২ কিমি পথ পেরিয়ে এলাম বুঝতেই পারলাম না । আমরা এবার নামলাম পুরাতন কুলুর রাজধানী জগৎসু টেম্পলে , যা ৮ শতকের তৈরী শিখারা শৈলির গৌরিশঙ্কর তথা শিব ও ১৫ শতকের সন্ধ্যা গায়েত্রী মন্দিরের জন্য বিখ্যাত এখানে ৷
এছাড়াও আরও একটা ইতিহাস জ্বলজ্বল করছে এই স্থানে , তা হল তৃতীয় পান্ডব অর্জুন স্বয়ং পশুপতি শিবের কাছে গান্ডীব অস্ত্র লাভ করেন । আহা ….যেমন সুন্দর পরিবেশ কেমন সুন্দর তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য …আমরা কত অজ্ঞ তা মর্মে মর্মে অনুভব করছি ৷ বেশিক্ষন অবশ্য সময় পেলাম না, কারন আমাদের এবার ছুটে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মান্ডি হয়ে মনিকরণ ৷ মান্ডি আমরা আগেও পেয়েছি মানালি আসার পথে ৷ রাতের অন্ধকারে মান্ডির উপর দিয়ে গাড়ি চলতে থাকল হুহু করে ৷
মান্ডি বিশাল শহর , বিপাশার দুকুল জুরেই তার ব্যাপ্তি ৷ এটি প্রধানত বানিজ্য শহর বলেই জানা যায় , তবে মান্ডি হল মানালি তথা কুলু উপত্যকার প্রবেশ দ্বার , আবার এখান থেকে চলে যাওয়া যায় যেমন হিমাচলের বিভিন্ন অঞ্চলে তেমনই এই শহরের উপর দিয়ে প্রতিবেশী রাজ্য পাঞ্জাবের অনেশ উল্লেখযোগ্য স্থান যেমন পাঠানকোট, চন্ডীগড় , ধরমশালা ইত্যাদি । অতীতে মান্ডী ছিল বাণিজ্য নগরী , বনিকরা এই পথ বেছে নিত তাদের বাণিজ্যের সুবিধার্থে ৷ আমাদের হাসি ঠাট্টা আলোচনা, সমালোচনার মধ্যেই হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের ড্রাইভার একটি টিমটিমে আলো দোরানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের রেখেই ছুটে গেল দোকানের দিকে ৷
অামরা একটু হকচকিয়েই গিয়েছিলাম কারন তার যথেষ্ট কারন ও ছিল , গাড়ি খারাপ হলে আমাদের এই শেয়াল সমেত নানা বুনো জানোয়ার সমেত পাহাড়ী জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে …..যদিও এই আশঙ্কা আমাদের পরে ফলে গেছিল ৷ কিন্তু আমাদের তখনকার সব আশঙ্কায় জল ঢেলে দিয়ে আমাদের বছর ২৫ এর পাঞ্জাবী ড্রাইভার দিলবার একমুখ হাসি নিয়ে হাজির হয়ে বলল এখানে স্থানীসয়য় খাঁটি দুধের চা খাওয়াবে বলে গাড়ি থামিয়েছে আর আমাদের গাড়ি থেকে নেমে না এলে আমরা মিস করব ৷ গাড়ী থেকে নেমেই বুঝলাম যে তার কথা অমূলক নয়, বাইরে কুলুকুলু শব্দে বিপাশা বয়ে চলেছে আর ঠান্ডা হাওয়া আমাদের হাড় কাঁপিয়ে দিলেও একদম জম্পেশ শীতের আমেজ উপস্থিত ৷
চা খেতে খেতে আমরা দেখলাম হাত সেঁকে নেওয়ার জন্য স্থানীয়রা কাঠকুটো দিয়ে আগুন করেছে ৷ হিমাচলের পর্যটনের উন্নতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , তেমন এটাও ঠিক যে স্থানীয় মানুষ গুলোর মন যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো , কত যত্নে যে তারা অতীথিদের সেবা করেন তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় ৷ আমরা উৎকৃষ্ট চা পান করতে করতে ঠিক করে নিলাম পরবর্তী দিন গুলোর প্ল্যান কি হবে ,কারন কুলু শহরটা ঘোরার কারও তেমন ইচ্ছা নেই আমাদের ৷ আমরা মনিকরণের পর যেতে চাই সোজা পাঞ্জাব , অমৃতসর ৷ নতুন অমৃতের সন্ধানে…..(ক্রমশ)