দেশের সময়, কলকাতা:
কিছুদিন আগে যুবভারতীর সবুজ গালিচায় বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার খেলতে নেমেছিল ভারত-বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ‘জনগণমন’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনেছিল ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। ফুটবলের মক্কায় দু’দেশ নামলেও ক্রিকেটের নন্দন কাননে এর আগে দেখা হয়নি ভারত-বাংলাদেশের। এই প্রথম ক্রিকেটের আঙিনায় ইডেন গার্ডেনসে নামছে দু’দল।
তাও আবার ঐতিহাসিক দিন-রাতের ম্যাচে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে শোনা যাবে দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই ইডেনে এক হয়ে যাবে দুই বাংলার আবেগ।
ভারত-বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একতরফা প্রাধান্য দেখিয়েছে ভারত। দু’দেশের মধ্যে এর আগে ১১টি টি ২০, ১০টি টেস্ট ও ৩৬টি একদিনের ম্যাচ হয়েছে। টেস্টে ৮ ম্যাচে জয় পেয়েছে ভারত। দুটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টে জয় নেই বাংলাদেশের। ১১টি টি ২০-র মধ্যে ভারত জিতেছে ১০টি ম্যাচে। বাংলাদেশ মাত্র একটি। এই সফরেই দিল্লিতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম জয় পেয়েছে ওপার বাংলার দল। আর একদিনের ক্রিকেটে ৩০ ম্যাচে জয় পেয়েছে ভারত। বাংলাদেশ জিতেছে ৫টি ম্যাচ। একটি ম্যাচ টাই হয়েছে।
পরিসংখ্যানে ভারত অনেকটা এগিয়ে থাকলেও বর্তমানে দু’দেশের লড়াই কিন্তু মোটেই একতরফা হয় না। বিশেষ করে একদিনের ক্রিকেট ও টি ২০তে বেশ কিছু হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক উন্নতি করেছে। তবে টেস্ট ক্রিকেটে এখনও কোহলিদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে মুশফিকুররা। ইনদোরের হোলকার স্টেডিয়ামেই সেটা দেখা গিয়েছে। ইডেনে ফের সেই ছবি ফেরার ইঙ্গিত।
ইডেনের ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের উত্তেজনা সাম্প্রতিক টেস্ট ম্যাচ ঘিরে এর আগে দেখা যায়নি। টেস্ট ১ নম্বর দল হওয়া সত্বেও ভারতের কোথাও মাঠ অর্ধেকের বেশি ভরে না। সেখানে ইডেনে গোলাপি বলের টেস্ট উপলক্ষ্যে প্রথম চারদিনের টিকিট শেষ। হাহাকার পড়ে গিয়েছে কলকাতা জুড়ে। অফলাইনে টিকিট ছাড়া হয়নি। তার মধ্যে টিকিটের কালোবাজারি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে তিনজন।
এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার বেলা ১টার কিছুক্ষণ আগে মাঠে নামবে দু’দল। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গাইবে ‘জনগণমন’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’। মাঠে তার সাক্ষী থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেইসঙ্গে মাঠে উপস্থিত ৬৫ হাজার দর্শকও গলা মেলাবেন কোহলি, মুশফিকুরদের সঙ্গে। কেউ বা দুটি গানেই। এটাই তো এই টেস্টের মাহাত্ম্য। বাংলার মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে নামবে এগারোজন বাঙালি।
আর ৪৮ ঘণ্টাও বাকি নেই ইডেনে ঐতিহাসিক দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ শুরু হতে। তার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ক্রিকেটের নন্দন কাননে। প্রথম চারদিনের টিকিট শেষ। গোলাপি আলোয় সেজে উঠেছে ইডেন গার্ডেনস। আর তার মধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন বিরাট কোহলিরা।
সোমবারই ভারত ও বাংলাদেশ দু’দল পা রেখেছিল কলকাতায়। দলের আগেই শহরে চলে আসেন ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও তাঁর ডেপুটি অজিঙ্কে রাহাণে। মঙ্গলবার শহরে পা রাখেন রোহিত শর্মা। বুধবার সকালে আসেন মহম্মদ শামি ও উমেশ যাদব।
বুধবার বিকেলে পিচ দেখতে যান ভারতের কোচ রবি শাস্ত্রী। পিচ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয় কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সন্ধ্যায় ভারতীয় দল আসে ইডেনে। ঘণ্টা দুয়েক প্র্যাকটিস করে তারা। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিনটি সেশনই হয়। প্র্যাকটিস দেখে মনে হচ্ছে ইডেনেও ভারতীয় দল অপরিবর্তিত থাকবে।
কোহলিদের আসার অনেক আগেই জ্বলে উঠেছিল ইডেনের আলো। গোটা মাঠে গোলাপি আলোর রোশনাই এক অদ্ভুত মাদকতা সৃষ্টি করেছে। প্র্যাকটিসের মাঝেই কোহলিদের চোখ চলে যাচ্ছিল সেই রোশনাইয়ের দিকে।
ম্যাচ চলাকালীন শহরের সব সৌধের রং থাকবে গোলাপি। গোটা শহর প্রস্তুত এই ঐতিহাসিক ম্যাচের সাক্ষী থাকতে। এই আবহে শুক্রবার মাঠভর্তি দর্শকদের সামনে নামবেন কোহলিরা। তৈরি হবে এক নতুন ইতিহাস।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই ইডেন গার্ডেনসে ঐতিহাসিক দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামবে ভারত-বাংলাদেশ। তার আগে সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নিয়ে নিজের বক্তব্য রাখলেন ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বললেন, এই ম্যাচ সত্যিই তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ নিতে তাঁরা প্রস্তুত।
বুধবার সন্ধেবেলা ইডেনে প্র্যাকটিস শেষ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিরাট। সেখানে তিনি বলেন, “গোলাপি বলের টেস্ট আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা তার জন্য মুখিয়ে আছি। সবার এনার্জি খুব বেশি। এটা ভারতীয় ক্রিকেটে একটা ল্যান্ডমার্ক।” বিরাট আরও বলেন, “আমি অন্য দল কিংবা তাদের বোর্ডের ব্যাপারে বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি গত কয়েক বছরে বিসিসিআইয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনা দলের খেলা আরও উন্নত করেছে।”
গোলাপি বলের টেস্টে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে সে কথাও জানান ভারত অধিনায়ক। তিনি বলেন, “গোলাপি বলের টেস্টে সবথেকে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবেন ফিল্ডাররা। সবাই জানলে অবাক হবেন গোলাপি বলে ফিল্ডিং করা খুব কঠিন। বলের ওজন অনেক বেশি মনে হচ্ছে। আমি জানি ওজনে কোনও পার্থক্য নেই, কিন্তু হাতে ধরলে মনে হচ্ছে গোলাপি বল বেশি ভারী। স্লিপে দাঁড়িয়ে ক্যাচ ধরতে গেলে অনেক জোরে হাতে এসে বল লাগছে। বাউন্ডারি থেকে বল থ্রো করার সময়ও ফিল্ডারদের বেশি শক্তি লাগাতে হচ্ছে।”
২০১৫ সাল থেকে দিন-রাতের টেস্ট শুরু হলেও প্রধান টেস্ট খেলা দেশগুলির মধ্যে ভারত সবথেকে শেষে এই টেস্ট খেলছে। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে বিরাটদের অ্যাডিলেডে টেস্ট খেলার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা তা না করেছিল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে প্রস্তাব দেন দিন-রাতের টেস্ট খেলার। রাজি হয়ে যান বিরাট। ভারতীয় বোর্ডের প্রস্তাবে রাজি হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও। তারপরেই ঘোষণা করা হয় ইডেনে ঐতিহাসিক টেস্ট খেলতে নামবে দু’দেশ।
ছবি তুলেছেন- কুন্তল চক্রবর্তী ও প্রদীপ দে ৷