শেষ চিঠি…..।।
অশোক মজুমদার
পালানোর ফাঁকে ফাঁকে চিঠি লিখছি। শেষ করতে পারবো কি না জানিনা। তোমাদের ছোঁড়া ইট, তীর, বল্লম, টাঙ্গির ঘায়ে কাহিল হয়ে পড়েছি। এই বাগঘরার জঙ্গলে আজই হয়তো আমার শেষ দিন। বাবা মা বলতো, মানুষের ত্রিসীমানায় যাবি না। কিন্তু কি করবো বল, জঙ্গল তো তোমরাই কেটে ছেটে রিসর্ট আর জনবসত তৈরি করে, ভুলভাল গাছ লাগিয়ে হাওয়া করে দিয়েছো। আমাদের চরার জায়গাও নেই, খাবারও নেই। তোমাদের সংরক্ষিত অরণ্যে পর্যটকদের সামনে পোজ দেওয়াটাই যেন আমাদের একমাত্র ডিউটি। আমরা তো মানুষের মতন নই প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের এলাকার বাইরে আমরা যাই না। পেটের টানেই আমরা বনের বাইরে আসি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কি কুক্ষণেই এক চিলতে রুমালের মত তোমাদের এই লালগড়ের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিলাম।
তোমরা গম্ভীরভাবে এটাকে অরণ্য বললেও কিন্তু এখানে বন্যপ্রাণ খুব একটা কিছু নেই। মানুষজনও খুব গরীব। ওদের কেউ কেউ কাঠকুটো কুড়িয়ে খায়। ওরা ভাবল আমি বোধ হয় আরেকটা ভাগীদার এসেছি। আমি কিন্তু কোন মানুষকে নিজের থেকে আক্রমণ করতে যাইনি। কোনমতে নিজের পেট চালানো ছাড়া আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। মানুষ আমাকে মারতে এলে প্রাণ বাঁচাতেই কয়েকজনকে খানিকটা আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছি। কী করবো বল খাবার নেই, বিশ্রাম নেই তার ওপর গ্রামবাসীদের যখন তখন তাড়া। দু চারটে গরু, ছাগল, বন শুয়োর ছাড়া আর তো কোন খাওয়া জুটছে না।
যাই বলো তোমরা মানুষরা সাংঘাতিক জীব হলেও বেশ ভীতু। আমাকে ধরার জন্য দলে দলে লোক ঢুকল এই এক চিলতে জঙ্গলে। আকাশে উড়ল ড্রোন, জঙ্গলে ঢুকল তোমাদের নজরদারি গাড়ি। তাতে আবার দমবন্ধ হয়ে দুজন বনকর্মী মারাও গেল। ভাগ্যিস বদ্ধ গাড়িতে মারা গেছে খোলা জায়গায় মারা গেলে আমার উপর দোষ চাপতো। আর বাপু বলিহারি তোমাদের বন দপ্তর আর পুলিশ। গাদা গাদা লোক বাঘ দেখতে জঙ্গলে ঢুকছে, মোবাইল তাক করে আমার ছবি তোলার জন্য পজিশন নিচ্ছে। তোমাদের বন দপ্তর ১৪৪ ধারা জারি করে এটা কিন্তু বন্ধ করতে পারতো। এই সময়ে জঙ্গলে শিকার উৎসব বন দপ্তর ও পুলিশ সাময়িকভাবে বন্ধ করলে আমাকে মরতে হতো না।
এই জঙ্গলে ঢোকার পর থেকেই তো আমাকে নিয়ে নানা গল্প। তোমাদের নজরদারি ক্যামেরায় আমার ছবি উঠছে অথচ একদল লোক বলতে শুরু করল ওটা বাঘ নয়, বাঘরোল। আবার আরেকদল বললো একটা নয় তিনটে বাঘ ঢুকেছে। আবার কেউ বললেন গোটাটাই গভীর চক্রান্ত, বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে কিছু চক্রান্তকারী। এসব শুনে বন দপ্তরের কিছু কর্তা বলতে লাগলেন অরণ্য বেড়েছে তাই বাঘও বেড়েছে। কেমন যেন কনফিউজ হয়ে গেলাম,আমার তো মানুষের মত অত কল্পনা শক্তি নেই।
সারা পৃথিবীতেই আমাদের নিয়ে নানা গল্প। লোকে আমাদের নিয়ে গর্ব করে,ভয় পায় এবং ভালও বাসে। পৃথিবীর সব ভাষায় আমাদের নিয়ে নানা গল্প, কবিতা, রূপকথা। ইংলিশে কবিতা আছে ‘টাইগার টইগার বার্নিং ব্রাইট।’ আমাদের ইংরেজি নামের কেতাই আলাদা- রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাংলাতে বাঘমামা, ব্যাঘ্রমশাই, বাঘু থেকে শুরু করে কত আদরের ডাকনাম। ডাকাবুকো মানুষকে তোমরা বলো, বাঘের বাচ্চা। আমরাই কিন্তু বাংলার গর্বকে অনেকটা ধরে রেখেছি। আমাদের জন্যই তোমাদের ট্যুরিজমের ব্যবসা বেড়েছে। লোকজন আমাদের দেখতেই আসে। সেই আমাকেই পেটের টানে চেনা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লালগড়ে আসতে হল।
আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম এমনকি তোমাদের পাতা ফাঁদে ধরাও দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নানা ঝামেলা, হট্টগোল, মানুষের বোকামি আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি। আমি তো নিজেই ভয় পেয়েছিলাম। যাদের আক্রমণ করেছি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেও একই কথা বলবে। অসহায় ক্ষুধার্ত পথভোলা একটা প্রাণীকে উদ্ধার করে আবার থাকার মত জায়গায় পাঠিয়ে দিলে আমি বেঁচে যেতাম। কিন্ত বনকর্মীরা প্রায় দুমাস এত তোড়জোড় করেও আমাকে উদ্ধার করতে পারলো না।
আর পারছি না। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। বল্লমটা ঢুকেছে গলার মোক্ষম জায়গায়। মরার আগে একটাই কথা বলে যেতে চাই তা হোল বন বাঁচাও তাহলেই আমরা বাঁচবো, মানুষও বাঁচবে। ও আরও একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে মারা যাবার পর আমার ডেড বডির উপর পা দিয়ে কেউ যেন সেলফি না তোলে। আমার সন্মানটা অন্তত রেখো।
তোমাদের বাঘমামা।