Yoga Shastra আর মাওয়ের রেড বুক নয়, পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রই ধ্যান জ্ঞান সত্তরের প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সম্ময়ের

0
262
পার্থসারথি সেনগুপ্ত

ছয়ের দশকের শেষাশেষি হিন্দু স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই অতি বাম রাজনীতিতে হাতে খড়ি সন্ময় মুখোপাধ্যায়ের। এর পর ১৯৭oসালে হায়ার সেকেন্ডারিতে থার্টিনথ রাঙ্ক করে একই সঙ্গে আই আই টি খড়গপুরে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ার সুযোগ মিলল। যদিও মন বসে নি আই আই টি – তে। শেষমেশ আই আই টি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রাজনীতির ঘূর্ণিতে উত্তাল প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসেই ফিজিক্স পড়া শুরু করা। আর পুরোদমে ” তদগতচিত্তে” যোগদান নকশাল রাজনীতিতে।

যার জেরে পুলিশের তাড়া খাওয়া, হাজত বাস, বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের হাতে নিদারুণ উত্তম মধ্যম, এস বি’ এর হিমশীতল ‘ ‘ ইন্টারোগেশন ” – এসব জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারু মজুমদারের ‘নির্দেশিত’ বিপ্লবী মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার সুবাদে নাম উঠেছিল বিরোধীদের হিট লিস্টেও। কোনো মতে প্রাণে বেঁচেছিলেন কিন্ত রাজনীতি ও ইতিহাস দুয়ের গতিই অতি বিচিত্র। ‘চীনের চেয়ারম্যান’ মাও জে দংয়ের ‘ রেড বুক ‘- এর তত্ত্ব একদিন যার ছিল মন্ত্র, তিনি নিজের এখন পরিচয় দেন ” যৌগিক সেনানী” হিসাবে। মাওবাদকে জীর্ণ বস্ত্রের মত পরিত্যাগ করে ঋষি পতঞ্জলির যোগ দর্শনই এখন তার ধ্যান জ্ঞান। হালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সন্ময় দেশ বিদেশে রীতি মত সুখ্যাতি অর্জন করেছেন যোগগুরু হিসাবে। যদিও, গুরুবাদের চেয়ে নিজেকে যোগ শিক্ষক হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন সন্ময়। যোগচর্চার মাধ্যমে মানবজমিনের নকশী কাঁথায় আরো এক ঝাঁক উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়া লাগানোই তিনি পাখির চোখ করেছেন।

২০২৩- এ প্রকাশিত তাঁর বই ” দা যৌগিক ওয়ারিরর” বইয়ের মুখ বন্ধে তিনি লিখেছেন, ” যোগা হেল্পড দা বডি টু মুভ ফ্রম সিমপ্যাথেটিক স্টিমুলেশন ( স্ট্রেস ইন্ডীউজড ডিউ টু দ্য পান্ডেমিক, নেগেটিভ নিউজ, হোপলেস প্রেডিকশন ) টু আ পারা সিম্পপাথেটিক স্টেট)। … ইট এলিমিনেটেড দ ফিয়ার ফ্যাক্টর কুইকলি।” তিনি স্পষ্টতই অনুধাবন করেছেন বন্দুকের নল নয়, শক্তির উৎস যোগ চর্চা। কিন্তু কট্টর অতি বাম থেকে কি ভাবে তার জীবন দর্শনে ঘটল এই মৌলিক রূপান্তর?

এই প্রশ্নের উত্তরে সন্ময় বলেন, ” ছোট বেলা থেকেই আমার বাড়িতে বামপন্থী রাজনীতির বাতাবরণ ছিল। আমরা প্রথমে থাকতাম বেলেঘাটায়, পরে চলে আসি দক্ষিণ কলকাতায়। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ অফিসার হলেও, বাম রাজনীতির প্রতি সহানুূতিশীল ছিলেন। তবে এটাও ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে জীবনের সর্ব স্তরেই সে সময় কমিউনিজম বা সমাজবাদের প্রভাব ছিল। কিন্তু অতি বাম রাজনীতির নারেটিভটা তখনও দানা পাকে নি।” তার প্রাথমিক পড়াশোনা ডণ বস্কো স্কুলে। পরে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে। স্কুলে পড়ার সময়ই ‘ কাকার ‘ ( অসীম চট্টোপাধ্যায়) মিটিং- এও কখনো কখনো যোগ দিয়েছেন।

তার কথায়, ‘ আসলে আমার মধ্যে একটা ডিলেমা কাজ করত। কৈশোরে আধ্যাত্মিকতার নানা দিক নিয়ে মাথা ঘামাতাম। বয়: সন্ধিকালে ব্রহ্মচর্য পালনে ঝুঁকেছিলাম। অন্যদিকে, রাজনীতির ব্যাপারেও আকর্ষণ বোধ করতাম। একদিন শুনলাম সি পি এম আর নকশালবাদিরা ময়দান চত্বরে আলাদা আলাদা জনসভা করবে। চলে গেলাম। একটা পর্যায়ে তো দু গোষ্ঠীর সমর্থকদের মধ্যে ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। কোনো মতে বাড়ি ফিরলাম।”

কলেজে ঢুকে নকশাল ‘ দাদারা” তাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছিল ‘ ফ্রেশার’ – দের মধ্যে থেকে ‘রিক্রুট’ করতে। সরাসরি কোনো অ্যাকশনে যেতে তাকে নিষেধ করা হয়েছিল। পুলিশের নজরদারির জালে যাতে জড়িয়ে না পড়ি, সে জন্যই এই ‘টাক্টিস’। বিভিন্ন গন সংগঘটনের মধ্যে মিশে থেকে রাজনৈতিক প্রচারের কাজে বেশি করে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ” আমি আর আমার কয়েকজন কমরেড মিলে গড়ে তুললাম প্রেসিডেন্সি কলেজ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন । আসলে লালবাজারের নজরদারি তখন তুঙ্গে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে পুরো ব্যাপারটাই আমূল বদলে গেলো।” তার ব্যাখ্যায়, ” সিনান করব, কিন্তু বেনি ভিজাব না, এটা বোধ হয় সব সময় সম্ভব নয়। ফলে পুলিশের নজর বেশি দিন এড়ানো গেল না। ” যা হয়েছিল, প্রেসিডেন্সির গেটে মোতায়েন সি আর পি এফ জওয়ানদের শিফট বদলের সময় প্রেসিডেন্সির ছাদ থেকে তাদের উপর পাইপ বোমা ছোড়া হয়েছিল। বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন জওয়ান আহত হন। যদিও সন্ময়ের বক্তব্য, ” বিকেলের দিকে ঘটনাটা ঘটে। আমি কিন্তু তখন কলেজে উপস্থিত ছিলাম না। পুলিশ কিন্তু এক ধারসে অনেককেই তুললো। আমারও প্রায়ই ডাক পড়ত এস বি ‘ র দপ্তরে। ” গ্রেফতার না করলেও চলত টানা জেরা। কখনো কখনো অফিসাররা জেরার রিভলভারও বের করতেন।

যদিও তিনি যে পাইপ বোমা ছোড়েন নি গোয়েন্দাদের এটা ভাল মতোই জানা ছিল। গোয়েন্দাদের জেরার অভিমুখ ছিল বাবা বাছা করে বা ভয় দেখিয়ে অতি বাম রাজনীতির কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ করে ” আন্ডার গ্রাউন্ড-” এ কে কতটা সক্রিয় বা কার কি ভূমিকা বা দ্বায়িত্ব সেই অন্দরের খবর বের করা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গ্রেফতারি এড়ানো গেল না। চারু মজুমদার ধরা পড়ার দিনই সন্ময়কে গ্রেফতার করল পুলিশ। তার কথায়, ” বাবা মা তো ধরেই নিলেন আর আমি ফিরব না। বলি হব এনকাউন্টারের। এরই মধ্যে অবশ্য হাস্যরসের উপাদানও আছে। প্রথম দিন লক আপে আমাদের সঙ্গে কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাতকেও রাখা হয়েছিল। যারা প্রথমে খানিক হম্বি তম্বি করলেও যেই শুনলো নকশাল, একেবারে চুপ করে গেল। ডাকাতরাও নকশালদের ডরাত। “

তবে পুলিশি জেরার ভয়ঙ্কর দিকটাও যে কি ছিল তা সন্ময় তার লেখা একটি উপাখ্যান বা উপন্যাসে বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন এক কাল্পনিক চরিত্র, লালবাজারের এক গোয়েন্দা প্রধানের কথা। সেই কাহিনীতে যাকে দেখে নকশাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ধৃত প্রেসিডেন্সির এক ছাত্রের মনে হয়েছিল, এতো সেই কুখ্যাত ” সাইকোপাথ”। উপন্যাসের আখ্যানে ওই যুবককে জেরার শুরুতে গোয়েন্দা প্রধান অবশ্য মাখনের মত নরম। তার হাতে রয়েছে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা উপন্যাস। তিনি বলছেন, ” তোমার তো দেখছি দারুন রেজাল্ট। হিন্দু স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করেছো। তোমার উপর তোমার বাবা মায়ের কত আশা।” আবার আখ্যান অনুযায়ী, পুলিশ অফিসার মনে মনে এও ভাবছেন, ছেলেটা তাড়াতারি মুখ খুললে বাঁচা যায়। কত আর সন্দেহভাজনদের ‘পায়ু দেশে’ রুল ঢুকিয়ে পেটের কথা বের করার ঝক্কি পোয়ানো যায়!

এত কিছুর মধ্যে অবশ্য সন্ময়ের মনের মধ্যে অতি বাম রাজনীতির আবেশ ফিকে হতে শুরু করে। রক্ত ঝরানোর রাজনীতি আদতে কতটা মৌলিক পরিবর্তনের বাহক হতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তরও তিনি নিজের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করেন। তার ব্যাখ্যায়, ” আসলে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এর রাজনৈতিক প্রকৃতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে নকশালদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। এই তত্ত্ব গত বাদানুবাদ সংক্রান্ত একটি দলিল আমাদের হাতেও আসে। সেই অবস্থায় কোনো কোনো কমরেডের বিরাগভাজন হয়েও নিজেই চাঁদা তুলে শরনার্থীদের জন্য সামান্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থাও করেছিলাম। তাদের শিবিরে এসে আমার মনে হয়েছিল রাজনৈতিক তত্ত্বের চাপান উতোরের চেয়ে এই সমস্যার সমাধানে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দিশা খোঁজা দরকার।

আস্তে আস্তে অতি বাম রাজনীতির প্রকোপ বাংলায় ঝিমিয়ে আসে। রাজনীতির পাকে চক্রে সন্ময়ের কলেজে একটি বছর নষ্টও হয়। প্রেসিডেন্সিতে অনার্সের পর তিনি সায়েন্স কলেজ থেকে এম টেকে ভর্তি হয়ে ফার্স্ট ক্লাস পান। একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে তিনি ১৯৮৩ তে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পান। তথ্য প্রযুক্তিকেই পেশা হিসাবে বেছে নেন। তখনও অবশ্য সমাজবাদে উপর তার আস্থা অটুট ছিল। আটের দশকের শেষ ভাগে ও নয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট জামানার অবলুপ্তির পর সমাজবাদের ভুত ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও দোলাচল এড়িয়ে যেতে পারেন নি সন্ময়ও। এক দলীয় শাসনের কাঠামোয় বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চরম অভাব সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠায় কার্যত কতটা অনুঘটকের কাজ করে তা নিয়ে সংশয় গ্রাস করে তাকে। এরই সমান্তরাল ধারায় তিনি নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পান ভারত সেবাশ্রম সংঘের সেবা ধর্মের আদর্শ থেকে। শুরু হয় যোগ শিক্ষার পর্ব। হালে বেঙ্গালুরুর যোগা ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পি এইচ ডি- ও করছেন। পড়াশোনা করেছেন আয়ুর্বেদ নিয়েও।

তার কথায়, ” জীবনে কিছু হারিয়েছি, কিছু পেয়েছি। এখন আর হিসাবের খেরোর খাতা খুলতে মন চায় না। যোগ চর্চা আমায় শিখিয়েছে সকলের মাঝে থেকেও আত্মস্থ হতে। সেটা কি কিছু কম পাওনা! আর আমার সেই শিক্ষা, অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়াটাও জগতের অসীম আনন্দ ধারায় অবগাহনের তৃপ্তি দেয়। “

Previous articleUnnatural Death বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটির প্ল্যান! প্রথম শ্রেণির ছাত্রের মাথা থেঁতলে খুন? আটক অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া
Next articleShaktipith Parikrama বাঙালির ভক্তি যাত্রা – প্রসঙ্গ শক্তি পীঠ পরিক্রমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here