ঠাকুরনগর বারুণি মেলা উপলক্ষে ভক্ত সমাগম। লক্ষ লক্ষ মতুয়াদের সমাগম। আজ হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১৩ তম জন্মতিথি।সেই উপলক্ষে কয়েক লক্ষ মতুয়া সম্প্রদায়ের ভক্ত পুণ্য লাভের জন্য কামনা সাগরে স্নান করেছেন। সময় যত গড়াচ্ছে ততই মতুয়া সম্প্রদায়ের ভক্তদের ভিড় বাড়ছে ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়িতে।তিথি মেনে শনিবার সকাল ৭টা বেজে ২৩ মিনিটে থেকে স্নানের পুণ্য যোগ শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর চৈত্র মাসে মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শে মতুয়া ধামে মহামেলার আয়োজন করা হয়। এবারও সেই মেলা বসেছে। শনিবার থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ঠাকুরনগরের শ্রীধামে এই মেলা চলবে। প্রতিবছর এই মেলায় লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। ৭০ বছর ধরে বারুনী মেলা হয়ে আসছে। এবার এই মেলা নিয়ে মমতাবালা ঠাকুর ও শান্তনু ঠাকুরের দ্বৈরথে গত কয়েক দিন ধরেই ঠাকুরবাড়ি সরগরম।
ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনীতি, এদেশে নতুন নয়। তবে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি মতুয়াদের ভাবাবেগে যথেষ্ট আঘাত দিচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনের মুখে ঠাকুরনগরের মতুয়া ধর্ম মহামেলার পরতে পরতে যা টের পাওয়া যাচ্ছে। মেলা প্রাঙ্গণে শুধু নয়, স্টেশন চত্বর থেকে ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বাড়তি পুলিশ বাহিনী দেখে মতুয়াদের ভ্রুও কুঁচকে যাচ্ছে।
স্থানীয় এক চায়ের দোকানদার মনোতোষ বিশ্বাস বলেন, “জন্ম থেকে এই এলাকায় আছি। জীবনেও মতুয়া মেলায় এত পুলিশ দেখিনি। ঠাকুরবাড়ির দুজনের ঝামেলা মেলার চেহারাটাই বদলে দিচ্ছে।” এরপরেই তিনি বললেন, “গত ৫ বছরেই এত পরিবর্তন। এর আগেও তো মেলা হয়েছে কিন্তু মতুয়াদের আবেগ নিয়ে রাজনীতি করতে দেখিনি।”
“কামনাসাগরের” পাশে আমতলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মালদা থেকে আসা বৈদ্যনাথ মাঝি। ঠাকুরবাড়ির অন্দরের এই ঝামেলা, তা ঘিরে মতুয়াদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ভাল চোখে দেখছেন না তিনিও। তাঁর কথায়, সব “ধর্মের সঙ্গেই ভক্তির যোগ রয়েছে। ভক্তি নিয়েই লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মেলায় আসেন। সেই ধর্মীয় মেলাকে ঘিরে যদি কেউ স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করেন, তাঁদের মতুয়ারা সমর্থন করবেন না।” পাশে বসে থাকা রানাঘাটের এক বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা শিবাণী বিশ্বাস বলেন, “মেলা ঘিরে আগে যত উন্মাদনা ছিল, সিএএ হওয়ার পর তা খানিকটা কমেছে। মেলার আয়োজন থেকে পরিবেশ, পাঁচ বছরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে।” যদিও বনগাঁর বাসিন্দা অজয় রায় জানাচ্ছেন, সিএএ-এর কারণে মতুয়া মেলায় এবছর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের সমাগম হতে পারে। যা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেবে।
পাশাপাশি সিএএ নিয়ে যে মতুয়াদের পূর্ণ সমর্থন নেই, তাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। মেলা প্রাঙ্গণে ৩০০-র বেশি দোকান বসে। কেনাবেচা চুটিয়ে হলেও, অধিকাংশ দোকানদারই ক্ষুব্ধ। এক দোকানী বললেন, “মেলায় দোকানের লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে প্রতিবারই ঝামেলা হয়। শান্তনু ঠাকুরের দলের তরফে এসে হুমকিও দেয়। আগের বছর মমতাবালা ঠাকুর এক টাকাও নেননি। এবছর আবার ঝামেলার আশঙ্কা করছি।”
মেলার বিপুল পরিবর্তন নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের এত অভিযোগ সামনে আসছে, তখনই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা বালা ঠাকুর বললেন, এর জন্য দায়ী একমাত্র শান্তনু ঠাকুর। তাঁর কথায়, “২০১৯ সালের আগে ভক্তদের মন জয় করতে শান্তনু কথা দিয়েছিল, এই মেলায় রাজনীতির রঙ লাগতে দেবে না। হরিচাঁদ ঠাকুরকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল, ভোটে দাঁড়াবে না। অথচ ওই এই মেলাকে নিয়ে রাজনীতি করছে। প্রতিবছর ওর দলের কিছু দুষ্কৃতী মেলায় ঢুকে দোকানদারদের উপর চরম অত্যাচার করে।
শান্তনু কথার খেলাপ করে, ভোটে জেতার পর থেকেই সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। মতুয়াদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত কাজ করেছন, তা ভালবেসে করেছেন। তা নিয়ে নোংরা রাজনীতি কখনও করেননি। শান্তনুর হাত ধরেই আরএসএসের সদস্যরা মেলায় এসে হিংসা ছড়ায়। গত পাঁচ বছরে এসবের সাক্ষী ভক্তরা। আশা করছি, এবারের ভোটে তার প্রভাব পড়বে।”
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী তথা বনগাঁ লোকসভার সাংসদ শান্তনু ঠাকুর সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিলেন, মতুয়াদের ধর্মীয় মেলা বন্ধ করার জন্য মমতা ঠাকুর ১৪৪ ধারা জারি করার আবেদন জানিয়েছেন। শুধু তাই নয় মেলায় যাতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকে সে নিয়েও চক্রান্ত করে রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা বিদ্যুৎ দিতে পারবে না। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারি হলেও মেলা হবেই।
ওই দিনই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর জানিয়েছিলেন, মেলাতে অসামাজিক কার্যকলাপ রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করার আর্জি জানানো হয়েছে। এতে মতুয়া মেলায় আসা ভক্তদের কোনও অসুবিধা হবে না।”
এরপরেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন ভক্তরা। মেলায় আদৌও আসা হবে কিনা তা নিয়ে দোলাচলে ছিলেন তাঁরা।
পুলিশ সুপার বলেন, কোনও ১৪৪ ধারা এখানে লাগু হবে না। আমি সবাইকে এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছি, সবাই আসুন, মেলার আনন্দ উপভোগ করুন। জেলা পুলিশ মেলার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার ব্যবস্থা করেছে। প্রায় পাঁচশো পুলিশকর্মী এখানে মোতায়েন করা হচ্ছে। তবে ১৪৪ ধারা জারি করা হচ্ছে না।” মমতাবালার আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “উনি আবেদন করেছিলেন। সেটা পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে। আমরা সমস্ত বক্তাদের মেলায় আসার জন্য আবেদন করছি।”
এদিন মেলা পরিদর্শনের পর পুলিশসুপারের কথায় আশ্বস্ত হলেন সবাই। ভিড়ও ক্রমশও বাড়ছে ঠাকুরনগরের মেলা চত্বরে।