‘ট্রাভেলগ’ (পর্ব-১১)
দেবন্বীতা চক্রবর্তী,
সালটা ১৫০২ , গুরু নানক লাহোর থেকে ১৫০ কিমি এই পথে এক অতীব সুন্দর জলাশয় দেখে এক স্বপ্ন শহর পরিকল্পনা শুরু করেন ৷ ১৫৭৭ সালে সম্রাট আকবরের ফরমান পেয়ে ৪র্থ শিখ গুরু রামদাস এই জনপদ তৈরী করলেন ….অমৃতের ন্যায় এই পবিত্র সর (সরোবর) ঘিরে স্থল তৈরী হল ..তাই তা আমৃতসর ৷
সরোবর কে ঘিরে নবনির্মিত মন্দিরের নাম রাখা হন হরমন্দির ৷ ব্রিটিশদের কবলে তা ধ্বংস হলেও কালে কালে অমৃতসর হয়ে উঠল শিখদের প্রধান তীর্থ গড়ে উঠল । ১৮০৩ -৩৩ পর্যন্ত সময়ে হরমন্দির পুনরায় নির্মিত হল সোনা রূপা ও হস্তদন্ত দিয়ে …সোনায় মোড়া এই মন্দিরের নাম হল স্বর্নমন্দির যা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান তীর্থক্ষেত্র ৷
এইসব গল্প আমি আর মা ই শোনার সৌভাগ্য করেছিলাম কারন বাকিরা মন্দিরে ঢোকার মুখে প্রচন্ড ভিড়ের ঠেলায় কে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল তা ঠিক বোঝা গেল না ৷ যে যার মতো স্বর্ণমন্দিরের জলাশয় ঘিরে ঘুরতে লাগলাম ।
মেয়েদের মাথায় ঘোমটা আর ছেলেদের মাথায় ফেট্টি বাঁধার কঠোর নিয়ম থাকায় সবাই কে একইরকম লাগছে ৷ হাজারে হাজারে পাগড়ি চোখের সামনে সার বেধে ঘুরতে লাগল । মায়ের সাথে হারিয়ে গেছি, বাকিদের পাত্তা নেই , আর স্বর্ণমন্দিরের সেই চোখ ধাঁধানো রূপ , আর অষ্টপ্রহর সংকির্তনের মাঝে পড়ে আমি কিংকর্ত্যবিমূড় ৷
দাঁড়িয়ে না থেকে জায়গা টা দেখে নেওয়ার জন্য অগত্যা আমরা জলাশয় ঘুরে মূল মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলাম | কিন্তু সেখানেও উল্টো বিপদ ৷ প্রায় হাজার খানেক লোক মূল মন্দিরে ঢোকার জন্য লাইন দিয়েছে , মূহূর্তের জন্য মনে হল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ডালা হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ৷মজাও লাগল বেশ।
এই লাইনে দাঁড়িয়েই আলাপ হল এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের সাথে । তিনিই আমাদের উপরিউক্ত ঘটনাটি শোনালেন । মন্দিরের ভিতরে জলাশয়ে ঝাঁক বাধা রঙিন মাছ ও আলোয় ঝিকমিক , মূল মন্দির থেকে বেরোনোর সময় হাত পেতে নিতে হয় হালুয়া প্রসাদ , ঘি য়ে চপচপে ,স্বাদে অতুলনীয় বলা যায় ।
অবশেষে বহু কষ্টে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সকলে একত্রিত হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম মন্দির থেকে , তবে প্রভাকী আলোয় আর ও একবার সেই অপূর্ব স্থাপত্য দর্শনের অঙ্গীকার বদ্ধ হলাম ।
পরের দিন সকাল বেলা পৌছে গেলাম জালিওয়ানওয়ালা বাগের সেই উদ্দ্যানে , যার রক্তাক্ত ও মর্মস্পর্শী ব্রিটিশ অত্যাচারের কাহিনী সকলের ই জানা । ১৯১৯ সালের ১৩ ই এপ্রিল শিখদের বৈশাখী উৎসবের দিন জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে বন্দুকের শেষ গুলিটি নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বিচারে যে গুলি চালানো হয় সেই বুলেট বিদ্ধ প্রাচীর এখনও সেই করুন কাহিনী মনে করিয়ে দিচ্ছে ৷
দেখতে পেলাম সেই গভীর কূপ যার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন নারী ও শিশুরা , মুখ্য দুয়ার সংকীর্ণ হওয়ার সহস্রাধিক প্রানের বলিদানের প্রতীক এই জালিয়ীনওয়ালাবাগ ৷ উদ্দ্যানের মাঝখানে শহীদ স্মারক ও হত্যাকান্ডের দিন থেকে জ্বলা পবিত্র ধূনী দেখে চোখে জল আসতে চায় ৷
পাশাপাশি তৈরী হয়েছে দুটি মিউজিয়াম শহিদ দের পরিচিতি নিয়ে ৷মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় আবার এক দৌড়ে চলে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে , পরম গুরুর কাছেই তো সব কিছুর অবসান ৷ সোনার আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে স্বর্ণমন্দিরের পদ্মাকৃতি মন্দির ৷ শেষ বার তাকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ফেরার পথের উদ্দেশ্যে, পিছনে পড়ে রইল অসংখ্য স্মৃতির মেলা ৷ (ক্রমশ)