দেশের সময়: একদিকে বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলির বৈভব। থিমের ছড়াছড়ি। মণ্ডপসজ্জা থেকে আলোর কারসাজি, সবেতেই জৌলুস। পুজো উদ্বোধনে তারকা সমাবেশ। অন্যদিকে, বনেদি বাড়ির পুজোয় আজও ঐতিহ্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। কয়েকশো বছর আগে জমিদারি চলে গিয়েছে। রাজপাট, পাইক, বরকন্দাজ আর নেই। বেশিরভাগ রাজবাড়ি কিংবা জমিদারবাড়ির দালানে বাসা বেঁধেছে উই। খসে পড়ছে পলেস্তারা। বিশাল বাড়িতে এমন অনেক ঘর রয়েছে, যা সারা বছরে একবারও খোলা হয় না। মরচে ধরেছে তালায়।

ছবিগুলিতুলেছেন – ধ্রুব হালদার ৷

পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। কর্মসূত্রে বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই বাইরে থাকেন। তবুও আজও সেসব বাড়িতে উমা আসে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও গমগম করে ওঠে গোটা বাড়ি। মনে করিয়ে দেয় পুরনো সে দিনের কথা। সময়ের সঙ্গে এসব পুজোর জাঁকজমক কমেছে ঠিকই, কিন্তু হাজারো চাকচিক্যের ভিড়ে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল বাংলার জমিদার বাড়ির পুজো। কোন জমিদার বাড়িতে কেমন পুজো হয়, রইল তারই সুলুক সন্ধান। সেইসঙ্গে কলকাতার প্রথম দুর্গোৎসব শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর ইতিহাসকেও একবার ফিরে দেখার চেষ্টা। কালের নিয়মে কতটা বদলাল সেই পুজো। তুলে ধরা হল সেটাও। 

বলা হয়, বড়িশার পুজো কলকাতার প্রথম পুজো। আর দ্বিতীয় শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কিন্তু কলকাতার প্রথম দুর্গোৎসব ধরলে প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কারণ, দুর্গাপুজো বলতে তখন তা বাড়ির অন্দরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই পুজোই বাইরের কেউ অংশ নিতেন না। কিন্তু শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় সুতানুটির আপামোর মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এমনকী ইংরেজরাও এসেছিলেন এই পুজোয়। সালটা ১৭৫৭। শোভারাম বসাকের কাছ থেকে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি কেনেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তারপর সেই বাড়ি সারিয়ে শুরু করেন পুজো। এই পুজো ঘিরে যেন চাঁদের হাট বসে। কে না আসেননি এই পুজোয়। নাচ-গান, মেলার আসর বসত পুজোর সময়। বহু লোকের সমাগম হত। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের তখনও কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নিয়েছিলেন।

এরপর ১৭৮২ সালে রাজা নবকৃষ্ণের পুত্রসন্তান হয় রামকৃষ্ণ দেব। সেই খুশিতে নবকৃষ্ণ পুরনো রাজবাড়ির দক্ষিণদিকে একটি সাতমহলা বাড়ি তৈরি করান। এবং ১৭৯০ সালে সেই বাড়িতে তিনি আরও একটি দুর্গাপুজোর পত্তন করেন। এই পুজোর সংকল্প করেন নিজের ছেলের নামে। আজও নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিটে শোভাবাজার রাজবাড়ির দু’টি পুজো ঘিরে সমান ঐতিহ্য বহমান। দক্ষিণ বাড়ির পুজোর বর্তমান উদ্যোক্তা দেবাশিসকৃষ্ণ দেব বললেন, যে নিয়মরীতি মেনে পুজো শুরু হয়েছিল, আজও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা হয়। আমাদের এখানে পুজো বৈষ্ণব স্মার্ত মতে। মাকে আবাহন করা হয় কন্যা রূপে। শোভাবাজার রাজবাড়ির উত্তরবাড়ির পুজোর প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয় রথের দিন। আর দক্ষিণবাড়ির পুজোর প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথে। মায়ের ডানদিকের পায়ে যে বাঁশটি থাকে, সেটিই পুজো করা হয়। তারপর শুরু হয় প্রতিমা গড়ার কাজ।

একই পরিবারের শিল্পীরা বংশপরম্পরায় আমাদের প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। প্রতিমার কাঠামোয় একমেটে হয়ে যাওয়ার পর শুক্লা ত্রয়োদশীতে ঠাকুর ওঠে দালানে। তারপর পুজোর আগে চতুর্থীর দিন মাকে সিংহাসনে বসানো হয়। এখনও সন্ধিপুজো শুরু ও শেষের সময় তোপধ্বনি দেওয়া হয়। আগে পাঁঠাবলি হত। কিন্তু এখন তা বন্ধ। আগে দশমীর দিন ওড়ানো হত নীলকণ্ঠ পাখি। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের জেরে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে জোড়া নৌকায় গঙ্গায় বিসর্জনের রীতি অটুট। শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় শুকনো ভোগ দেওয়া হয়। ভোগের মধ্যে ভাজা মিষ্টি অন্যতম। বাড়িতেই বানানো হয়। আগে মিষ্টি ও নোনতা মিলিয়ে ৩৬ রকম পদ বানানো হত। এখন অত না পারলেও ১৪-১৫ রকমের তো হয়ই, বললেন দেবাশিসবাবু। এই ভাজা মিষ্টি সারাবছর পরিবারের কুলদেবতা গোপীনাথকে দেওয়া না গেলেও দুর্গাপুজোর সময় তা নিবেদন করা হয়। কৃষ্ণনগর থেকে আসে প্রতিমার সাজ।

গত ৩৫ বছর ধরে শোভাবাজার রাজবাড়ির দক্ষিণবাড়ির পুজোর প্রতিমা বানাচ্ছেন শিল্পী দিলীপ পাল। রাজপরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র বংশধররা নিজেদের মতো করে সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। তবে বহু জিনিস নষ্টও হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় রাজবাড়িতে পা রাখলে কয়েকশো বছর পিছিয়ে যেতে হয়। এখনও রয়েছে সেই আমলের ঝাড়বাতি। রানি ভিক্টোরিয়া রাজা কালীকৃষ্ণ দেবকে যে আয়না উপহার দিয়েছিলেন, দেখা মিলবে সেটিরও। ঠাকুর দালানটিও সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বংশধররা। ইতিহাস বলছে, ইংরেজরা যখন ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, সেসময় সন্তানদের নিয়ে সুতানুটিতে চলে আসেন নবকৃষ্ণ দেবের মা।

নবকৃষ্ণ ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত তিন ভাষাতেই অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ইংরেজরা যখন কলকাতায় প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করছে, তখন তাদের এমন একজনকে দরকার হয়েছিল, যিনি দেশীয় ভাষাটা জানেন। সেই সূত্রে নবকৃষ্ণ দেব ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে কর্মদক্ষতায় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি নিযুক্ত হন। নবকৃষ্ণ দেবের সূচনা করা পুজোয় যোগ দিয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ থেকে লর্ড হেস্টিংসের মতো ব্রিটিশ শাসকরা। এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ থেকে বিদ্যাসাগর, গান্ধীজির মতো ব্যক্তিত্ব। একসময় কামানের তোপ দেগে শোভাবাজার রাজবাড়ির সন্ধিপুজো শুরু ও শেষ হত। এখন কামানের গোলার পরিবর্তে বন্দুকের গুলির আওয়াজ শোনা যায়। রাজবাড়ির সদস্যরা মনে করেন, সন্ধিপুজোয় অর্থাৎ অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে মা দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে অসুর বধ করেন। তখনই অশুভ শক্তির বিনাস ঘটে। জাগ্রত হয় শুভ শক্তি। তোপ ধ্বনি দেগে অশুভ শক্তির বিনাসে ওই শব্দের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয় মর্ত্যবাসীর জয়োল্লাস। নীলকণ্ঠ পাখি আকাশে ওড়ানো না হলেও এখন মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলে। বিশ্বাস, এই নীলকণ্ঠ পাখিই কৈলাসে মহাদেবকে মায়ের রওনা হওয়ার খবর দেয়। 

শুধু শোভাবাজার রাজবাড়ি নয়, বাংলার আরও জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে চাপা পড়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। 

কোচবিহারের ইতিহাস প্রায় সাতশো বছরের পুরনো। তখন কান্তেশ্বর মহারাজের রাজত্ব। সেসময় থেকেই দুর্গাপুজোর শুরু। পরবর্তীতে কোচ রাজারা এই পুজোকে সরিয়ে নিয়ে আসেন কোচবিহারে। প্রথমে এই পুজো হত ভেটাগুড়ি রাজবাড়িতে। পরে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ রায়ের হাত ধরে পুজো শুরু হয় মদনমোহন বাড়িতে। তাও দেখতে দেখতে সাড়ে পাঁচশো বছর পেরিয়ে গেল এই পুজো। খাগের কলমে তাল পাতার কাগজের উপর দেবনাগরী হরফে লেখা পুঁথি।

এই পুঁথি ছাড়া কোনওমতেই কোচবিহার রাজবাড়ির পুজো সম্ভব নয়। প্রায় সাড়ে ছ’শো বছরের পুরনো এই পুঁথি আগে শোভা বর্ধন করত রাজমাতার মন্দিরে। বর্তমানে তা রাখা আছে মদনমোহন মন্দিরেই। শুধু দুর্গাপুজো নয়, ওই পুঁথিতে লেখা আছে রাজবাড়ির কালীপুজো, মদনমোহনের নিত্যপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, গন্ধেশ্বরী পুজো, মহালক্ষ্মী পুজো, বিপত্তারিণী ও মা ভবানীর পুজোর পদ্ধতি। অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করা হয়। মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় এই পুজো। দেবীপক্ষের সূচনায় ঘট বসে। দুর্গা এখানে বড়দেবী। তাঁর গায়ের রং রক্তবর্ণা। সখী পরিবেষ্টিত। সিংহ ছাড়াও দেবীর বাহন বাঘ। দেবীর দক্ষিণ দিকে সিংহ অসুরের পা কামড়ে ধরেছে। বাঁ দিকে অসুরের পায়ে কামড় বসিয়েছে ব্যাঘ্র। মায়ের সঙ্গে তাঁর চার সন্তানকে দেখা যায় না এখানে। পরিবর্তে থাকেন মায়ের দুই সখী জয়া ও বিজয়া।

রাজ্যপাট না থাকলেও এখনও রাজার নামেই পুজো হয়। এই পুজোর পরতে পরতে রয়েছে চমক। ময়না গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় দেবী মূর্তির কাঠামো। শ্রাবণ মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ময়না গাছের ডাল কেটে পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় কোচবিহারের গুঞ্জবাড়ির ডাঙ্গরআই মন্দিরে। ১১ ফুট লম্বা ওই কাঠকে নববস্ত্র পরিয়ে পুজো করা হয়। ময়নাকাঠের সময় সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় পরমান্ন। রাজ পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে ময়নাকাঠকে আমন্ত্রণ জানাতে হাজির হন দুয়ারবক্সি। তার পর তিনি পালকিতে ওই ময়নাকাঠ চাপিয়ে বাজনা বাজিয়ে রওনা হন মদনমোহন বাড়ির উদ্দেশে। সেখানেই একমাস ধরে চলে যুগচ্ছেদন পুজো। এই ময়নাকাঠের উপরেই অধিষ্ঠিত হন বড়দেবী।

এই কাঠকে বলা হয় শক্তিদণ্ড। রাধাষ্টমী তিথিতে শক্তিদণ্ড নিয়ে আসা হয় বড়দেবীর মন্দির দেবীবাড়িতে। সেখানে পাটে বসানো হয় ওই কাঠ। খুলে নেওয়া হয় বস্ত্র। তিনদিন সেভাবেই থাকে কাঠটি। এই প্রথাকে বলা হয় হাওয়া খাওয়ানো। ওই প্রথা শেষ হলে ময়না কাঠের উপর প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মায়ের মুখ তৈরির জন্য মাটি আসে তুফানগঞ্জের চামটা গ্রামে কোচ রাজাদের দান করা জমি থেকে। পুজোর দায়িত্বে দেবত্তোর ট্রাস্ট। কথিত আছে, একসময় এই পুজোয় নরবলির চল ছিল। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখনও কয়েক ফোঁটা নররক্ত দেওয়ার চল রয়েছে। রাজ পরিবারের পুজো। ফলে পুজোর ভোগও রাজসিক হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই পুজোয় দেবীকে আমিষ ভোগ দিতে কোনও বাধা নেই। নবমী তিথি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এদিন দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। পাঁচটি পাঁঠা ও একটি পানি মাছ বলি দিয়ে ষোড়শপচার পুজো শেষ করার পর দেবীকে নিবেদন করা হয় অন্নভোগ। বোয়াল মাছ সহযোগে দেবীকে খিচুড়ি ভোগও দেওয়া হয়ে থাকে। 

মালদহের ইংলিশবাজার শহরের অন্ধারুপাড়া ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজোও আজও ঐতিহ্যে অটূট। গরিমায় উজ্জ্বল। পুজোর পাঁচদিন এখানে জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে ভোগ বিলি করা হয়। অতিথি আপ্যায়নই এই পুজোর পরম্পরা। তাতে যেন কোনওভাবেই ত্রুটি না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখেন পরিবারের সদস্যরা। পুজোর আগে একমাস বাড়ির সবাই নিরামিষ খান। মহালয়ার সকালে চক্ষুদান হয় মায়ের। তৃতীয়ার দিন শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হয় মাকে। প্রতিপদে ঘট বসে। পঞ্চমীতে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ষষ্ঠীর দিন নবপত্রিকাকে কাঠের আসনের উপর শুইয়ে রাখা হয়। পরদিন ভোরে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে হলুদ লাল পাড়ের শাড়ি পরিয়ে তাকে তুলে দেওয়া হয় গৃহকর্তার হাতে। গঙ্গাজল দিয়েই রান্না করা হয় পুজোর যাবতীয় ভোগ। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন ১০৮টি করে বেলপাতা, পদ্মের মালা, নীল অপরাজিতা, জবার মালা প্রয়োজন হয়। রাজকীয় ভোগ হয় ত্রিপ্রহরে। ৫ কেজি পঞ্চ কাঠ, ঘি, পঞ্চপল্লব সহকারে হয় যজ্ঞ।

মাকে পরানো হয় বেনারসি শাড়ি। অতীতে এই পুজোতেও বলির চল ছিল। কিন্তু এখন তা বন্ধ। বলি বন্ধের পর কুমড়ো বলি দেওয়া হত। এখন কলাইয়ের ডাল দেওয়া হয় দেবীর সামনে। বহু আগে থেকেই এই পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাড়িতেই চলছে ঘি, নারকেল নারু, খই ও ক্ষির বানানোর কাজ। নবমীতে বিলি করা হবে অন্নকূট মহাপ্রসাদ। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নওগাঁতে স্বপ্নাদেশে মায়ের আরাধনা শুরু হয়। তা প্রায় আড়াইশো বছর আগে। ১৯৬৩ সালের পর তাঁরা মালদহে চলে আসেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই পুজো চলে আসে ইংলিশবাজারের আন্ধারু পাড়ার ঘোষবাড়িতে। 

৩৫০ বছরে পা দিল চাঁচল রাজবাড়ির পুজো। প্রাচীন রীতি মেনে কৃষ্ণা নবমী থেকে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে এখানে। চাঁচলের পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে মঙ্গলঘট স্থাপনের মধ্যে দিয়ে চলছে মাতৃ আরাধনা। ঢাক বাজিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ সংলগ্ন পুকুর থেকে ঘটে জল ভরা হয়। তার পর সেই ঘট নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। সপ্তমীতে রাজ ঠাকুরবাড়ি থেকে সিংহবাহিনী দেবীকে নিয়ে আসা হবে চণ্ডীমণ্ডপে। দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পাশে সিংহবাহিনীকে স্থাপন করে পুজো চলবে দশমী পর্যন্ত। দশমীর পর ফের সিংহবাহিনী দেবীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে রাজ ঠাকুরবাড়িতে। ১৭ দিন ধরে চলে পুজো। ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন দেখা যায় এই পুজোতে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে উত্তর মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরি। বিহারের কিছু অংশও তাঁর রাজত্বের মধ্যে ছিল। কথিত আছে, রাজা একদিন স্বপ্নাদেশ পান। সেই মতো তিনি মহানন্দা নদীর ঘাটে স্নান করতে যান। সেসময় তাঁর হাতে অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা মূর্তি উঠে আসে।

সেই মূর্তি রাজা দু’কিলোমিটার দূরে রাজবাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই ওই মূর্তির নিত্যপুজো শুরু হয়। প্রথমে মহানন্দা নদীর পাড়ে মাটির ঘর আর খড়ের ছাউনি দিয়ে মন্দির তৈরি করে পুজো শুরু হয়। পরে রাজা রামচন্দ্রের পৌত্র শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরির নির্দেশে তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় পাকা দালান। সেখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয় দেবীকে। এখন আর রাজ্যপাট নেই। চাঁচল রাজবাড়িতে তৈরি হয়েছে কলেজ, মহকুমা প্রশাসনিক ভবন, আদালত ও একাধিক দপ্তর। তবে রাজবাড়ির একাংশে ঠাকুরবাড়ি একইরকম থেকে গিয়েছে। কথিত আছে, একসময় সতীঘাটায় মহানন্দার পশ্চিম পাড়ে মহামারী দেখা দিয়েছিল। সেসময় দেবী সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের একজনকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, গোধূলি লগ্নে বিসর্জনের সময় তাঁরা যেন মাকে আলো দিয়ে পথ দেখান। তা করার পরই গ্রাম থেকে মহামারী দূর হয়। তখন থেকে আজও বিসর্জনের সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন লণ্ঠনের আলো দিয়ে পথ দেখান মাকে। আগে দেবীকে হাতির পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। মাথায় থাকত রুপোর ছাতা। এখন মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হয়। শোভাযাত্রা করে যান সবাই। দেবীর মাথায় ধরা হয় সে যুগের রুপোর ছাতা। হাওয়া করা হয় রুপোর পাখা দিয়ে। 

উত্তরবঙ্গের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম ময়নাগুড়ির আমগুড়িতে বসুনিয়া বাড়ির পুজো। দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো এখানকার পুজো। এখানে দুর্গাকে রাজবংশীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাটানি পরানো হয়। এখানে মা আসেন রাজবংশী বধূর বেশে। এই পুজোর বিশেষত্ব হল সাবেকিয়ানা। ষষ্ঠীতে বোধনের পর থেকেই মায়ের আরাধনায় মেতে ওঠে গোটা পরিবার। স্থানীয়দের পাশাপাশি গরুমারা অভয়ারণ্যে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অনেকেও এই পুজো দেখতে আসেন। আগে বলি হলেও এখন তা বন্ধ। এখানে মাকে একেবারের ঘরের মেয়ের মতো করে আরাধনা করা হয়। তাঁর মুখে মঙ্গোলীয় জনজাতির ছাপ। ১৮১০ সালে আমগুড়ির ধনবর বসুনিয়া এই পুজোর সূচনা করেন। এটি অতীতে বসুনিয়া বাড়ির যাত্রাপুজো নামে পরিচিত ছিল। 

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মা দুর্গা রাজরাজেশ্বরী নামে পরিচিত। প্রচলিত দুর্গা মূর্তির থেকে এই মূর্তি একেবারেই আলাদা। রীতি অনুযায়ী, মহালয়ার পরে প্রতিপদের দিন থেকেই রাজরাজেশ্বরীর হোম জ্বলে ওঠে। কয়েক কুইন্টাল ঘি, বেল কাঠ সহ নানা উপাচারে শুরু হয় যজ্ঞ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করা এই পুজোয় হোমের আগুন জ্বলে টানা নবমী পর্যন্ত। উল্টোরথের পরদিন পাটপুজোর মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। আগে এই পুজোর প্রতিমা তৈরি করতেন শিল্পী সাধন পাল। ১৯৬৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই দেবী মূর্তিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখানে দেবীর সামনের দু’টি হাত বড়। পিছনের আটটি হাত অপেক্ষাকৃত ছোট। দেবীর গায়ে থাকে বর্ম। যুদ্ধবেশ। অর্ধগোলাকৃতি সাবেক বাংলা চালির একদিকে আঁকা থাকে দশাবতার, অন্যদিকে দশমবিদ্যা। মাঝে থাকেন পঞ্চানন শিব। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ। সামনে থাকে ঝুলন্ত অভ্রধারা। প্রতিমার সাজেও রয়েছে কিছু পার্থক্য। প্রচলিত ডাকের সাজের চেয়ে আলাদা। একে বলা হয় বেদেনি ডাক। এখন কামান দেগে সন্ধিপুজো না হলেও আজও এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ সন্ধিপুজো। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সন্ধিপুজো দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। প্রথা মেনে ১০৮টি পদ্মফুল ও ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। আগে ছাগবলি হত। এখন আখ ও চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। মহালয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর ভোগ। খিচুড়ি, ভাজা, ছ্যাঁচড়া সহ একাধিক তরকারি, চাটনি, সুজি, পায়েস থাকে পুজোর ভোগে। সপ্তমীতে সাত রকমের ভাজা হয়। অষ্টমীতে পোলাও, ছানার ডালনার সঙ্গে ভাত, আটরকম ভাজা, মিষ্টি, ক্ষীর সহ একাধিক পদ থাকে। নবমীতে হয় ন’রকমের ভাজা, তিনরকম মাছ, ভাত ও মিষ্টি। দশমীতে গলা ভাত, শিঙি মাছ, খই, ফল, দই, চিড়ে ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে পরিবারের সবার মন খারাপ হয়ে যায়। সেই বিসাদের সুর ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। তারই মধ্যে মাকে বিদায় জানাতে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন পরিবারের বধূরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here